ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় আবার নিহত পাঁচ সাংবাদিক। গাজায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে ইজরায়েল পাঁচ সাংবাদিককে হত্যা করেছে। সাংবাদিকদের ওপর ইজরয়েলের এই আক্রোশ দিনে দিনে বাড়ছে। ইতিপূর্বে গাজার এক হাসপাতালের কাছে দ্রোনের মাধ্যমে ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ে হত্যা করা হয়েছিল ১৫ জন সাংবাদিককে। সাংবাদিকদের ওপর এই আক্রোশের কারণ অবশ্যই সত্য খবরে প্রকাশ। বিশেষ করে চিত্র সাংবাদিকরাই মূল লক্ষ্য ছিল। গাজায় খান ইউনুসের হাসপাতাল চত্বরে পরপর দুটি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইজরায়েল। এতে অন্তত ২০ জন নিহত হয়েছে বলে গাজার স্বাস্থ্য দপ্তর সূত্রে জানা গিয়েছে।
সর্বশেষ এই হামলায় নিহত সাংবাদিকদের মধ্যে সকলেই প্যালেস্তাইনের বাসিন্দা। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের হুসাম আল মাস্রি, এপি-র মারিয়াম আবু দাগ্গা, সংবাদমাধ্যম আল জাজিরার মহম্মদ সালাম, চিত্র সাংবাদিক মোয়াজ আবু তাহা এবং ‘কুদস ফিড’-এর আহমেদ আবু আজিজ। রয়টার্সের আরও এক সাংবাদিক হাতেম খালেদ হামলায় গুরুতর আহত হয়েছেন।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যম সূত্রে প্রাপ্ত ভিডিও ফুটেজে দেখা যাচ্ছে, নাসের হাসপাতল চত্বরে প্রথম ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর, স্বেচ্ছাসেবকদের একদল ও বেশ কয়েকজন সাংবাদিক উদ্ধার কাজের জন্য ঘটনাস্থলে পৌছান। তাঁদের পরা জ্যাকেটেই ভিডিও-তে তাঁদের পরিচিত যাচাই করা যাচ্ছিল। হঠাৎ তীব্র বিস্ফোরণের শব্দে আশপাশ কেঁপে ওঠে। উদ্ধারকারীদের লক্ষ্য করে আরেকটি ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করা হয়। তৎক্ষণাৎ তাঁদের মৃত্যু হয়। পরিকল্পিতভাবেই নিরস্ত্র স্বেচ্ছাসেবক ও সাংবাদিকদের উপর এই হামলা করেছে ইজরায়েল। ভিডিও ফুটেজেই তার প্রমাণ মিলেছে।
এই হামলায় নিহত সাংবাদিক, বছর তেত্রিশের মারিয়াম আবু দাগ্গা গত বছর দুয়েক ধরে এপি-র হয়ে কাজ করছিলেন। স্থানীয় বিভিন্ন সাংবাদমাধ্যমের সঙ্গেও তিনি যুক্ত ছিলেন। গাজা গণহত্যা শুরুর আগেই তাঁর ১২ বছর বয়সি ছেলে ও পরিবারকে শহর থেকে অন্যত্র স্থানান্তরিত করা হয়। তারপর থেকে প্রাণের বাজি ধরে প্রতিনিয়ত গাজার পরিস্থিতি সম্পর্কে বহু সাহসী প্রতিবেদন তিনি প্রকাশ করেন। মূলত নাসের হাসপাতাল চত্বরেই তিনি থাকছিলেন। ইজরায়েলের অমানবিক অবরোধের জেরে গাজায় চলতি আকালের পরিস্থিতি এবং অপুষ্টিতে আক্রান্ত শিশুদের বাঁচাতে এই হাসপাতলের চিকিৎসকদের তীব্র লড়াইয়ের কথা তিনি বারে বারে তুলে ধরেছেন। সাংবাদিক হিসাবে তাঁর দায়িত্ববোধ এবং পশাদরিত্ব বিভিন্ন জায়গায় প্রশংসিত হয়েছে।
অন্যান্য নিহত সাংবাদিকরাও নাসের হাসপাতালের দুরুহ পরিস্থিতি নিয়ে প্রতিনিয়ত প্রতিবেদন প্রকাশ করছিলেন। তাঁদের প্রকাশিত এই সমস্ত প্রতিবেদনের মাধ্যমেই গোটা বিশ্ব গাজা গণহত্যায় ইজরায়েলি সেনাদের ‘ভাতে মারার নীতি’ সম্বন্ধে জানতে পারেন। ফলত ফ্রান্স, ব্রিটেন, ইতালি, জার্মানি, স্পেনের মতো ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ইজরায়েলকে প্রস্তাবিত সংঘর্ষ বিরতিতে রাজি হয়ে গাজায় ত্রাণ সরবরাহ অব্যাহত রাখার জন্য চাপ দেয়। এতে আন্তর্জাতিক মহলে ইজরায়েল বেশ কোণঠাসা হয়ে পড়ে। দুনিয়ার সামনে সেই বাস্তবতা তুলে ধরার জন্যই এই ‘শাস্তি’ কি দিচ্ছে ইজরায়েল, এই প্রশ্ন সামনে উঠে আসছে।
প্রসঙ্গত, গত ১০ আগস্ট গভীর রাতে ইজরায়েলি সেনার এক পরিকল্পিত এবং সুনির্দিষ্ট হামলায় ৭ সাংবাদিক নিহত হন। তার মধ্যে ৫ জন সংবাদমাধ্যম ‘আল জাজিরা’-য় কর্মরত ছিলেন। সাংবাদিকদের এমন বেছে বেছে ‘খতম’ করার ঘৃণ্য নীতি আন্তর্জাতিক মহলের কাছে তুমুল ধিক্কার পায়। এই ঘটনার ঠিক সপ্তাহ দুয়েকের মধ্যেই একই রকম হামলায় আরও ৫ আন্তর্জাতিক মানের সাংবাদিককে হত্যা করা হল।
গত ২০২৩-এর অক্টোবর থেকে গাজায় মোট ১৯২ জন প্যালেস্তিনীয় সাংবাদিক নিহত হয়েছেন। বলা বাহুল্য, ওই বছরের অক্টোবর মাসের আগের তিন বছর গোটা বিশ্বে সব মিলিয়ে এত সংখ্যক সাংবাদিক নিহত হননি। এই প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক সংবাদ কর্মী সংস্থা ‘কমিটি টু প্রোটেক্ট জার্নালিস্টস’ জানিয়েছে, গাজায় ইজরায়েলের নৃশংস কার্যকলাপ আড়াল করতেই সাংবাদিকদের হত্যা করা হচ্ছে। এই ধরনের পদক্ষেপ উদ্দেশ্য প্রণোদিত এবং পরিকল্পিত। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা জানিয়েছে, অধিকাংশ ঘটনায় বেছে বেছে প্যালেস্তিনীয় সাংবাদিকদের হত্যা করা হচ্ছে।
এর প্রকৃত উদ্দেশ্য আইনি জটিলতা এড়ানো। হামলায় প্যালেস্তিনীয় সাংবাদিক নিহত হলে ইজরায়েলি সেনা খুব সহজেই মৃত ব্যক্তির সঙ্গে হামাসের যোগসাজস আছে বলে দাবি করে বিচারবিভাগীয় তদন্ত এড়িয়ে যায়। কোণওভাবে যদি অন্য কোনও দেশের সাংবাদিক নিহত হন, তাহলে বিচারবিভাগীয় প্রক্রিয়া চললেও বেকসুর প্রমাণ হওয়ার হার ৮৮ শতাংশ। ২০২২-এ ইজরায়েলি সেনার গুলিতে প্যালেস্তিনীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন সাংবাদিক শিরিন আবু আকলেহ ইজরায়েলি সেনার গুলিতে নিহত হলে এমনই এক বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। তবে তিন বছর পেরিয়ে গেলেও তা এখনও শেষ হয়নি।