স্বাধীনতার ৭৮ বছর পরেও আমাদের দেশে সব মানুষ কি পেট ভরে খেতে পায়? এ তথ্য আন্তর্জাতিকভাবেই স্বীকৃত যে ভারতে বিশ্বের সবথেকে বেশি ক্ষুধার্ত মানুষের বাস। ধনী রাষ্ট্রগুলির লক্ষ্য একটাই, বাজার দখল করা। এখন ‘বন্ধু’ মোদীর সাহায্যে ভারতের বাজার দখল করতে পরিকল্পনা করেছে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ভারতে মার্কিন পণ্য প্রবেশ করবে, বাজার দখল করবে। কিন্তু তাতে সাধারণ মানুষের কোনও লাভ নেই। ধনীরা আরও ধনী হবে। গরিব আরও গরিব হবে।
পরিসংখ্যান বলছে, ১২৭টি দেশের মধ্যে বিশ্ব খাদূসূচক তালিকায় ভারতের স্থান ১০৫তম। ভারতের মোট জনসংখ্যার ১৩.৭ শতাংশ অপুষ্টির শিকার। ৩৫.৫ শতাংশ শিশু রয়েছে এর মধ্যে। ২.৯ শতাংশ শিশু জন্মের পাঁচ বছরের মধ্যে মারা যায়। ১৭.৪ শতাংশ শিশু জন্মায় কম ওজন নিয়ে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ভারতেই সবচেয়ে বেশি শিশু অপুষ্টির শিকার। ইউনিসেফের তথ্য অনুযায়ী, আমাদের রাজ্যে ২০১৫ সালের হিসাব অনুযায়ী প্রতি ১০০০ শিশুর মধ্যে ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে জন্মের সময়।
তথ্যসূত্রে আরও জানা গিয়েছে ১৪-৪৯ বয়সসীমার মহিলাদের ৫৩ শতাংশ রক্তাল্পতার শিকার। ২০২৪-এর রিপোর্টে বিশ্বজুড়েই সঙ্কটের দিকে নজর টানা হয়্ছে। বলা হয়েছে, বিশ্বে প্রতি ১১ জনের একজন ক্ষুধার সঙ্কটে আক্রান্ত। ভারতে ১৭.৪৪ শতাংশ শিশুর জন্ম হয় কম ওজন নিয়ে, যা বিশ্বে সর্বোচ্চ। এটি মূলত মাতৃ পুষ্টিহীনতার প্রতিফলন। এশিয়ার দেশগুলির মধ্যে ভারতেই সবচেয়ে বেশি নারী (৫৩ শতাংশ) অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতায় ভুগছেন। ৫৪.২ শতাংশ শিশুর মধ্যে রক্তাল্পতা বা অ্যানিমিয়া দেখা যায়। আসলে সমস্যা হলো শর্করা, প্রোটিন, স্নেহজাতীয় দ্রব্যের যে সুষম খাদ্যতালিকা দরকার, তা থাকছে না। প্রয়োজন অনুযায়ী ভিটামিনের অভাব।
অথচ ভারতে খাদ্য সুরক্ষা আইন আছে। রেশন ব্যবস্থা, অঙ্গনওয়াড়ি, মিড ডে মিল প্রকল্প চালু রাখা হয়েছে যার প্রধান উদ্দেশ্য ন্যূনতম পুষ্টি নিশ্চিত করা। বাজেটে অর্থবরাদ্দে তো কাটছাঁট আছেই, ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারের নামেও চলছে বাদ দেওয়া বা এক্সক্লুলেশন। বিশেষত, প্রান্তিক অংশের মধ্যে কোনও সহায়তা না পেয়ে খাদ্যের তীব্র অভাব দেখা যাচ্ছে। যে দেশ জ্ঞান আর দর্শনের আলোয় বিশ্বকে পথ দেখানোর কথা, সেই দ্শেই স্বাধীনতার পর প্রায় আট দশক পেরিয়ে আজও ক্ষুধার কালোছায়া। একবিংশ শতাব্দীর চৌকাঠে দাঁড়িয়েও যখন দেশের শিশুদের ভুখা পেট অপুষ্টিতে ফুলে ওঠে, আর যুবক-যুবতীদের চোখে খাদ্যের বদলে কেবল অন্ধকার, তখন প্রশ্ন জাগে— কেন এই পরিস্থিতি?
দুগ্ধজাত পণ্য, মুরগি, ভুট্টো, সয়াবিন, চাল, গদম, ইথানল, সাইট্রাস ফল, বাদাম, আপেল, আঙুর, টিনজাত পিচ, চকলোট, কুকিজ এবং হিমায়িত ফ্রেঞ্চ ফ্রাই সহ বিস্তৃত পরিসরের আমেরিকান পণ্যের জন্য ভারতকে তার বাজার উন্মুক্ত করতে চাপ দিচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ভারত শুকনো ফল ও আপেলের ক্ষেত্রে আমেরিকাকে ছাড় দিতে রাজি হলেও ভুট্টা, সয়াবিন, গম এবং দুগ্ধজাত পণ্য আমদানির অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে রাজি নয়। কারণ এই সব ভারতের মাটিতেই হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বাজার খুলে দিলে এইসব ক্ষেত্রে কৃষকদের সঙ্কট বাড়বে। তার কারণ প্রযুক্তি ব্যবহার করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে ফসল ফলাতে পারবে, তা প্রযুক্তির অভাবে ভারতের কৃষকরা পারবে না। এর সঙ্গে আছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষিতে বিপুল ভর্তুকি দেওয়া হয়। ফলে অনেক কম দামে কৃষিজাত পণ্য তারা দেশের বাজারে বিক্রি করতে পারে। কৃষকদের সঙ্কট আরও বাড়বে এবং মানুষের মধ্যে অপুষ্টিও বাড়বে।
অর্থনীতিবিদ উৎসা পট্টনায়ক প্রশ্ন তুলেছেন, একদিকে বিশ্বব্যাঙ্ক এবং দেশের সরকার খতিয়ান দিচ্ছে উদার অর্থনীতির তিন দশকে কত কোটি মানুষকে দারিদ্রের বাইরে আনা সম্ভব হয়েছে। অথচ পুষ্টি গ্রহণের তথ্য বিচার করলে দেখা যাচ্ছে শহরে এবং গ্রামে ক্ষুধার মাত্রা বেড়েছে মারাত্মকভাবে। এখানেই প্রশ্ন, দারিদ্র কমলে ক্ষুধা বাড়ছে কী করে, বরং উল্টো ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে যে সময়ে তখনই দরিদ্র মানুষের সংখ্যা কমে যাওয়ার হিসাব দেওয়া হচ্ছে কী করে!
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লুএইচও)-র মান অনুযায়ী ভারতে এবং অন্যান্য দেশে শীর্ষস্থানীয় আন্তর্জাতিক খাদ্য প্রস্তুতকারক সংস্থাগুলির বেশির ভাগ খাদ্যপণ্যই অস্বাস্থ্যকর। এই ধরনের আল্ট্রা প্রসেসড ফুড (অতিরিক্ত প্রক্রিয়াজাত খাবার) বিভিন্ন স্বাস্থ্য সমস্যার কারণ।