ভারতের প্রতিবেশী দেশ নেপাল। হিমালয়ের কোলে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে উজ্জ্বল এই শান্ত দেশ এখন উত্তপ্ত। ২০০৫ সাল থেকে সেখানে ধারাবাহিকভাবে অশান্তি চলছে। ২০০৮ সালে পতন হয় প্রাচীন রাজতন্ত্রের। একসময়ে বিশ্বের একমাত্র হিন্দু রাষ্ট্রের রাজা জ্ঞানেন্দ্র শাহ (২০০১ থেকে ২০০৮) ক্ষমতাচ্যুত হন আন্দোলনের চাপে। এরপর গঠিত হয় নির্বাচিত সরকার। নতুন নেপাল ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ রাষ্ট্র হিসাবে পরিচিত হয়। গত ১৭ বছরে নেপালে বারে বারে সরকার বদল হয়েছে। একাধিকবার বদলে গেছে প্রধানমন্ত্রীর মুখ। কিন্তু প্রত্যাশা পূরণ হয়নি সাধারণ মানুষের। এবার একেবারে বাংলাদ্শের কায়দায় দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে আন্দোলন।
২০০৮ সালে গণতন্ত্র কায়েম হওয়ার পর থেকে, ১৭ বছরে ১৪টি সরকার দেখেছে নেপাল। বেশির ভাগই ছিল জোট সরকার। ক্ষমতা ঘোরাফেরা করেছে মূলত তিনজনের মধ্যে— চিনপন্থী কে পি শর্মা ওলি, মাওবাদী সেল্টারের পুষ্পকমল দহল (প্রচণ্ড) এবং পাঁচ বারের প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবা। তিনজনের বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। ফলে ক্রমশ হতাশ হয়ে পড়েছে নেপালি তরুণরা।
রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না আসায় মজবুত হয়নি অর্থনীতি। স্থবিরতা দেখা দিয়েএেছ। পাল্লা দিয়ে বেড়েছে বেকারত্ব। সোশ্যাল মিডিয়ায় নেপালি যুব সমাজের এই হতাশা ধরা পড়েছিল। নেপালি রাজনীতিবিদদের সন্তানদের বিলাসবহুল জীবনযাত্রা, দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ধরে সোশাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল ‘নেপোকিড’ প্রচার। তরুণ প্রজন্ম ‘নেপো কিড’ বা বড়লোকের বখাটে ছেলেমেয়েদের বিলাসবহুল জীবনযযাপন নিয়ে তীব্র ক্ষোভ উগড়ে দিচ্ছিল। তাদের সরাসরি বক্তব্য, দেশবাসীকে শোষণ বা ব্যাপক দুর্নীতি করেই নেতাদের ছেলেমেয়েদের এই অসভ্যের মতো বৈভবের বন্দোবস্ত করা হয়েছে। তারা এই জিনিস আর বরদাস্ত করবে না বলে দেশজুড়ে প্রচার শুরু করে ‘জেন-জি’। এই প্রজন্মের সদস্যদের বয়স ১২ থেকে ২৭।
সরকারের মাথাব্যথা শুরু হয়ে যায়। ২৬টি জনপ্রিয় অ্যাপ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ওলি প্রশাসন। বিক্ষোভে ফেটে পড়ে গোটা দেশ। প্রতিবাদীদের হাতে শোভা পায় ‘এনাফ ইজ এনাফ’ (যথেষ্ট হয়েছে) এবং ‘এন্ড টু কোরাপশন’ (দুর্নীতির অবসান হোক) প্ল্যাকার্ড। এই গণ প্রতিবাদ মোকাবিলা করতে গিয়ে পুলিশ গুলি চালায় এবং অনেকেই মারা যায়। মানুষের প্রতিবাদের সমস্ত বাঁধ ভেঙে যায় মুহূর্তে। দেশের প্রেসিডেন্ট থেকে প্রধানমন্ত্রী, এমনকি প্রাক্তন মন্ত্রীদের প্রাসাদ এবং অফিসেও হামলা হয়। কিছু ক্ষেত্রে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, লুঠপাটও করা হয়েছে। নিগৃহীত হন মন্ত্রীরা। প্রতিবাদীদের লক্ষ্যবস্তু হয়ে ওঠে সংসদ ভবন, শাসক দলের পার্টি অফিস এবং অফিস-আদালত-শপিং মল প্রভৃতি। বেনজির নৈরাজ্য। বেগতিক বুঝে সরকার অ্যাপের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার পরও শেষরক্ষা হয়নি। পতন হয় ওলি সরকারের। নেপালে আপাতত বহাল সেনার শাসন।
সমস্যাটি এখন আর শুধু নেপালের নয়। বিশেষ চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে ভারত সরকারের কাছে। বাফার স্টেট নেপালের সঙ্গে ভারতের রয়েছে সুদীর্ঘ মুক্ত সীমান্ত। নেই কোনও সমুদ্র সীমান্ত। ভারতের উপর দিয়েই তাদের সমুদ্র যোগযোগ রক্ষা করতে হয়। আর একটি উদ্বেগের বিষয় হলো— জঙ্গি অনুপ্রবেশ, মাদক পাচার এবং জাল নোটের কারবার বৃদ্ধিতে নেপালকে প্ল্যাটফর্ম হিসাবে ব্যবহার করে পাকিস্তান। বাণিজ্য বৃদ্ধির লক্ষ্যে নেপালকে টার্গেট করে থাকে চিন। একাধিক ইস্যুতে নেপালের সঙ্গে ভারতের সীমান্ত সমস্যা সৃষ্টির নেপথ্যে রয়েছে পাকিস্তান ও চিনের পরোক্ষ ভূমিকা। অন্যদিকে বাংলাদেশের বর্তমান সরকারও নেপালকে চূড়ান্ত ভারত-বিরোধী করে তুলতে সক্রিয়। এই ডামাডোলে নেপালে বিভিন্ন জেল ভেঙে পালিয়েছে প্রায় ১৫০০ বন্দি। শ্রীলঙ্কা ও বাংলাদেশের পর নেপাল। বার্তা একটাই, মানুষকে উপেক্ষা, মানুষ শেষমেশ বরদাস্ত করে না। বুক চিতিয়ে দাঁড়ায় দেশের যুবসমাজ। তারাই প্রতিজ্ঞা করে, শেষ দেখে ছাড়বে দুর্নীতির।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, চিন-বান্ধব সরকারের পতনের পর নেপালে খুব শীঘ্রই গড়ে উঠবে এক মার্কিন-বান্ধব সরকার। একেবারে ঠিক বাংলাদেশেরই কায়দাতে। সেপ্টেম্বরের শেষে ভারত সফরে আসার কথা ছিল ওলির। ঠিক এই সময় রাজনৈতিক পালাবদল কার ইঙ্গিতে, প্রশ্ন দেখা দেয় মনে।