মণিপুরে মোদী

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

মণিপুরে ২০২৩ সালের মে মাসে মেইতেই এবং কুকিদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ শুরু হয়েছিল। উভয় গোষ্ঠী নিজেদের অস্তিত্বরক্ষার আওয়াজ তুলে হিংসায় মেতে উঠেছিল। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাব থেকে শুরু করে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীরা নানা সময়ে মণিপুরে এসে নানা স্তরের মানুষের সঙ্গে কথা বলে শান্তি ফেরাতে আলোচনায় বসেছিলেন। মূলত কুকি এবং মেইতেইদের হিংসার জেরে গত লোকসভা নির্বাচনে মণিপুরের দু’টি কেন্দ্রেই বিজেপি পরাস্ত হয়েছিল।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় মণিপুরে নতুন রাজ্যপাল করে আনা হয়েছিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর আস্থাভাজন প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রসচিব অজয় কুমার ভাল্লাকে। তিনি যথেষ্ট কড়া প্রশাসক বলে পরিচিত। কাশ্মীরে তিনি দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে মণিপুরে বিজেপি সরকারের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং পদত্যাগ করেন। কেন্দ্র তখন বিধানসভা ভেঙে না দিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করেছিল, যা এখনও চলছে। প্রয়োজনে বিধানসভাকে সক্রিয় করে রাজ্য সরকার গঠনের রাস্তা খোলা থাকলেও তা করা যাচ্ছে না পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়ার কারণে। মণিপুরের পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচন হওয়ার কথা ২০২৭ সালে ফেব্রুয়ারি-মার্চ নাগাদ। তার আগেই মণিপুরকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা চলছে।

পাশাপাশি কেন্দ্রের উদ্যোগে উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ। তবে কুকি ও মেইতেইদের মধ্যে যে অবিশ্বাস রয়েছে, তা প্রথমে দূর করা জরুরি। কীভাবে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী মিলেমিশে থাকবে, কুকি ও মেইতেইরা পরস্পরের অধ্যুষিত এলাকায় স্বচ্ছন্দে যাতায়াত করতে পারবে, সেই সমাধান সূত্র খুঁজে পাওয়া একান্ত জরুরি।


মেইতেই অধ্যুষিত ইম্ফল উপত্যকা এবং কুকি অধ্যুষিত পাহাড়ি এলাকার বিরোধ না মেটা পর্যন্ত অখণ্ড মণিপুরের পুরোপুরি স্বাভাবিক হওয়া কঠিন। বস্তুত মেইতেই ও কুকিদের বিরোধী দীর্ঘদিনের। বছর দুয়েক আগে শুরু হওয়া হিংসায় মেইতেইদের হাতে অনেক কুকি এবং কুকিদের হাতে অনেক মেইতেই খুন হন। একে অপরের এলাকা দিয়েও চলতে পারতেন না। বর্তমান পরিস্থিতিতে কুকিরা তাদের জন্য পৃথক বিধানসভা-সহ কেন্দ্রশাসিত কুকি অঞ্চল গড়ার দাবি জানিয়েছেন। মেইতেইরা তাদের সংরক্ষণ নিয়ে সরব। কেন্দ্র অবশ্য আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার জট ছাড়াতে আগ্রহী। কোনও গোষ্ঠী যাতে নিজেদের বিপন্ন বোধ না করে, সেই পরিবেশ গড়ে তোলাই মোদী সরকারের এখন বড়ো কাজ। মণিপুরের পাহাড় ও সমতলের মধ্যে একাত্মবোধ জাগাতে না পারলে কাজটা কঠিন সন্দেহ নেই।

দীর্ঘ ২৮ মাস পর প্রধানমন্ত্রী মোদীর মনে পড়েছে মণিপুর নামে ভারতের একটি রাজ্য রয়েছে। ২৮ মাসে বাকি সব রাজ্য ও কেন্দ্র-শাসিত অঞ্চল অনেকবার সফর করলেও একবারের জন্য তিনি ভাবেননি যে মণিপুরে তাঁর একবার যাওয়া উচিত। এবং জরুরিও। ২০২৩ সালের মে মাস থেকে জ্বলছে মণিপুর। গোষ্ঠী সংঘর্ষ আর জাতি দাঙ্গায় তছনছ হয়ে গেছে রাজ্যটি। আড়াইশো মানুষ খুন হয়েছেন, আরও কয়েকশোর হদিশ নেই। আহত-জখমের সংখ্যা অগুনতি। ৬০ হাজারের বেশি মানুষ ঘরছাড়া। আজও রয়েছেন আশ্রয় শিবিরে। কয়েক শো গ্রাম আগুনে পুড়ে ছারখার। এই মণিপুরে ২৮ মাস আগে মহিলাদের নগ্ন করে প্রকাশ্য দিবালোকে হাঁটানো হয়েছিল। নারী জাতি তথা মায়েদের এই অপমানের দৃশ্যের ভিডিও দেখে লজ্জায় চোখ বন্ধ করে মাথা নত করেছিল গোটা বিশ্ব। শিউড়ে উঠেছিল মানুষের সংবেদনশীল হৃদয়। নিন্দা, ধিক্কার, প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল সবদিক থেকে। দেশের প্রধানমন্ত্রীর মণিপুর নিয়ে অসীম নীরবতার মধ্যে মানবতার বিরুদ্ধে এমন কুৎসিততম ঘটনাকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা ছিল। কিন্তু মোদীজি জেগে উঠলেন ৭৮ দিন পর, তাও মাত্র ৩৬ সেকেন্ডের জন্য।

ক্ষমতায় আসার পর থেকে মোদীজি ডাবল ইঞ্জিন সরকারের গুণকীর্তন করে বেড়ান। মণিপুরে চলছিল আরএসএস-বিজেপির ডাবল ইঞ্জিন সরকার। মোদী মার্কা ডাবল ইঞ্জিন সরকারের এমনই মহিমা যে বিভাজনের দাপটে মেইতেই এবং কুকিদের মধ্যে সরাসরি বিভাজন দেখা দিল। সমতল কেবল মাত্র মেইতেইদের জন্য, সেখানে স্থান নেই কুকিদের। আর কুকি এলাকায় স্থান নেই মেইতেইদের। মোদী-শাহের পরামর্শে চলা মণিপুরের বিজেপি সরকারের এমন অবস্থা হলো যে, মুখ্যমন্ত্রী-সহ অন্য মন্ত্রীরা রাজ্যের সর্বত্র যেতে পারতেন না। ব্যর্থতার এই দায় ঢাকতে নিজের দলের সরকার ভেঙে দিয়ে জারি করা হয়েছিল রাষ্ট্রপতি শাসন। সত্যি নজিরবিহীন ঘটনা। এরপর সেই রাজ্যে গিয়ে মুখ দেখাবেন কী করে। তাই দেশের মানচিত্র থেকেই মণিপুরকে বাদ দিয়ে রেখেছিলেন মোদীজি।

এই সময়ের মধ্যে কয়েক ডজন দেশ সফর করেছেন মোদী। উত্তর-পূর্ব ভারতে মণিপুর বাদে বাকি সব রাজ্যে গিয়েছেন। গত লোকসভার ভোটের প্রচারেও গিয়েছিলেন। এমনকি অসমে গিয়ে কাজিরাঙায় হাতি সফরও করেছেন। কিন্তু মণিপুরে কখনওই নয়। দেশের সব বিরোধী দল বার বার তাঁকে মণিপুরে গিয়ে দাঙ্গা থামাতে, অশান্তি ও হিংসা থামাতে সক্রিয় পদক্ষেপ নিতে বলেছে। উনি পাত্তাই দেননি। শেষ পর্যন্ত ২৮ মাস পর দায়সারা গোছের একটা সফর করলেন বটে, কিন্তু তাও মাত্র তিন ঘণ্টার জন্য। অসহায় বিধ্বস্ত মানুষগুলোকে আশা-ভরসা না দিয়ে দুই গোষ্ঠীর দুই এলাকায় মোট ৪০ মিনিট ভাষণ দিলেন। এর ৯০ ভাগই অবশ্য নিজের ঢাক পেটানো উন্নয়নের ধারা বিবরণী। মণিপুর নিয়ে যে আদৌ তাঁর মাথা ব্যথা নেই তা ওই রাজ্যে গিয়েও বুঝিয়ে দিলেন মোদী।