প্রতিবাদের পথে লাদাখ

সোনম ওয়াংচুক

ক্ষোভে ফুঁসছে লাদাখ। জম্মু ও কাশ্মীরকে রাজ্যের মর্যাদা দেওয়ার পর লাদাখকেও রাজ্যের মর্যাদা দেওয়া হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কেন্দ্র। কিন্তু টানা তিন বছর ধরে লাদাখের রাজ্য মর্যাদার দাবির প্রতি কেন্দ্রের বিজেপি সরকার কর্ণপাত করেনি। লাদাখের বিভিন্ন গণতান্ত্রিক সংগঠনগুলির সঙ্গে অর্থপূর্ণ আলোচনায় বসতে চায়নি কেন্দ্র। বহুদিন ধরেই সরকারের বঞ্চনা ও প্রতারণার শিকার হয়েছেন এই অঞ্চলের মানুষ। তাঁদের মধ্যে যে ব্যাপক পরিমাণ ক্ষোভ জমেছে, তারই বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে লে, লাদাখ ও কার্গিলের একের পর এক শহর। পুলিশ প্রশাসনের বেপরোয়া মারধর ও ধরপাকড় শুরু হয়ে যায়। প্রশাসনের বেপরোয়া হামলায় চারজনের মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। বহু মানুষ আহত হন।

গত ছয় বছর ধরে লাদাখের মানুষ পূর্ণ রাজ্যের স্বীকৃতি, পূর্ণ ক্ষমতাসম্পন্ন বিধানসভা ও সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলে এই অঞ্চলের অন্তর্ভূক্তির দাবি জানিয়ে এসেছে। এর মাধ্যমে এই অঞ্চলের জনগণ সাংবিধানিক সুরক্ষা ও উত্তর-পূর্ব ভারতের বহু রাজ্যের মতো প্রাপ্ত সুবিধা লাভ করতে পারবে। কেন্দ্রের বিজেপি সরকার ধারাবাহিকভাবে লাদাখের সাধারণ মানুষকে এইসব যাবতীয় অধিকার দিতে অস্বীকার করে গিয়েছে।
কেন্দ্রীয় সরকারের নির্লজ্জ উদাসীনতা, জনসাধারণের ন্যায্য দাবি উপেক্ষা করা এবং গত তিন বছরে একাধিক পর্যায়ের আলোচনায় সাড়া না দেওয়ায় ক্ষুব্ধ লেহ অ্যাপেক্স বডি ও অন্যান্য সংগঠন শান্তিপূর্ণ অনশন শুরু করে। ১৫ দিন ধরে তা চলে। অর্থপূর্ণ আলোচনায় অংশগ্রহণ না করে কেন্দ্রীয় সরকার অনশনকারীদের গ্রেপ্তার করে। বল প্রয়োগের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ দমন করে। এর ফলে সমগ্র অঞ্চলে গণবিক্ষোভ ও অস্থিরতা তৈরি হয়। শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের পরিবেশকে প্রশাসনিক দমনের মাধ্যমে নস্যাৎ করে কেন্দ্রীয় সরকার এখন উল্টে বিক্ষোভকারীদের দোষারোপ করছে।

প্রকিৃতির নিজের হাতে সাজানো লাদাখ এতদিন পর্যন্ত দেশের অন্যতম শান্তির অঞ্চল ছিল। সেই শান্তিপূর্ণ লাদাখই জ্বলে উঠেছে অশান্তি আর হিংসার আগুনে। লাদাখের রাজধানী লে শহরে যুব সমাজের (সম্প্রতি যাঁদের বলা হচ্ছে জেনারেশন জেড) প্রবল বিক্ষোভের জেরে পুলিশ ও আধা সামরিক বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘাত রণক্ষেত্রের চেহারা নেয়। বিক্ষোভ দমনে পুলিশ প্রথমে টিয়ার গ্যাস এবং পরে সরাসরি গুলি চালায়। তাতে চারজনের মৃত্যু ঘটে। জখম-আহতের সংখ্যা শতাধিক। এঁদের অনেকেই গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। শান্তিপূর্ণ মিছিল, সমাবেশ লাদাখ বরাবর দেখে এসেছে, কিন্তু সেটা এমন হিংসাত্মক হয়ে ওঠা সম্ভবত এটাই প্রথম। তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হলো এই বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ ছিল মূলত অল্পবয়সী যুবকদের, যাঁদের বেশিরভাগই কর্মহীন বেকার। যুব সমাজের অংশগ্রহণে এমন বিক্ষোভ মনে করিয়ে দিচ্ছে সাম্প্রতিক নেপালের ঘটনাকে। সেখানে যুব সমাজের প্রবল বিক্ষোভের জেরে ওলি সরকারের পতন অনিবার্য হয়ে ওঠে।


মোদী জমানায় এমন অশান্তি চলছে মণিপুরেও গত তিন বছর ধরে। সেখানেও নির্বাচিত বিজেপি সরকার ভেঙে দিয়ে রাষ্ট্রপতি শাসন চালু করতে বাধ্য হয়েছে কেন্দ্র। আরএসএস-বিজেপির সুবিধাবাদী নীতি ও বিভাজনের রাজনীতি মণিপুরকে জাতিগত, ধর্মগত ও সংস্কৃতিগতভাবে কার্যত দু’ভাগে ভাগ করে দিয়েছে। কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের ডবল ইঞ্জিনের অপদার্থতায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ায় প্রধানমন্ত্রী মোদী গত তিন বছর মণিপুরমুখী হননি। এখন লাদাখের ঘটনা মণিপুরের স্মৃতিকে উস্কে দিচ্ছে। তাছাড়া নানা মহলে এখন আলোচনায় উঠে আসছে জনরোষে শ্রীলঙ্কা সরকারের পতন এবং বাংলাদেশ সরকারের পতনের ঘটনা।

২০১৯ সালে সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল করে জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেওয়ার পাশাপাশি পূর্ণাঙ্গ রাজ্যকে দু’টুকরো করে দু’টি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল জম্মু-কাশ্মীর এবং লাদাখ গঠন করে কেন্দ্রীয় সরকার। প্রাথমিকভাবে জম্মু-কাশ্মীর থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বতন্ত্র অঞ্চল গঠনে লাদাখের মানুষ খুশিই হয়েছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় শাসনে তাঁরা ক্রমশ উপলব্ধি করতে থাকেন লাদাখ শাসনে ও লাদাখের উন্নয়নে লাদাখবাসীর ভূমিকা কার্যত শূন্য হয়ে গিয়েছে। রাজ্যপালের মাধ্যমে লাদাখ শাসিত হচ্ছে দিল্লি থেকে।

আবার বিশেষ সাংবিধানিক অধিকার চলে যাওয়ার ফলে লাদাখের জমি, প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদের উপর লাদাখের মানুষের অধিকার বা নিয়ন্ত্রণ থাকছে না। সেটা চলে যেতে বসেছে বেসরকারি কর্পোরেটের হাতে। বাইরের মানুষের আগমনে জনবিন্যাস বদলে যাচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে দাবি ওঠে, লাদাখের প্রকৃতি ও পরিবেশের সুরক্ষা, জনজাতির স্বাতন্ত্র্য সুরক্ষার। লাদাখকে পূর্ণ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়ার দাবি আরও গুরুত্ব পেতে থাকে। দিল্লি থেকে নয়, লাদাখ রাজ্য পরিচালিত হবে লে থেকে, লাদাখের মানুষের নির্বাচিত সরকার দ্বারা। সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের অন্তর্ভুক্ত করা, বেকারত্বের সংকট সামাল দিতে পৃথক পাবলিক সার্ভিস কমিশন গঠন করা, লে এবং কার্গিলের জন্য দু’টি লোকসভা কেন্দ্র গঠনের দাবি ওঠে। এই দাবিগুলিকে সামনে রেখেই লাদাখে আন্দোলন আরও তীব্র হয়েছে। দীর্ঘ ছ’বছর ধরে এই আন্দোলনে কেন্দ্র নজর না দেওয়াতে তৈরি হয়েছে তীব্র হতাশা। আর সেই হতাশা থেকেই আন্দোলনে বেপরোয়া মনোভাবের প্রকাশ। মোদী-শাহের ঘুম কতদিনে ভাঙবে?