পুলক মিত্র
ঠিক সময়ে ভোট হলে, বাংলায় বিধানসভা নির্বাচনের আর মাত্র আট মাস বাকি। সদ্য রাজ্য বিজেপির নতুন সভাপতি হিসেবে দায়িত্বভার নিয়েছেন শমীক ভট্টাচার্য। শমীক দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই যে প্রশ্নটি নিয়ে চর্চা চলছে, তা হল, তিনি কি পারবেন তৃণমূলকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে? উগ্র হিন্দুত্বকে হাতিয়ার করে রাজ্যে প্রধান বিরোধী দল হিসেবে উঠে এসেছে বিজেপি। ৩৪ বছর ধরে রাজ্য শাসন করা সিপিএম বা স্বাধীনতার পর টানা ৩০ বছর (মাঝে কয়েক বছর বাদ দিলে) ক্ষমতায় থাকা কংগ্রেসের আসন সংখ্যা এখন শূন্যে এসে ঠেকেছে। ২০১১ থেকে টানা প্রায় ১৪ বছর ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের আজ প্রধান প্রতিপক্ষ হয়ে উঠেছে বিজেপি।
২০২১-এ বিজেপি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেও, শেষ পর্যন্ত তাদের আসন সংখ্যা ৭৭ ছাড়ায়নি। এবার ২০২৬-এ বিজেপি পারবে কি? হিন্দুরা বিজেপির বরাবরের ভোট ব্যাঙ্ক ঠিকই, কিন্তু মুসলিমরা মুখ ফিরিয়ে থাকলে, শুধুমাত্র হিন্দু ভোটের ওপর ভর করে রাজ্য জয় করা অসম্ভব, তা বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছেন নতুন সভাপতি শমীক ভট্টাচার্য। অর্থাৎ বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী যেভাবে কট্টর হিন্দুত্বকে তুরূপের তাস করতে চাইছেন, শমীক যে সেপথে হাঁটতে নারাজ, তা তাঁর দায়িত্বগ্রহণ অনুষ্ঠানে স্পষ্ট করে দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ’বিজেপির লড়াই সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে নয়। আমরা লড়ছি, আপনাদের জন্য। আমরা চাই আপনাদের বাড়ির ছেলেদের হাত থেকে পাথর কেড়ে বই দিতে। যারা তলোয়ার নিয়েছে, তাদের হাতে কলম ধরিয়ে দিতে চাই। এটাই বিজেপির লড়াই। এটাই আমরা করে দেখাব।”
২০০৪ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি লোকসভা নির্বাচনের মাস দেড়েক আগে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ’আমরা নতুন ভারত তৈরি করতে চাই। আসুন আমাদের সঙ্গে সহযোগিতা করুন। মুসলিমদের সঙ্গে নিয়ে এবার আমরা ভোটে লড়ব।” শমীকের বক্তব্যের মধ্যে অনেকে বাজপেয়ীর ছায়া দেখতে পাচ্ছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। শুরু থেকেই রীতিমতো হিসেব কষে এগোতে চাইছেন চার দশকের পোড় খাওয়া এই রাজনীতিক। ১৯৮০ সালে বিজেপির জন্মলগ্ন থেকেই শমীক দলের সঙ্গে যুক্ত। তার আগে ছাত্র রাজনীতি এবং আরএসএস করেছেন। রয়েছে অসাধারণ বাগ্মিতা। বঙ্গ বিজেপির হিন্দুত্বের ‘পোস্টার বয়’ শুভেন্দু অধিকারী মনে করেন, মুসলিম ভোটারদের প্রয়োজন নেই, শুধুমাত্র হিন্দু ভোট এককাট্টা হলেই ক্ষমতা দখল সম্ভব। কিন্তু বাস্তবে কি তা সম্ভব?
শুভেন্দুর হিসেব অনুযায়ী, ৩৯ শতাংশ ভোট বিজেপির পক্ষে রয়েছে। আর ৫-৬ শতাংশ হিন্দু ভোট একজোট করতে পারলেই, ক্ষমতা দখল সম্ভব। প্রশ্ন হল, বাংলার সব হিন্দু কি বিজেপির পক্ষে? সম্প্রতি সংখ্যালঘু প্রভাবিত কালীগঞ্জ বিধানসভার নির্বাচনে দেখা গেছে, শুধু মুসলিমরাই নন, অনেক হিন্দুও তৃণমূলকে ভোট দিয়েছেন। বিচক্ষণ, বুদ্ধিমান শমীক আন্দাজ করতে পেরেছেন, শুভেন্দু যে সহজ পথে এগোতে চাইছেন, তাতে অঙ্ক মেলানো কঠিন।
তপন সিকদারের যুগ বাদ দিলে, রাজ্যে বিজেপি সবচেয়ে বেশি সাফল্য পেয়েছে ২০১৯-এর লোকসভা (১৮টি আসন) এবং ২০২১-এর বিধানসভা (৭৭টি আসন) নির্বাচনে। দুটি ক্ষেত্রেই সাফল্যের কারিগর হলেন বর্তমানে দলে ব্রাত্য দিলীপ ঘোষ। ২০২৪-এ সুকান্তর জমানায় লোকসভা নির্বাচনে আসন কমে দাঁড়ায় ১২তে। ২০১৯-এ পাওয়া ৪০ শতাংশ ভোট কমে দাঁড়ায় ৩৮.৭৩ শতাংশে। ২০২১ বিধানসভা নির্বাচনে ভোট শতাংশ ছিল ৩৮.১৪ শতাংশ।
দিলীপ ঘোষ হিন্দুত্বের ওপর ভর করে সাফল্য পেয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু ২০২১-এর পর, অর্থাৎ শুভেন্দু বিজেপিতে যোগদানের পর থেকে দেখা যায়, বিজেপি তীব্র মুসলিম বিরোধী অবস্থানও নিয়েছে। শুভেন্দুকে বারবার বলতে শোনা গিয়েছে, যারা আমাদের সঙ্গে নেই, আমরাও তাদের সঙ্গে নেই। কথায় কথায় মুসলিম তোষণ নিয়ে তৃণমূলের বিরুদ্ধে তির্যক মন্তব্যও শোনা গেছে তাঁর মুখে। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিজেপির হিন্দু ভোট ব্যাঙ্কও এখন প্রায় চূড়ান্ত সীমায় পৌঁছে গিয়েছে। তাই ৫-৬ শতাংশ ভোট বাড়ানো অত্যন্ত কঠিন, যা শমীক বুঝতে পেরেছেন। তাই কোনওরকম ভণিতা না করেই সরাসরি মুসলিমদের উদ্দেশে বার্তা দিয়েছেন তিনি।
মুসলিমদের অধিকাংশ ভোটই এতকাল তৃণমূলের দিকে গেলেও, একটানা দীর্ঘকাল ধরে ক্ষমতায় থাকার ফলে একটা অ্যান্টি ইনকামবেন্সি ফ্যাক্টর তৈরি হয়েছে। তাই সংখ্যালঘুদের একাংশও তৃণমূলের দিক থেকে মুখ ফেরাচ্ছে। সাম্প্রতিক একাধিক ঘটনায় তার স্পষ্ট ইঙ্গিত মিলেছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ মনে করছেন, বিক্ষুদ্ধ মুসলিমদের বিজেপি নিজেদের দিকে টানতে পারলে, এই ৫-৬ শতাংশের ব্যবধান দূর করা সম্ভব।
যদিও শমীক বলছেন, শুভেন্দুর সঙ্গে তাঁর অবস্থানের ফারাক নেই। তার ব্যাখাও দিয়েছেন তিনি। বলেছেন, ’শুভেন্দু অধিকারী যা বলছেন আমিও সে কথা বলছি। শব্দচয়ন এবং শরীরি ভাষা একান্তই বক্তার ব্যক্তিগত। হিন্দু ভোট এককাট্টা করার কথা বলছেন শুভেন্দু, আর আমি বলছি, মুসলিমরা যদি ভেবে থাকেন, তাঁদের ভোট ছাড়া পশ্চিমবঙ্গে পরিবর্তন করা যাবে না, তৃণমূলের বিসর্জন হবে না, তাহলে তাঁরা ভুল ভাবছেন। আমাদের ভোট দেওয়ার দরকার নেই। তাও বিজেপি ক্ষমতায় আসবে। সেটাই শুভেন্দু বলছেন।” এরপরই তিনি বলেন, ’আমাদের লড়াই ধর্মান্ধ ইসলামিক ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে।”
২০২১-এ তৃণমূল জয়ী হয়েছিল ২১৩টি আসনে। ভোট শতাংশের হার ছিল ৪৭.৯৪%। আর ৭৭টি আসনে জয়ী বিজেপির ভোটের হার ছিল ৩৮.১৩%। কংগ্রেস-সিপিএম জোট১৮.৬% এবং অন্যান্যরা পেয়েছিল ১৫.৩৩% ভোট। বাংলায় এখন বিজেপির বিধায়ক সংখ্যা ৭৪। ৩টি বিধানসভার (শান্তিপুর, দিনহাটা ও ধূপগুড়ি) উপনির্বাচনে হেরে যায় তারা। কিন্তু গত লোকসভা ভোটে বিধানসভা ভিত্তিক ফল বলছে, রাজ্যের ৯২টি বিধানসভায় বিজেপি এগিয়ে রয়েছে।
গতবারের তুলনায় এবার লোকসভা ভোটে বাংলায় বিজেপির আসন কমলেও, পরিসংখ্যান অনুযায়ী, একুশের বিধানসভা ভোটে বিজেপি এই রাজ্যে যতগুলি আসনে জয়ী হয়েছিল, বিগত লোকসভা ভোটের বিধানসভাভিত্তিক ফল অনুযায়ী, তার চেয়ে বেশি আসনে এগিয়ে আছে বিজেপি। উল্টোদিকে, একুশের বিধানসভা ভোটে তৃণমূল যত আসন পেয়েছিল, এবার লোকসভার ফলের নিরিখে তার চেয়ে কম আসনে এগিয়ে আছে ঘাসফুল শিবির। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটের ফলাফলের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গে ১২১টি বিধানসভা আসনে এগিয়ে ছিল বিজেপি।
গত লোকসভা নির্বাচনে শহরাঞ্চলে বিজেপির ভোটের হার ছিল পেয়েছে ৪০.১ শতাংশ ভোট। আধা শহর এলাকায় তাদের প্রাপ্ত ভোটের হার ছিল ৩৬.৬ শতাংশ। আর গ্রামাঞ্চলে গতবারের থেকে অনেকটা কমে ভোটের হার দাঁড়িয়েছে ৩৫ শতাংশ। এদিকে নিজেদের প্রাপ্ত ভোটের নিরিখে বিজেপির শহুরে ভোট মাত্র ১৬.৭ শতাংশ। এদিকে মফস্বল থেকে বিজেপির ৪৮.৫ শতাংশ ভোট এসেছে। আর গ্রামীণ এলাকার ভোট বিজেপির মোট প্রাপ্ত ভোটের ৩৪.৮ শতাংশ। এদিকে কংগ্রেস শহর এলাকায় ২১.৪ শতাংশ ভোট পেয়েছে। এদিকে তৃণমূলের মোট প্রাপ্ত ভোটের ৬২.২ শতাংশ ভোট এসেছে মফস্বল থেকে।
চব্বিশের লোকসভা নির্বাচনে এই রাজ্যে তৃণমূল পেয়েছে ২ কোটি ৭৫ লক্ষের সামান্য বেশি ভোট পেয়েছিল। আর বিজেপি পেয়েছে ২ কোটি ৩৩ লক্ষের সামান্য বেশি ভোট। গত লোকসভা নির্বাচনে দুই দলের প্রাপ্ত ভোটের পার্থক্য ৪২ লক্ষের মতো। এই ভোটারদের বড় অংশকে নিজেদের দিকে টানাই এখন গেরুয়া শিবিরের কাছে চ্যালেঞ্জ। শুধু হিন্দু ভোট দিয়ে হবে না, চাই মুসলিম ভোটও, এটা শমীক বুঝতে পারছেন। তাই শুভেন্দুর পথে না হেঁটে মুসলিমদের প্রতি তিনি নরমপন্থার নীতি নিয়েছেন।
কিন্তু প্রশ্ন হল, শুভেন্দু কি শমীকের পথে হাঁটবেন? কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর অমিত শাহের হাত রয়েছে তাঁর মাথায়। রাজ্য বিজেপির কোনও নেতাকেই তিনি খুব আমল দেন না। দিলীপ ঘোষের সঙ্গে বারবার সংঘাত হয়েছে। রাজনৈতিক মহলের মতে, লোকসভা নির্বাচনে তাঁর জেতা থেকে আসন থেকে দিলীপকে শুধু সরিয়েই দেননি, সেইসঙ্গে কৌশলী চালে তাঁকে হারিয়েও দিয়েছেন। বিদায়ী সভাপতি সুকান্ত মজুমদারকেও তেমন আমল দিতেন না শুভেন্দু। সুকান্ত ভদ্র, বিচক্ষণ রাজনীতিক, তাই দূরত্ব রেখে চলতেন। এবার শমীকের পালা। তিনি কি পারবেন শুভেন্দুকে সামলাতে? এর উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরও কিছুদিন?