স্বপনকুমার মণ্ডল
তারুণ্যের সহজাত স্পর্ধার প্রকাশ ও বিকাশ সময়ান্তরে নিঃস্ব হয়ে পড়ে। শুধু তাই নয়, সেই স্পর্ধা তারুণ্যের হঠকারিতার নিদর্শন হিসাবে যেমন নিন্দিত, তেমনই তার স্বাভাবিকতায় তা নন্দিতও বটে। সেদিক থেকে ব্যক্তিত্ব গড়ে তোলার সোপানে স্পর্ধার ধার ও ভার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। অন্যদিকে স্পর্ধায় আভিজাত্যবোধ যখন প্রকট হয়ে ওঠে, তখন তার আত্মপ্রত্যয় আপনাতেই বেড়ে যায়। আর সেই আত্মপ্রত্যয় থেকে জন্ম নেয় প্রতিস্পর্ধী ব্যক্তিত্ব। তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রকৃতির আত্মপ্রকাশ যেমন সহজতর, তেমনই তার সর্বজনীন আবেদন দুরূহতম। আর সেই কাজটিই নীরবে নিভৃতে অত্যন্ত সংগোপনে সুচারু ভাবে সম্পন্ন করে বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে স্বনামধন্য হয়ে রয়েছেন রবীন্দ্রস্নেহধন্য অনন্যা মৈত্রেয়ী দেবী (০১.০৯.১৯১৪-২৯.০১.১৯৯০)।
এমনিতে তিনি বনেদি ঘরে প্রতিপালিত হয়েছেন, পেয়েছেন বিখ্যাত পিতার সুখ্যাত পরিমণ্ডল। কৈশোরকালেই মিলেছে রবীন্দ্রনাথের স্বীকৃতি ও সমাদর। শুধু তাই নয়, প্রবৃদ্ধ রবীন্দ্রনাথের সান্নিধ্য লাভের দুর্লভ সুযোগে ধন্য হয়ে রবীন্দ্রজীবনীর আকর গ্রন্থের অনন্য নিদর্শন রচনায় নিজেকে মেলে ধরার পরম অবকাশও পেয়েছেন তিনি। সেসব সাফল্যে তাঁর আত্মপ্রতিষ্ঠার পথ যেমন প্রশস্ত হয়েছে, তেমনই তা তাঁর প্রতিস্পর্ধী ব্যক্তিত্বের পক্ষে সোপান হয়ে ওঠে। বিশেষ করে রবীন্দ্রস্নেহধন্য ব্যক্তিত্বের আলোয় মৈত্রেয়ীর প্রতিষ্ঠা ছিল প্রত্যাশিত এবং তা তিনি তাঁর স্বকীয় প্রতিভায় অচিরেই লাভ করেন। শুধু তাই নয়, সেই প্রতিষ্ঠা তাঁর সৃজনবিশ্বের অভিমুখ রবীন্দ্রকেন্দ্রিকতায় আচ্ছাদিত করে রেখেছিল। অথচ সেই প্রতিকূলতাকে প্রতিহত করে তিনি যেভাবে ‘ন হন্যতে’ (১৯৭৪) উপন্যাসটির মাধ্যমে বাংলা সাহিত্যে তাঁর স্বকীয় প্রতিস্পর্ষী অনন্যা প্রকৃতির পরিচয়কে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছেন, তার নজির বাংলা সাহিত্যেই সহজলভ্য নয়। শুধুমাত্র একটি উপন্যাসের মাধ্যমে মৈত্রেয়ী দেবী তাঁর সাহিত্যের অধিকারকে স্বতন্ত্র করে তুলেছেন। অথচ তা করা যেমন সহজসাধ্য ছিল না, তেমনই তাঁর পক্ষে তা ছিল আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। তাতে সামান্য ভুলে তাঁর ব্যক্তিজীবনে তার দীর্ঘস্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব বিস্তারের তীব্র সম্ভাবনা ছিল। অথচ সেই সিদ্ধান্তে সামিল হয়েও তিনি সফলকাম এবং তাঁর পরিচিতির সোপানশীর্ষে উপন্যাসটি আজও বহালতবিয়তে বিরাজমান। বিতর্কের রসদে উপন্যাসটির আবেদনে স্থায়িত্ব ও জনপ্রিয় বলে যাঁরা ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়ার জন্য বাতিকগ্রস্ত, তাঁদের উপেক্ষা করেই রচনাটি বাংলা সাহিত্যের স্থায়ী সম্পদে পরিণত হয়েছে। সময়ান্তরে বিতর্ক অসাড় হয়ে পড়ে, জনপ্রিয়তা নিঃস্ব হয়ে ওঠে। ‘ন হন্যতে’ তা থেকে বাঁচোয়া। আর তার মধ্যে যে কী পরিমাণ প্রতিস্পর্ধী ব্যক্তিত্বের নিবিড় পরিচয় বর্তমান, তা বিস্ময়ের উদ্রেক করে। এজন্য মৈত্রেয়ী দেবীর প্রতিস্পর্ধী জীবনের দিকে ফিরে দেখা আবশ্যক মনে হয়।
স্বামী বিবেকানন্দের কথিত বড় ঘরেই মৈত্রেয়ী জন্মেছিলেন। তাঁর পিতৃপুরুষ ধনে বনেদি না হলেও মানে অভিজাত ছিল। পিতামহ কালীপ্রসন্ন দাশগুপ্তের আর্থিক সচ্ছলতা না থাকলেও স্বকীয় প্রতিভায় ছোটবেলাতেই আলোড়ন সৃষ্টি করে তাঁর বনেদিয়ানাকে প্রতিপন্ন করেছিলেন। তিনি সেই সাত- আট বছরেই ভারতীয় দর্শনসহ সমসাময়িক ঘটনাবলির ব্যাখ্যাবিশ্লেষণের মাধ্যমে আলোচনা সভায় বিস্ময়ের সৃষ্টি করে ‘খোকা ভগবান’-এ অভিহিত হয়েছিলেন। অন্যদিকে মৈত্রেয়ীর পিতা সুরেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত (১৮৮৫-১৯৫২) আন্তর্জাতিক সারস্বত সমাজে স্বনামধন্য উজ্জ্বল ব্যক্তিত্ব। বিশেষ করে সংস্কৃত ও দর্শনে তাঁর স্বাধিকার শ্লাঘার বিষয়। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তাঁর শ্রদ্ধার সম্পর্ক ইতিহাসপ্রসিদ্ধ। মানী পিতার মান্যতাবোধের দ্বারা প্রতিপালিত হওয়ায় মৈত্রেয়ীর মধ্যে ছোটবেলা থেকে মূল্যবোধের মাত্রা আপনাতেই সক্রিয় হয়ে উঠেছে। শিক্ষাশোভন পরিমণ্ডলে বেড়ে ওঠার সুযোগে তাঁর মধ্যেও মান্যতাবোধের চেতনা প্রথমাবধি সচল ছিল। অন্যদিকে মৈত্রেয়ী তাঁর মানী পিতার বিপ্রতীপে তাঁর মাতা হিমানীমাধুরীর (যাঁকে ‘ন হন্যতে’ উৎসর্গ করেছেন।) কোমল ও নিরীহ প্রকৃতি তাঁকে সেই মূল্যবোধে আরও পরিণত করেছে। পিতা-মাতার মধ্যে আপাতভাবে প্রতীয়মান পারস্পরিক বিপরীত চারিত্রিক বিশেষত্ব তাঁর মানসিক গঠনে বিশেষ সহায়ক হয়ে ওঠে । অন্যদিকে সুরেন্দ্রনাথ মৈত্রেয়ীকে স্বকীয় আলোয় বড় করে তুলতে গিয়ে তাঁর মতো করে স্বাধীন সত্তার বিকাশে সহজতর হতে পারেননি। সেদিক থেকে মৈত্রেয়ীর পিতা-মাতা-ভাই-বোনের বড় ঘরটি উদার আকাশের হাতছানির অভাবে ক্রমশ ছোট হয়ে গিয়েছে। পাণ্ডিত্যের রক্ষণশীল মানসিকতা এবং তার একাধিপত্যের খবরদারি তাঁর পক্ষে অচিরেই পীড়াদায়ক হয়ে উঠেছিল। অন্যদিকে সুরেন্দ্রনাথ তাঁর আত্মজার কাব্যচর্চার প্রতি আশাবাদী ছিলেন এবং এজন্য তিনি আত্মশ্লাঘাও অনুভব করতেন। রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে মৈত্রেয়ীর কবি-পরিচিতি প্রদান করার ক্ষেত্রে তাঁর সক্রিয়তা যেভাবে উঠে এসেছে, সেই পরিচিতির উৎকর্ষ বৃদ্ধিতে সেরূপ প্রয়াস লক্ষ করা যায় না। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, মৈত্রেয়ীর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘উদিতা’ (১৯২৯)
শুধু রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা সম্বলিত হয়েই প্রকাশিত হয়নি, সেইসঙ্গে তরুণী কবির যোলো বছরের (১৯৩০) জন্মদিনে তার প্রকাশ অনুষ্ঠানের আয়োজনে সমারোহের ঘটা অনেকের চোখে সুরেন্দ্রনাথের ‘বাড়াবাড়ি’ ঠেকেছিল। অন্যদিকে মৈত্রেয়ীর পরের কাব্য নিয়ে সেরূপ ঘটা আর ঘটেনি। তাঁর বছরছয়েক পরে প্রকাশিত অপর কাব্য ‘চিত্তচ্ছায়া’ (১৯৩৬) নিয়ে অনুষ্ঠানের কোনো বালাই নেই। আসলে ইতিমধ্যে তাঁর সেই ক্রমশ ছোট হয়ে যাওয়া ঘরটির অস্তিত্ব-সংকট নিবিড় হয়ে উঠেছিল। সেবিষয়ে যাওয়ার পূর্বে মৈত্রেয়ীর কাব্যজীবনের পরিসরে তাঁর মানসিক গড়নে রবীন্দ্রনাথের ভূমিকাটি স্পষ্ট করা প্রয়োজন। কেননা পিতার আদর্শিত পথ যখন তাঁর মনের বিকাশে অন্তরায় হয়ে উঠেছিল, তখন তিনি রবীন্দ্রনাথের পরশ পেয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধে ধন্য হয়েছিলেন। আর এই বৈপরীত্যের ভিতে মৈত্রেয়ীর প্রতিস্পর্ধী অনন্যা প্রকৃতি সজীবতা লাভ করে। এজন্য তাঁর পক্ষে রবীন্দ্রসান্নিধ্য ছিল বরাভয় হাতছানির পরম পরশ যাতে ‘মা ভৈঃ চরৈবেতি’র প্রেরণা তাঁকে প্রাণিত করেছে।
ব্যক্তিজীবনে ব্যক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিভার ভূমিকার চেয়ে তার প্রকাশের আধারটি কোনও অংশে কম নয়। বরং অনেকক্ষেত্রে সেই আধারটি প্রতিভার সম্পূরক ভূমিকায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। সেক্ষেত্রে মৈত্রেয়ীর কবিপ্রতিভার সূচনাপর্ব যেভাবে বিকশিত হয়েছিল, তা অচিরেই আধারের অভাবে পরিণতি লাভে অসফল হয়েছে। মৈত্রেয়ী মানী পিতার দৌলতে ছোটবেলা থেকেই রবীন্দ্রনাথের সংস্পর্শে এসেছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই তাতে তাঁর মনের গড়নে মানী পিতার পাশাপাশি নামী রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি সক্রিয় ভূমিকা লালন করেছে। শুধু তাই নয়, পিতারই কন্যা হিসাবে তাঁর রৌদ্রোজ্জ্বলে বিকশিত ব্যক্তিত্বে রবীন্দ্রনাথের শীতল ছায়ার পরশ ক্রমশ প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। সেক্ষেত্রে মৈত্রেয়ীর জীবনে তাঁর পিতার বিপ্রতীপে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি তাঁকে অনেক বেশি প্রশান্তি প্রদান করেছে। তাঁর খরতপ্ত জীবনে রবীন্দ্রনাথে আশ্রয় লাভ করাটা ছিল সময়ের অপেক্ষা মাত্র। কেননা রবীন্দ্রনাথের মধ্যে স্বর্গীয় পরশ অনুভবে তাঁর সংবেদী চিত্ত প্রথম থেকেই সক্রিয় হয়ে উঠেছিল। মৈত্রেয়ী দেবী সেই কথাই তাঁর অপরাহুবেলায় নিবিড় করে তুলেছেন তাঁর ‘স্বর্গের কাছাকাছি’তে (১৯৮১)। তাঁর পিতার দেখনদারির আতিশয্যে কবির কাছে বহুমূল্য কন্যারত্নটির মহার্ঘতা আঁচ করানোর জন্য কবি হিসাবে যেভাবে তাঁকে হাজির করেছেন, সেভাবে তাঁর প্রস্তুতি ছিল না। মৈত্রেয়ীর রবীন্দ্রানুভূতিতে দেখনদারি ছিল না, ছিল বিস্ময়বিমুগ্ধ নয়নে ঈশ্বরানুভূতির পরম পরশ।
এজন্য পিতার নির্দেশ মতো কবিতা শুনিয়েছেন মাত্র, নিজে থেকে যেচে কবিতা শোনানোর পক্ষপাতী ছিলেন না তিনি। কৈশোরেই তাঁর কবিপ্রতিভার সহজতা রবীন্দ্রনাথকে মুগ্ধ করেছিল। ১৩৩৪-এর ২৭ অগ্রহায়ণে লেখা চিঠিতে কবিগুরু তাঁকে জানিয়েছেন, ‘চিঠির ভিতরে গাছের যে কবিতাটি লিখেছ সেটি সুন্দর হয়েচে—ওই ছাতিমে ভাবী কালে যে ফুলের মঞ্জরী ধরবে তোমার কবিতাটুকুর মধ্যে এখনি তার গন্ধ পাচ্চি।’ সেই ‘গন্ধ’-এর সৌরভ বছরদুয়েক পরেই ছড়িয়ে পড়ে। ‘কল্লোল’-এর সপ্তম বর্ষের চতুর্থ সংখ্যায় (শ্রাবণ ১৩৩৬) কিশোরী মৈত্রেয়ীর ‘লেখাপড়া’ কবিতাটি প্রকাশিত হয়। আবার সেবছর তাঁর কাব্য ‘উদিতা’র আত্মপ্রকাশ ঘটে। অথচ সেই ‘উদিতা’র ঘটার ছটা বেশিদুর পৌঁছাতে পারেনি। আর তা না পারাটাও ছিল স্বাভাবিক। সেই স্বাভাবিকতার অনুষঙ্গে প্রবেশ করার পূর্বে মৈত্রেয়ীর রবীন্দ্রনাথে পৌঁছানোর সক্রিয়তার বিষয়টি আপনাতেই চলে আসে। পিতার পণ্ডিতগর্বী আত্মাভিমানী প্রকৃতিতে তাঁর স্বস্তিবোধ না মেলার প্রতিকূলে রবীন্দ্রনাথের দিব্যকান্তি ভাবমূর্তি তাঁকে আলোড়িত করেছিল। এজন্য সুরেন্দ্রনাথের প্রদর্শনী মানসিকতাকে তিনি মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। কবির মহানুভবতাকে পাথেয় করে তাঁর কবিসত্তার বিকাশ-উন্মুখ প্রকৃতি যেভাবে সজীবতা লাভ করেছিল, তাতে তার পরিণতিতে প্রতিকূলতা নেমে এলেও ষোড়শী কবির মানসগঠনে স্থায়ী প্রভাব বিস্তারের সহায়ক হয়ে ওঠে।
আসলে মৈত্রেয়ী তাঁর সংবেদী কবিচিত্তে রবীন্দ্রনাথকে ক্রমশ যত কাছ থেকে পরখ করার সুযোগ পেয়েছেন, ততই তাঁর প্রবল ব্যক্তিত্বের অপরাজেয় প্রকৃতিতে জীবনসংগ্রামে আত্মপ্রত্যয় লাভ করেছেন। সেদিক থেকে তাঁর জীবনে রবীন্দ্রনাথের স্থিতি ঠিক পিতার বিপ্রতীপে নয়, বরং মানসিক আশ্রয়ের আধারে। রবীন্দ্রনাথের প্রতি তাঁর কন্যার আকর্ষণবোধ বিষয়ে সুরেন্দ্রনাথও সচেতন ছিলেন। অন্যদিকে মৈত্রেয়ী যত রবীন্দ্রনাথের কাছে এসেছেন, ততই তাঁর সাধারণ্যের দূরত্বকে গভীর ভাবে অনুভব করেছেন। পিতার শুষ্ক পাণ্ডিত্যের প্রবল প্রতাপের প্রদাহের চেয়ে কবির সহৃদয় প্রশান্তির পরশ তাঁকে স্বাভাবিকভাবেই আপন করে নিয়েছিল।
এজন্য আজীবন তিনি রবীন্দ্রনাথকে আঁকড়ে ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনের তিক্ত অভিজ্ঞতা তাঁকে অস্থির করেছে ঠিকই, কিন্তু অনায়াসেই সেই টাল সামলে উঠতে পেরেছিলেন। জীবন গড়ার ভিতে রবীন্দ্রনাথে আশ্রয়প্রাপ্তিই তাঁকে বাড়তি অক্সিজেন জুগিয়েছিল। সেদিক থেকে মৈত্রেয়ী প্রতিস্পর্ধী ব্যক্তিত্বে রবীন্দ্রনাথের ছাঁয়ার কায়াটিকে সর্বদা শ্রদ্ধায় স্মরণে বরণ করে নিয়েছেন। অথচ অনায়াসেই তিনি তা থেকে বিরত থেকে স্বকীয় ব্যক্তিত্বের মৌলিকতাকে প্রদর্শন করে আরও বেশি স্বনামধন্য হওয়ার প্রয়াসে ব্রতী হতে পারতেন। কিন্তু তা তিনি করেননি। এখানেও তাঁর সেই প্রতিস্পর্ধী মানসিকতা কতটা কঠিন ও কঠোর, তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়।
একদিকে স্বীকৃতি প্রদানে ব্যক্তিত্বের ঘাটতি প্রকট হয়ে ওঠে, অন্যদিকে অস্বীকারের মাত্রায় সত্যের অপলাপের ভয় বর্তমান। অথচ তারপরেও মৈত্রেয়ী দেবী রবীন্দ্রময় অস্তিত্বকে নিয়েই তাঁর পথচলায় আজীবন সক্রিয় ছিলেন, ভাবা যায়! সেখানে তাঁর হীনমন্যতার লেশমাত্র নেই, আছে স্বীকারের প্রশান্তি অনুভব ও গৌরবান্বিত জীবনানুভূতি। যেখানে অস্বীকারের মাত্রায় প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্তির সদর দরজা উন্মুক্ত হয়ে পড়ে, সেখানে সেই সদরে না গিয়ে অন্দরে থেকেই তার স্বীকারের পরাকাষ্ঠায় জীবনধন্য করার সৎসাহস অর্জন করা সহজসাধ্য নয়। অথচ মৈত্রেয়ী দেবী তাঁর প্রতিস্পর্ধী প্রকৃতিতে তাই সহজ করে দেখিয়েছেন। তাঁর জনপ্রিয়তার নিরিখে ‘মংপুতে রবীন্দ্রনাথ’ (১৯৪৩) থেকে ‘স্বর্গের কাছাকাছি’ সবেতেই রবীন্দ্রনাথের স্নেহধন্য ব্যক্তিত্বের জীবনধন্য প্রকৃতি বিরাজিত। শুধু তাই নয়, তাঁর সাড়া জাগানো আত্মজৈবনিক উপন্যাস ‘ন হন্যতে’ও (১৯৭৪) রবীন্দ্রাবর্তে নিজেকে মেলে ধরেছেন। উপন্যাসটির ভূমিকাতেই সত্যের প্রতি দায়বদ্ধতায় তাঁর দ্বিধাহীন স্বীকৃতি প্রতীয়মান, ‘কোনো কাল্পনিক নাম ব্যবহার করে সেই যুগটি আমার কাছে সত্য হচ্ছিল না।’ অর্থাৎ উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রেও মৈত্রেয়ী তাঁর জীবনে অসমবয়সী সখাকে শুধু স্বীকৃতিই দেননি, তাঁকে জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত করে তুলেছেন। তাঁর এরূপ নিজের সঙ্গে নিজের লড়াই-এর প্রতিস্পর্ধী মানসিকতা রবীন্দ্রনাথের আশ্রয়েই গড়ে উঠেছিল। তাঁর সেই মানসিকতা অচিরেই তাঁকে প্রতিষ্ঠার পথে অগ্রসর করে দিয়েছে।