প্রবীর মজুমদার
১৯৬৭ থেকে ১৯৮৯ সালের রেকর্ড অনুযায়ী কলকাতায় গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১৬৫০ মিমি। এটিও লক্ষ্য করা গিয়েছে যে, একদিনে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ মাঝেমধ্যে ২০০ মিমি ছাড়িয়ে যেতে পারে। ১৯৭৮, ১৯৮৪, ১৯৮৬ এবং ১৯৯৯ সালে আনুমানিক পরপর তিন দিনে মোট বৃষ্টিপাত যথাক্রমে ৫৫৪.৭৫ মিমি, ৪৯৯.২৫ মিমি, ৪৪৩.০০ মিমি এবং ৩৩৪.১০ মিমি পর্যন্ত। যেখানে গৃহীত নিষ্কাশন সূচক প্রতিদিন ৭৫ মিমি থেকে ১৫০ মিমি পর্যন্ত পরিবর্তিত হয়।
কলকাতার পথঘাট কেবল বর্ষাকালে নয়, উনিশ শতকের গোড়ায় ভেসে যেত গঙ্গায় বান এলেও। সে জল জমে থাকত কয়েক সপ্তাহ ধরে, নিকাশির অভাবে। কলকাতার নিকাশি ব্যবস্থা গঙ্গামুখী হওয়ার ত্রুটিটা প্রথম নজরে আসে লর্ড ওয়েলেসলির, যাঁর হাতেই বলতে গেলে তৈরি কলকাতার নগর পরিকল্পনার নীল নকশা। ত্রুটিটা ছিল, কলকাতার ভূমির ঢাল পূর্বমুখী হওয়া সত্ত্বেও নিকাশি ব্যবস্থা ছিল পশ্চিমে গঙ্গামুখী। ওই সময় থেকে কলকাতার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্তারা বুঝতে পেরেছিলেন, সুপরিকল্পিত পয়ঃপ্রণালী ছাড়া নিকাশি ব্যবস্থার উন্নয়ন সম্ভব নয়। আর এই নিকাশি ব্যবস্থায় খামতি থাকার জন্যই কলকাতা রোগ-অসুখের আঁতুড়ঘর।
কলকাতার নিকাশি ব্যবস্থার পরিকল্পনা নিয়ে নানা প্রস্তাব এসেছিল। কিন্তু উন্নয়ন কমিটির মনে হয়েছিল, পূর্বমুখী একটা প্রধান জলনিকাশি পথ তৈরি না করে ছোটখাটো নর্দমা নির্মাণ অর্থহীন। ১৮৩৭ সালে ক্যাপ্টেন টমসন কুড়ি লক্ষ টাকা ব্যয়ে আচ্ছাদিত নর্দমার প্রস্তাব দেন। কিন্তু বাতিল হয়ে যায় সে প্রস্তাব। ১৮৫৫ সালে মিউনিসিপ্যাল ইঞ্জিনিয়ার উইলিয়াম ক্লার্ক প্রথম ভূগর্ভস্থ নর্দমার পরিকল্পনা তৈরি করেন। পরিকল্পনা খতিয়ে দেখার জন্য নিয়োগ করা হয় একটা বিশেষ কমিটি। তাঁরা ক্লার্কের পরিকল্পনার কিছু পরিবর্তন ঘটিয়ে অনুমোদন করেন ১৮৫৯ সালে। নির্মাণকাজ শেষ হয় ১৮৭৫ সালে। এই ভূগর্ভস্থ নর্দমার দৈর্ঘ্য ১১২ মাইল। এই নিকাশি ব্যবস্থা একশো ভাগ সফল হয়নি, যদিও কিছুটা লাঘব হয়েছিল রাস্তার জল জমার সমস্যার। উত্তর ও মধ্য কলকাতার মানুষ রেহাই পায়নি জলবন্দি অবস্থা থেকে। অথচ সে সময় একমাত্র লন্ডন ও জার্মানির হামবুর্গ ছাড়া বিশ্বের আর কোনও শহরে এই ভূগর্ভস্থ নিকাশি ব্যবস্থা ছিল না।
১৮৭৫ সালে কলকাতায় যে ভূগর্ভস্থ নর্দমা তৈরি হয়েছিল, মাঝেমধ্যে কিছু সংস্কারকাজ হলেও পরবর্তী ১৩০ বছরে তার আমূল সংস্কার হয়নি কিছু। নর্দমার কর্মক্ষমতা হ্রাস পেয়েছিল পলি জমে, যা সরানোর কাজে কলকাতা পৌরসংস্থা হাত দেয় ২০০৬-০৭’এ। আজও জোর বৃষ্টি হলে কলকাতার পথে-পাড়ায় নৌকা ভাসানোর পরিস্থিতি হয়, সে কি ওই অতীত-অবহেলার পরিণতি?
১৮৭৫ সালে শুরু করা এই নিষ্কাশন ব্যবস্থার নেটওয়ার্কের উত্তর অংশটি প্রতি ঘণ্টায় প্রতিদিন ১৫০ মিমি বৃষ্টিপাতের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে করা হয়েছিল এবং ১৮৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত দক্ষিণ অংশটি প্রতিদিন ১০০ মিমি বৃষ্টিপাতের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে করা হয়েছিল। গত শতকের সত্তরের দশকে, নিষ্কাশন ব্যবস্থার ক্ষমতা প্রতিদিন ৩০০ মিমি বৃষ্টিপাতের লক্ষ্যমাত্রা বৃদ্ধির চেষ্টা করা হয়েছিল, কিন্তু বিভিন্ন প্রযুক্তিগত এবং আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা সম্ভব হয়নি।
কলকাতা শহরের মূল এলাকার প্রায় ৮০% থেকে ৮৫% এবং মোট শহরের ৫০% ভূগর্ভস্থ পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা দ্বারা আচ্ছাদিত। এগুলি ছাড়াও, বিভিন্ন আকারের বক্স ড্রেন, কিছু এলাকায় বড় আকারের কাঁচা এবং পাকা পয়ঃনিষ্কাশন (খোলা ড্রেন) নির্মাণ করা হয়েছিল। তবে, ড্রেনেজ নিষ্কাশন সম্পূর্ণরূপে ছোট পাম্পিং স্টেশন এবং বুস্টিং পাম্পিং স্টেশনগুলির সঙ্গে সংযুক্ত প্রধান পাম্পিং স্টেশনগুলির নেটওয়ার্কের উপর নির্ভরশীল ছিল।
শহরের মূল এলাকা ১০৪ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে প্রায় ৮০%, অর্থাৎ ৮৩ বর্গকিলোমিটার, বালিগঞ্জ, তপসিয়া, পামারবাজার, কুলিয়া ট্যাংরা, চিংড়িঘাটা, পালডাঙ্গা এবং ধাপা ইত্যাদিতে অবস্থিত ২৮৭৮ কিউসেক ধারণ ক্ষমতাসম্পন্ন লিফটিং পাম্পিং স্টেশনের মাধ্যমে নিষ্কাশিত হয়। এছাড়াও, ১০৪ বর্গকিলোমিটার আয়তনের মূল শহরের বাকি ২১ বর্গকিলোমিটারের নিষ্কাশন ব্যবস্থা বাগজোলা খালের মতো অন্যান্য বহির্গমন ব্যবস্থায়, বৃত্তাকার খালে, হুগলি নদীতে সরাসরি প্রবাহিত হওয়ার মাধ্যমে পরিচালিত হয়।
যদিও হুগলি নদী কলকাতা শহরের পশ্চিম দিকে প্রবাহিত হয়, ভূপৃষ্ঠের উপর দিয়ে উচ্চতার প্রবণতার কারণে, শহরের বেশিরভাগ নিষ্কাশন ব্যবস্থা মূলত পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়। তবে, কেএমসি এলাকার দক্ষিণ অংশের নিষ্কাশন ব্যবস্থা টালি নালা, মনি খাল, চড়িয়াল খাল ইত্যাদির মাধ্যমে পরিচালিত হয়, যা সরাসরি হুগলি নদীতে পতিত হয়, কারণ এই এলাকার ভূ-পৃষ্ঠের উপরিভাগের প্রবণতা পশ্চিম দিকের সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রায় ৬৬ বর্গকিলোমিটার কেএমসি অববাহিকা অঞ্চল এই বিভাগের আওতায় আসে।
কেএমসির ভৌগোলিক আয়তন ১৮৭ বর্গকিলোমিটার – বরো নং ১ থেকে বরো নং ১৫ পর্যন্ত ১৪১টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত। কেএমসির ১৮৭ বর্গকিলোমিটার এলাকার মধ্যে ১০৪ বর্গকিলোমিটার হল মূল শহর এলাকা, যা দুটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। শহরের এক অংশ, অর্থাৎ প্রায় ২১ বর্গকিলোমিটারের জল বাগজোলা, বৃত্তাকার খাল, টলি নালা দিয়ে এবং সরাসরি হুগলি নদীতে নিষ্কাশনের মাধ্যমে পড়ে। কেএমসি অববাহিকা এলাকার বাকি অংশ পশ্চিম খাল ব্যবস্থার মাধ্যমে পরিচালিত হয়, যার মধ্যে রয়েছে টলি নালা, মনিখাল, চড়িয়াল খাল ইত্যাদি।
কলকাতার ময়লা জল ও বৃষ্টির জল নিকাশে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এই খালমণ্ডল। জনজীবনে খালমণ্ডল জাতীয় জলপথের সঠিক মূল্যায়নের অভাবে বহু খাল আজ বিলুপ্ত, যেগুলির অস্তিত্ব এখনো আছে সেগুলি মৃতপ্রায় এবং অব্যবহারযোগ্য। মাঝে মধ্যে বিভিন্ন সরকারের আমলে খালগুলোর কিছু সংস্কারের কাজ হলেও আদতে যে অশ্বডিম্ব প্রসব হয়েছে, সেটা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। পথ প্রধানতঃ পরিবহনের জন্যে হলেও কলকাতার মতো শহরের খালপথ তথা জলপথ পরিবহন ছাড়াও আরো নানাভাবে প্রকৃতি ও মানুষের উপকার সাধন করতে পারে, অন্যান্য পথ যা পারে না। আজকের বৃহত্তর কলকাতার জনসমাজের স্বার্থে পরিবেশগত সুবিধা এবং আধুনিক প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে বহুমুখী খালপথ ব্যবস্থা গড়ে তোলা আশু প্রয়োজন, চাই বহুমুখী খালপথ ও সমন্বিত পরিবহন ব্যবস্থা। এক সময় জার্মানির স্লোগান ছিল— ‘Rails or Canals’ এর বদলে ‘Rails and Canals’। ইউরোপ, আমেরিকার মতন বিভিন্ন দেশে খালপথ পরিবহনের নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে। সেখানে উপলব্ধি করা হয়েছে যে খালপথ হবে রেলপথ, সড়ক পথ, নদী পথের পরিপূরক। পশ্চিমবঙ্গের মতো নদীমাতৃক রাজ্যে, যেখানে বৃষ্টিপাত বেশি হয়, সেখানে এই ধরনের সমন্বিত পরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তোলার একটা বাড়তি সুবিধা আছে, প্রয়োজনও আছে। খালপথের নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়, পরিবহন ব্যয় অন্যান্য পথের তুলনায় কম। জল-পরিবহন ব্যবস্থা পরিবেশবান্ধব।
খালপথের দু’পাড়ে পার্ক, বিনোদন কেন্দ্র ইত্যাদি গড়ে তোলা যেতে পারে সহজেই। পর্যটনের কাজে ব্যবহৃত হয়ে থাকে খালপথ। কলকাতা শহরের জল নিকাশের জন্য খালপথের ব্যবহার একটা পুরনো প্রথা। আধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে ময়লা জল শোধন করে খালে ফেলার বিষয়টির দিকে নজর দিতে হবে। ছোট-ছোট লঞ্চ এবং বিভিন্ন ধরনের নৌকো গড়ার শিল্প গড়ে উঠবে। স্থানীয় মানুষের এসব তৈরির সক্ষমতা রয়েছে। স্থানীয় কাঁচামাল, স্থানীয় মানুষের সক্ষমতাকে ব্যবহার করতে পারলে বহু মানুষের জন্যে দ্রুত কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। খালপথ মারফত সেচের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারলে বাণিজ্যিক কৃষিজ উৎপাদন বাড়বে। মাছ চাষেরও সুযোগ সৃষ্টি করা যায়। এখন প্রয়োজন খোলা দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে অতীতের ইতিহাস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে কলকাতার খালমণ্ডলকে পুনরুজ্জীবিত করা। খালগুলোর নিয়মিত সংস্কার আশু প্রয়োজন। কলকাতার মতো শহরে খালপথ থাকাটা কোনো অভিশাপ নয়, বরং আশীর্বাদই বলা যায়। তবে যে দেশে ভোট এবং রাজনীতি— বিনা পুঁজি ও বিনা শিক্ষার ব্যবসা, সেখানে এসব দিবাস্বপ্ন না দেখাই উচিত। কারণ সকল রাজনৈতিক দলই, নিজেদের স্বার্থে একই মুদ্রার এপিঠ ও ওপিঠ। শেষে বলে রাখা দরকার যে, বৃষ্টিতে কলকাতায় জল জমার সমস্যা আজকের মতন অতীতেও ছিল। অন্ততঃ পুরানো যে সব নথি ও ছবি পাওয়া যায়, তাতে বৃষ্টিতে কলকাতার বানভাসি হয়ে পড়ার চিত্রটা সহজেই ধরা পড়ে। তবে তখনকার সঙ্গে এখনকার পার্থক্য হল যে, তখনকার কলকাতার বাসিন্দাদের বৃষ্টির জমা জল নামার জন্য খুব বেশি অপেক্ষা করতে হত না; এবং বলাই বাহুল্য যে আজকের মতন পাম্প ব্যবহার করে জল নিষ্কাশন করবার কোনও ব্যবস্থা তখন ছিল না। এর মূল কারণ ছিল কলকাতা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা খালপথগুলো। কিন্তু এখন কলকাতাবাসীদের কপালে দুর্ভোগ ছাড়া আর কিছুই নেই। সেটার মূলে, ওই যে বিনা পুঁজি ও বিনা শিক্ষার ব্যবসা— ভোট এবং রাজনীতি।