প্রবীর সরকার
ঝরনা-পাহাড়ে ঘেরা মহুয়া-পলাশের পুরুলিয়াকে বাঙালি ট্যুরিস্ট আবিষ্কার করেছে এই সেদিন। উনিশ শতকে কলকাতার হাওয়া-বদলু ড্যাঞ্চিবাবুদের ‘পশ্চিম’-এর তালিকায় মানভূম ছিল না। বিহারের সেই মানভূম ভেঙে পশ্চিমবঙ্গের নতুন জেলা পুরুলিয়ার নবজন্ম হলো ১ নভেম্বর ১৯৫৬ সালে। নেই এর তালিকা এখানে বেশ বড়, কিন্তু যা ‘ছিল’ তাও খুব সামান্য নয়। ল্যাটেরাইট মৃত্তিকায় গড়া এ ভূখণ্ড ছৌ-ঝুমুরের দেশ, আদিম সংস্কৃতির পীঠস্থান। পাশাপাশি ১০০ বছর আগে “মুক্তি” নামে ছোট একটা সংবাদপত্র ছিল পুরুলিয়াতে, সত্যাগ্রহীদের একটি ‘কমিউন’ গড়ে উঠেছিল ‘শিল্পাশ্রম’ নামে। কংগ্রেস ভেঙে একটা রাজনৈতিক দল হয়েছিল ‘লোকসেবক সংঘ’ নামে। মাতৃভাষায় দিনযাপনের অধিকারের জন্য একটি পত্রিকার লড়াই, সংসদীয় রীতিতে আস্থা রেখে একটি রাজনৈতিক দলের অহিংস আন্দোলন, পুরুলিয়ার বঙ্গভূক্তির লড়াই, দক্ষিণপন্থী রাজনীতির পাশে বামপন্থী আদর্শের সহাবস্থান— সবই কেমন আবছা লাগে এখনকার ঘোলাটে সময়ে।
বাংলাভাষী মানভূম ১৯১১ সালের ১২ই ডিসেম্বর রাজা পঞ্চম জর্জের দিল্লি ঘোষণায় ঠাঁই পেল বিহার-ওড়িশার প্রশাসনিক সীমায়। কার্জনের বঙ্গভঙ্গের প্রস্তাব বাতিল হলো বটে, কিন্তু আরও সূক্ষ্ম কৌশলে এবার বাংলা হলো তিন টুকরো – বঙ্গ প্রদেশ, আসাম প্রদেশ, বিহার ও ওড়িশা প্রদেশ। অথচ তার বিরুদ্ধে এবার আর কোনও বৃহত্তর ‘বঙ্গভঙ্গ’ আন্দোলন হলো না, এবার আর গাওয়া হলো না ‘বাংলার মাটি বাংলার জল’। অথচ ১৯০৫ সালে আলোড়ন তোলা বাংলার রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ আর অরবিন্দ বাদে প্রায় সকলেই তখন দীপ্তিমান। নরমে-চরমে চলতে থাকা বিপ্লব আন্দোলনও গতিময়, কেবল আড়ালে রয়ে গেল এই নতুন বঙ্গব্যবচ্ছেদের যন্ত্রণা।
আন্দোলন হলো দূরপ্রান্তের মানভূমে, কলকাতার নগর-চক্ষুর খানিক আড়ালে। স্বাধীন দেশে বৃহত্তর পুরুলিয়ার বঙ্গজীবনে ওই বঙ্গবিচ্ছেদ কেবল হৃদয়ে আঘাত করেনি, অন্নবস্ত্রেও হাত দিয়েছিল। হিন্দি না জানলে সরকারি স্কুলের মাস্টারদের চাকরি হারাতে হচ্ছিল, জমির দলিল হিন্দিতে লিখতে না পেরে কর্মহীন হয়েছিলেন অনেকে। সমস্ত সরকারি প্রতিষ্ঠানে হিন্দির আগ্রাসনে বাংলাভাষীরা পরিণত হয়েছিল দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে। তারই প্রতিবাদ করেছে ‘মুক্তি’ পত্রিকা এবং ‘লোকসেবক সঙ্ঘ’। পাশে দাঁড়িয়েছিল দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জনের ভাই ব্যারিস্টার পি.আর. দাশের নেতৃত্বে গড়ে ওঠা ‘মানভূম বাঙালি সমিতি’। গোড়ায় পরাধীনতার গ্লানি, পরে প্রাদেশিক আধিপত্য, এসবের বিরুদ্ধে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিলেন কয়েকজন অখ্যাত বঙ্গসন্তান। তাঁদেরই একজন নিবারণচন্দ্র দাসগুপ্ত, যাঁকে ‘খাঁটি মানুষ’ বলেছিলেন সুভাষচন্দ্র। গান্ধিজি বলেছেন হরিজনের পরম বন্ধু। পরবর্তীকালে মানভূমের বঙ্গভূক্তির লড়াই, বাংলা ভাষার জন্য ‘লং মার্চ’ – এসবেরও বীজ বপন করে গিয়েছিলেন এই নিবারণচন্দ্রই।
প্রাচীন ঝারিখণ্ড বা একালের জঙ্গলমহলে একাধিক আদিবাসী আন্দোলন হয়েছিল ব্রিটিশের বিরুদ্ধে। এবার হলো গান্ধিজির ছায়ায়। ততদিনে অসহযোগ আন্দোলনের ঢেউ এসে লেগেছে পুরুলিয়াতেও। সত্যাগ্রহে উত্তাল হয়ে উঠেছে সারা দেশ। দলে দলে ছাত্র-শিক্ষক, সরকারি কর্মী, উকিল-ডাক্তার, নানা বর্গের মানুষ ব্রিটিশের সংস্রব ও পেশাজগৎ ত্যাগ করছেন। পিছিয়ে ছিল না পুরুলিয়াও, জেলা স্কুলের সর্বজন শ্রদ্ধেয় প্রধান শিক্ষক হয়েও ১৯২২ সালে সরকারি চাকরিতে ইস্তফা দিলেন নিবারণচন্দ্র। ছাড়লেন ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া অনারারি ম্যাজিস্ট্রেটের পদ। এমনকি সরকার প্রদত্ত ‘আংশিক’ অবসরকালীন ভাতাও প্রত্যাখ্যান করলেন সম্বলহীন এই ‘ঋষি’। ১৯২৫-এর জানুয়ারিতে পুরুলিয়ায় অনুষ্ঠিত বিহার প্রদেশ কংগ্রেসের ষোড়শ সম্মেলনে যোগ দিতে শহরে এলেন মহাত্মা গান্ধি। ছয়দিন রইলেন পুরুলিয়ার শিল্পাশ্রমে। শিল্পাশ্রমের তখনকার ঠিকানা শহরের উত্তর প্রান্তে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের বাগানবাড়ি ‘রিট্রিট’। এই সম্মেলনে গঠিত হয়েছিল মানভূম জেলা কংগ্রেস কমিটি, মহাত্মাজির উপস্থিতিতে তার সভাপতি নির্বাচিত হলেন নিবারণচন্দ্র দাসগুপ্ত এবং সম্পাদক হলেন অতুলচন্দ্র ঘোষ। এই সম্মেলনেই গান্ধিজি বললেন, মানুষের কাছে দেশের কথা এবং স্বাধীনতার আকাঙ্খা পৌঁছে দেবার জন্য একটি মুখপত্র থাকা দরকার। তাঁরই আগ্রহে জনগণের চাঁদায় কেনা হল ছোট একটি ছাপাখানা, সেই ‘দেশবন্ধু’ প্রেস থেকে (২১শে ডিসেম্বর ১৯২৫) শুরু হলো সাপ্তাহিক ‘মুক্তি’র পথচলা।
‘শিল্পাশ্রম’ই মুক্তির স্থায়ী ঠিকানা, পুরুলিয়া স্টেশনপ্রান্তে খানিকটা জমি, একটু আশ্রয়। দেশীয় শিল্প প্রসারের জন্য নিবারণচন্দ্র সেখানেই গড়ে তুললেন দেশলাই কারখানা। শিল্পাশ্রমের সেই আশ্চর্য কমিউনিটি লাইফে মাঝে মাঝেই আশ্রয় নিতেন পলাতক বিপ্লবীরা। ইতিমধ্যে ওকালতি ছেড়ে স্ত্রী লাবণ্যপ্রভা, পুত্র অরুণচন্দ্রকে নিয়ে নিবারণচন্দ্রের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন অতুলচন্দ্র ঘোষ।
দক্ষিণপন্থী কৃচ্ছ্বতার সাধনায় গান্ধিজির ধ্বজা উড়ল মানভূমে। আবার তারই পাশাপাশি রুশ বিপ্লবের সাফল্য, সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা, মানবেন্দ্রনাথ রায়ের ক্ষণিক উপস্থিতি কেমন যেন নাড়িয়ে দিয়ে যেত মানুষগুলিকে। পরে এদের কেউ কেউ বরণ করেছিলেন কমিউনিস্ট আদর্শ, সংসদীয় গণতন্ত্র। কেউ আবার শ্রমিক আন্দোলনেই জীবন ব্যয় করেছেন। যেমন বীর রাঘব আচারিয়া, আসানসোল-ধানবাদ অঞ্চলের কয়লাখনির শ্রমিক নেতা। ১৯৬১ সালে ভারত সরকার খনির উৎপাদন বৃদ্ধি ও আনুষঙ্গিক বিষয় পর্যবেক্ষণের জন্য একটি প্রতিনিধিদল পাঠায় রাশিয়া, পোল্যাণ্ড, চেকশ্লোভাকিয়ায়। ৯ জনের সেই দলের নেতৃত্বে ছিলেন বীর রাঘব আচারিয়া।
বিশ্বের নানা প্রান্তের কৃষক শ্রমিক সর্বহারাদের কথা তুলে ধরতো মুক্তি। একাধিক সম্পাদকীয় লেখা হচ্ছে রুশ বিল্পবের সাফল্য নিয়ে। নিবারণচন্দ্র নিজে লিখেছেন ‘সব সমানের দেশ’ নামে কবিতা। তাই গোড়া থেকেই ব্রিটিশের শ্যেনদৃষ্টি ছিল এ পত্রিকার উপরে। ‘বিপ্লব’ শীর্ষক রাষ্ট্রবিরোধী সম্পাদকয়ীয় লেখার অভিযোগে তিন বছরের মাথায় কারাগারে গেলেন নিবারণচন্দ্র।
কোনো মিডিয়া হাউস, ধর্মীয় সংগঠন বা বাণিজ্যিক আনুকূল্য ছিল না ‘মুক্তি’র পেছনে, ফলে আর্থিক স্বচ্ছলতা নেই। কিছু বিজ্ঞাপন, পাঠক আর মানভূমবাসীর আগ্রহ সম্বল করে আন্তর্জাতিক খবর, প্রাদেশিক খবরের পাশে বৃহত্তর পুরুলিয়ার গ্রামগঞ্জের খবর ছাপতো মুক্তি। প্রকাশ করতো বিশেষ সংখ্যা। বিপ্লবীদের জীবনী, ধারাবাহিক প্রবন্ধ, নাটক, কবিতা, গান, গল্প, স্মৃতিকথা, পাঠকের চিঠি ইত্যাদি নিয়ে ‘ট্যাবলয়েড’ আকারের হয়েও মনোধর্মে ট্যাবলয়েড ছিল না ‘মুক্তি’। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল এর সম্পাদকীয় নিবন্ধ আর স্বাধীনতা আন্দোলনের খবরগুলি। প্রথম সংখ্যার সম্পাদকীয় থেকে কিছুটা উদ্ধৃত করি,“বন্ধন দশায় মুক্তির কথা ছাড়া আর কি বলিবার আছে। পরাধীন দেশে স্বাধীনতার চেষ্টা ব্যতিত আর কি করিবার আছে?… শৃঙ্খালাবদ্ধ জননীর বন্ধন মুক্তির চিন্তা ব্যতিত সন্তানের হৃদয়ে আর কি ভাবনা স্থান লাভ করিবে? ইহাই আমাদের মুক্তির কল্পনা। সালোক্য, সাযুজ্য প্রভৃতি শাস্ত্রোক্ত মুক্তির কথা ভাবিবার এখন সময় নাই।”
‘মুক্তি’র সুর বেঁধে দিয়েছিলেন নিবারণচন্দ্র দাসগুপ্ত, পরবর্তী সম্পদকরাও (বীর রাঘব আচারিয়া, ফণীন্দ্রনাথ দাসগুপ্ত, অতুলচন্দ্র ঘোষ, বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত, অরুণচন্দ্র ঘোষ, চিত্তভূষণ দাসগুপ্ত) সেই সুরে সুর মিলিয়েছেন। অতুলচন্দ্র ঘোষের মৃত্যুর পরে শিল্পাশ্রম পরিচালনা করতেন রবীন্দ্রনাথের গৃহশিক্ষক অঘোরচন্দ্র ঘোষের কন্যা লাবণ্যপ্রভা ঘোষ। কোনও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা তাঁর ছিল না, মুক্তির সম্পাদকও ছিলেন না, কিন্তু প্রথম সংখ্যা থেকেই প্রবন্ধ লিখেছেন এবং স্বাধীন ভারতে জরুরি অবস্থার সময়ে ‘১লা শ্রাবণের অশ্রুধারা’ নামে প্রবন্ধ লিখে ভারতরক্ষা আইনে জেল খেটেছেন।
১৯২৫ থেকে বর্তমান শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত ‘মুক্তি’ প্রকাশিত হয়েছে। শেষের দিকে অনিয়মিত। নানা সময়ে প্রশাসনিক কারণে বারে বারে ব্যাহত হয়েছিল মুক্তির প্রকাশ। ১৯৩০-এ প্রেস অ্যাক্ট, ১৯৪২-এ ভারত ছাড় আন্দোলনের সময় নিষিদ্ধ হওয়া ছাড়াও ১৯৪০-এ ব্যাক্তিগত সত্যাগ্রহে পরিচালকরা সকলেই জেলে ছিলেন বলে পত্রিকা প্রকাশিত হয় নি। গান্ধিজি ছাড়াও সর্বভারতীয় কংগ্রেসের অনেকে ‘মুক্তি’র খবর জানতেন, নানা সময়ে বার্তা পাঠিয়েছেন জওহরলাল নেহেরু, বল্লভভাই প্যাটেল, বাল গঙ্গাধর তিলক, যমুনালাল বাজাজ, মহাদেব দেশাই, রাজেন্দ্রপ্রসাদের মতো নেতারা। কিন্তু মুক্তি বাস্তবে ছিল সাধারণ মানুষের পত্রিকা। এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে ১৯২৬ সালে অর্ধ সাপ্তাহিক আনন্দবাজার পত্রিকা তার পাঠক বৃদ্ধির জন্য কমপক্ষে দশ বার বিজ্ঞাপন দিয়েছিল ‘মুক্তি’তে।
পরাধীনতা থেকে দেশের মুক্তি আর আঞ্চলিকতা থেকে মানভূমের মুক্তি – এই ছিল ‘মুক্তি’র সাধনা। বস্তুত ঢাকার ভূমিপুত্র নিবারণচন্দ্র, বর্ধমানের ভূমিপুত্র অতুলচন্দ্র ঘোষের কাছে মানভূম ছিল আপন দেশ। এ অঞ্চলে ভাষা ও জাতিপরিচয়ে বিচিত্র এক সমীকরণ কাজ করে, যা স্পষ্ট বোঝা যায় একালের ভোটের ময়দানে। কিন্তু ১০০ বছর আগে কোন অলৌকিক মায়ায় সে ক্লিন্নতা দূর হয়েছিল ভাবলে অবাক হতে হয়। ‘মুক্তি’র দু’টি যুগ, একটি প্রাক-স্বাধীনতা পর্বের, অন্যটি উত্তর-স্বাধীনতা পর্বের। প্রথম যুগে দেশের মুক্তিসাধনা, সত্যাগ্রহ, অসহযোগ, বিলাতি বর্জন ইত্যাদির মধ্য দিয়ে বাংলা-বিহারের সীমান্ত অঞ্চলের (একালে যাকে বলে জঙ্গলমহল) অনেকটা জুড়ে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা পেয়েছে এই ‘মুক্তি’ পত্রিকার ছায়ায়। দ্বিতীয় পর্বে আবার সেই কংগ্রেসরই বিরোধিতা। এবার স্বাধীন ভারতে বঙ্গভাষার মর্যাদা রক্ষা আর বাঙালিস্থান গড়ার লড়াই। মানভূম জেলা কংগ্রেসে ভাঙন, লোকসেবক সংঘের উত্থান, মানভূম বাঙালি সমিতির সক্রিয়তা – সবই হয়েছে ‘মুক্তি’কে ঘিরে। ১ লা নভেম্বর ১৯৫৬, খণ্ড মানভূম ‘পুরুলিয়া জেলা’ হয়ে ৪৪ বছর পরে আবার ঠাঁই পেল বঙ্গসীমায়। দীর্ঘ সেই ভাষা আন্দোলন, টুসু সত্যাগ্রহ, বাংলা ভাষার জন্য একমাত্র ‘লং মার্চ’ – সব ছবি ধরে রেখেছে সময়কে পরাস্ত করা ১০০ বছর আগের ‘মুক্তি’।