জিম করবেটের দেড়’শ বছর, প্রয়াণের সত্তর

ফাইল চিত্র

হীরক কর

ভারতের জঙ্গলে জঙ্গলে তখন প্রচুর বাঘ। সময়টা উনিশ শতক। একটা ছোট ছেলে বনমোরগের পিছু নিয়ে কুলঝোপে উঁকি দিতেই সেটা ফুঁড়ে উঠে বের হয় বিশাল বাঘ। চলে যাওয়ার আগে তার ঘুরে দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে ও মুখের হাবেভাবে ছেলেটির মনে হয়, পেল্লায় বাঘটা যেন বলে গেল, ‘এই বাচ্চা, কি করছ এখানে, বাড়ি যাও।’ সেই ছোট্ট ছেলেটির জন্মের দেড়’শ বছর পূর্ণ হল এবার। ১৮৭৫ থেকে ২০২৫, আগামী ২৫ জুলাই দেড়শ বছর হবে তাঁর।‌ তিনি আর কেউ নন, ভারতে বাঘ সংরক্ষণের পথিকৃৎ জিম করবেট অর্থাৎ ‘এডওয়ার্ড জেমস করবেট’।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে এবং বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে হিমালয়ের পাদদেশের এক অঞ্চলের মানুষের মাঝে ত্রাস সৃষ্টি করেছিল এক মানুষখেকো বাঘিনী। প্রায় এক দশকেরও বেশি সময় ধরে এই মানুষখেকোর পিছু নিয়েছিল সেখানকার পুলিশ, গুপ্ত শিকারিরা, এমনকি একটি নেপালি গোর্খা রেজিমেন্টও। বলা হয়ে থাকে, প্রায় ৪৩৬টি নথিভুক্ত মৃত্যুর জন্য এই বাঘিনীটি দায়ী ছিল। ‘গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড’ অনুসারে, বাঘের আক্রমণে প্রাণহানির সংখ্যা বিবেচনায় এটিই ইতিহাসের সর্বোচ্চ।


ক্রমেই ইতিহাসের পাতায় এই বাঘিনী ‘চম্পাবতের মানুষখেকো’ নামে পরিচিতি লাভ করে। ইতিহাসবিদরা এর সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘This tiger ceased to behave like a tiger at all. It transformed into a new kind of creature all but unknown in the hills of northern India’s Kumaon district.’

১৯০৭ সালে করবেটের বন্দুকের গুলিতে এই মানুষখেকোর মৃত্যু হয়। এক দশকেরও বেশি সময় ধরে মানুষের মনে ত্রাস সঞ্চার করা চম্পাবতের এই কিংবদন্তির যবনিকাপাতের মধ্য দিয়েই জন্ম হয় ইতিহাসের আরেক বিখ্যাত কিংবদন্তির। সেই কিংবদন্তির নাম ছিল ‘এডওয়ার্ড জেমস করবেট’, সংক্ষেপে ‘জিম করবেট’। আর কুমায়ুন-গাড়োয়ালের মানুষের কাছে তাঁর পরিচয় ছিল ‘কার্পেট সাহেব’। চম্পাবতের বিখ্যাত মানুষখেকো বাঘিনী ছিল তাঁর প্রথম শিকার।

জিম করবেট জন্মেছিলেন ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৫ জুলাই, ভারতের কুমায়ুনে অবস্থিত নৈনিতাল শহরে। স্থানটি বর্তমানে উত্তরাখণ্ড রাজ্যে। শীতে নৈনিতালে প্রচণ্ড ঠাণ্ডার কারণে করবেটের বাবা তখনকার বহুল প্রচলিত নিয়মানুযায়ী, নৈনিতাল থেকে ১৫ মাইল দূরে তেহরি রাজ্যের অন্তর্গত কালাধুঙ্গি নামক গ্রামে জমিজমা কিনে দ্বিতীয় আরেকটি আবাস গড়ে তোলেন শীতকালীন সময়ের জন্য। দুই আবাসস্থল পরবর্তীতে জিম করবেটের শিকারি হয়ে ওঠার পেছনে বড় ভূমিকা পালন করে।

তাঁর কাছে জঙ্গল ছিল হাতের তালুর মতো চেনা। অজস্র পশু-পাখির ডাক নকল করতে পারতেন তিনি। বাঘের মতোই নিঃশব্দ আর ক্ষিপ্র ছিল তাঁর গতি। কুমায়ুন ও গাড়োয়ালের বনে-পাহাড়ে এমন আরও হাজারো কাহিনী ছড়িয়ে আছে তাঁর নামটিকে ঘিরে। ১৯০৭ থেকে ১৯৩৮ সালের মধ্যে করবেট মোট ৩৩টির মতো মানুষখেকো বাঘকে অনুসরণ এবং গুলিবিদ্ধ করেছিলেন। যদিও এদের মধ্যে মাত্র ডজনখানেক ভালোভাবে নথিভুক্ত হয়েছিল। বলা হয়ে থাকে যে, এসব বড় বেড়ালেরা ১২০০-র ওপর পুরুষ, নারী এবং শিশুকে হত্যা করেছিল।

তাঁর শিকারি জীবনে দুটি মানুষখেকো চিতাবাঘও শিকার করেছিলেন। ১৯১০ সালে পানারে প্রথম যে চিতাবাঘটিকে হত্যা করেছিলেন, সেটি প্রায় ৪০০ মানুষকে হত্যা করেছিল। আর দ্বিতীয়টি ছিল ‘রুদ্রপ্রয়াগের মানুষখেকো’ চিতাবাঘ। প্রায় আট বছর ধরে যেটি দৌরাত্ম্য চালিয়েছিল এবং হত্যা করেছিল ১২৬-এর অধিক তীর্থযাত্রী ও  স্থানীয় মানুষকে।

‘রুদ্রপ্রয়াগের মানুষখেকো’ লেপার্ড শিকারের বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা সম্পর্কে করবেট সাহেব বলেছিলেন, “There are events in one’s life which, no matter how remote, never fades away from memory”
ভয়ঙ্কর কোনো শিকার ধরার সময় তিনি একাকি থাকতে পছন্দ করতেন এবং পায়ে হেঁটেই মাইলের পর মাইল পথ অতিক্রম করতেন। অনেকসময় তিনি তাঁর পোষা কুকুর রবিনকে সঙ্গে নিতেন শিকারের সময়। শিকারের সময় অন্যদের জীবন রক্ষার্থে তাঁর নিজের জীবনের ওপর বড় ঝুঁকি নিতেও পিছপা হতেন না তিনি।

কথায় আছে, বাঘে ছুঁলে আঠার ঘা। কিন্তু কেন? কারণ বাঘের থাবায় আছে প্রচণ্ড জোর। বাঘ তার থাবা দিয়ে একবার আঁচড় দিলেই গ্যাংগ্রিন হয়ে মানুষ মৃত্যুর কোলে পর্যন্ত ঢলে পড়তে পারে। এসব জানা সত্ত্বেও তিনি নিজের জীবন বাজি রেখে ‘তাল্লা-দেশের মানুষখেকো’, ‘মোহনের মানুষখেকো’, ‘থাক-এর মানুষখেকো’ এবং ‘মুক্তেশ্বরের মানুষখেকো’র মতো ভয়ংকর সব মানুষখেকো শিকার করেছিলেন।

জিম করবেটের শিকার ও ভারতের বন্যপ্রাণী সম্পর্কে যে বিপুল অভিজ্ঞতা, সে তুলনায় তাঁর লিখিত রচনার পরিমাণ বেশ কমই বলা যায়। নৈনিতালে তাঁর বন্ধুর ছোট্ট প্রেসে ছাপা প্রথম বই ‘জাঙ্গল স্টোরিজ’—ছাপা হয়েছিল মাত্র ১০০ কপি, তাও বিক্রি মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল না। এরপর জিমের গ্রন্থের সংখ্যা মাত্র ছয়।

আর মৃত্যুর সত্তর বছর পরেও তাঁর শিকার-কাহিনীগুলো এখনও বেস্টসেলার। অথচ সে অর্থে পেশাদার লেখক হবার কোনো বাসনা ছিল না তাঁর। অধিকাংশ রচনাই ঘটনার বিশ, তিরিশ কিংবা চল্লিশ বছর পর লেখা। ১৯০৭ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ তিন দশক ধরে রাতের পর রাত হিংস্র শ্বাপদের সন্ধানে কেটেছে জিম করবেটের। একাধিকবার প্রায় অলৌকিকভাবে রক্ষা পেয়েছেন তিনি। তাঁর মতে শিকার তখনই মান্যতা পায় যখন তা হয় সাধারণ নিরীহ মানুষের প্রাণ রক্ষার স্বার্থে।

সুস্থ বাঘেরা সব সময় মানুষের সংস্পর্শ এড়িয়ে চলে। তাদের খাদ্যাভ্যাসের মধ্যেও মানুষের মাংসের প্রতি অনাগ্রহ লক্ষ্য করা যায়। বাঘেরা মূলত মানুষখেকো হয়ে ওঠে বয়সের ভারে শিকার করার ক্ষমতা হারিয়ে ফেললে। কিন্তু এর ব্যতিক্রমও দেখা যায়। ‘চম্পাবতের বাঘিনী’র মতো আরো অনেক বাঘ তাদের বাস্তুতন্ত্রের ওপর শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী চলমান ধ্বংসযজ্ঞের ফলেও ‘মানুষখেকো’ হয়ে উঠতে পারে।

ইতিহাসবিদদের মতে, ১৮৭৫ থেকে ১৯২৫ সালের মধ্যেই ৮০ হাজারের অধিক বাঘকে কেবল বিনোদনের উদ্দেশ্যেই হত্যা করা হয়েছে। বিগত শতাব্দীর মধ্যেই ভারতবর্ষের ৬৭% এলাকা হতে বাঘ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তাই বাঘকে ‘নিষ্ঠুর ও রক্তপিয়াসী’ বলতে ঘোরতর আপত্তি ছিল করবেটের। তাঁর ভাষায়, ‘বাঘ উদার হৃদয় ভদ্রলোক। সীমাহীন তার সাহস। যে দিন বাঘকে বিলোপ করে দেওয়া হবে, যদি বাঘের সপক্ষে জনমত গড়ে না ওঠে বাঘ লোপ পাবেই, তা হলে ভারতের শ্রেষ্ঠতম প্রাণীর বিলোপে ভারত দরিদ্রতরই হবে।’

জিম করবেট সারা জীবন কাজ করে গেছেন ভারতবর্ষে বাঘেদের জন্য অভয়াশ্রম তৈরির উদ্দেশ্যে। ১৯৩৮ সালের ৩০ নভেম্বর সন্ধ্যা ৬টায় ‘থাক-এর মানুষখেকো’ বাঘিনী শিকারের মধ্য দিয়ে জিম করবেট তাঁর শিকারি জীবনে ইতি টেনেছিলেন। আজ পর্যন্ত মানুষখেকো প্রাণীদের নিয়ে লেখা গল্পগুলোর মধ্যে এক অন্যতম নাটকীয় গল্প হলো ‘থাক-এর মানুষখেকো’কে নিয়ে লেখা গল্পটি।

শিকারি জিমের আড়ালে কোথায় যেন লুকিয়ে থাকে এক চিরকিশোর। ফাটা নল গাদা বন্দুক নিয়ে যে একাই ঘুরে বেড়ায় বনে-পাহাড়ে। নকল করে পশুপাখির ডাক। আয়া-খানসামাদের কাছ থেকে শেখে হিন্দুস্থানি ও দেশি পাহাড়ি ভাষা।
স্কুলের পর আর উচ্চশিক্ষার সুযোগ হয়নি। ইচ্ছে ছিল ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার। কিন্তু বাড়িতে একগাদা লোকের অন্ন সংস্থানের জন্য যেতে হয় বিহারের মোকামাঘাটে।

২১ বছর ধরে মোকামাঘাটে রেল কোম্পানির হয়ে কুলির ঠিকাদারি। বয়সের ধর্মে ভাল লেগেছিল শ্বেতাঙ্গিনী এক কিশোরীকে। কিন্তু মা ও দিদির প্রবল বাধায় শুকিয়ে যায় সেই প্রেমের কলি। ব্যক্তিগতভাবে আমার সেরা মনে হয় ‘মাই ইন্ডিয়া’য় তাঁকে ঘিরে থাকা দরিদ্র-অন্ত্যজ মানুষগুলোকে নিয়ে তাঁর লেখাগুলো। অন্ত্যজ শ্রেণির কুলি সর্দার চামারি শেষ নিঃশ্বাস ফেলে জিমেরই হাত ধরে। বলে, ‘পরমেশ্বর, আমি আসছি’। শেষযাত্রায় উপস্থিত কাশীর এক মন্দিরের প্রধান পুরোহিত। এই ২০২৫ সালেও এ ঘটনাকে মনে হয় ‘বিপ্লব’। এ ছাড়া ‘লালাজি’, বুদ্ধু, ডাকু সুলতানা— প্রতিটিই যেন উজ্জ্বল হীরক খণ্ড। কেউ কেউ মোকামাঘাট ও গাড়োয়াল-কুমায়ুনের দরিদ্র অন্ত্যজনের প্রতি জিমের দরদকে প্রশংসা করলেও সেটাকে ‘দরদী প্রভু ও অনুগত প্রজা’ সম্পর্কেই বেঁধে রাখার পক্ষপাতী।

১৯৪৭-এর নভেম্বর মাসে তাঁর বোন ম্যাগিকে সঙ্গে নিয়ে লক্ষ্ণৌ হতে মুম্বাইয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দেন করবেট। সেখান থেকে এসএস অ্যারোন্দা জাহাজে মোম্বাসা এবং সেখান থেকে নাইরোবি হয়ে নায়েরি শহরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন তিনি এবং তাঁর বোন ম্যাগি। ঘনিষ্ঠজনদের কাছে তাঁর লেখা চিঠিগুলো হতে প্রকাশ পেয়েছিল যে, তাঁর ভয় ছিল স্বাধীন ভারতে হয়তো তাঁর ওপরে অত্যাচার নেমে আসবে এবং সাদা চামড়ার হওয়ায় তিনি হয়তো সুবিচার পাবেন না।
লক্ষ্ণৌতে যাঁরা সেদিন করবেটকে বিদায় জানাতে এসেছিলেন তাঁরা কেউ চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি। তাঁর প্রিয় ভারতভূমি ছেড়ে যাবার আগে নৈনিতালের বাড়ি বিক্রি করে তাঁর বহুদিনের বিশ্বস্ত সঙ্গী রাইফেল ও বন্দুকগুলো গভীর জঙ্গলে ‘সমাধিস্থ’ করে এসেছিলেন। ৭৯ বছর বয়সে ১৯৫৫ সালের ১৯ এপ্রিল কেনিয়ার নায়েরিতে হার্ট অ্যাটাকে জীবনাবসান ঘটে জিম করবেটের। এই সেদিন ১৯ এপ্রিল চলে গেল। করবেট সাহেবের মৃত্যুরও ৭০ বছর হয়ে গেল। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর হাত ধরেই ভারতে এগিয়ে চলেছে ‘প্রজেক্ট টাইগার’।

ভারতীয় উপমহাদেশের ঘন জঙ্গলগুলোর আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে নানা কিংবদন্তি ও উপকথা। যার অধিকাংশই হয়তো মানব মনের কল্পনাপ্রসূত। কিন্তু জিম করবেটের জীবন ছিল এমনই এক প্রকৃত কিংবদন্তি, যার কোনো অংশই কল্পনাপ্রসূত নয়। তাঁর পদচারণার ধ্বনি আজও ভারতীয় উপমহাদেশের ঘন শ্বাপদসংকুল জঙ্গলগুলোতে প্রতিধ্বনিত হতে শোনা যায়।

মনে রাখতে হবে ছোটা হলদোয়ানি-কালাধুঙ্গির সাধারণ মানুষ জিমকে ‘শ্বেতাঙ্গ সাধু’ হিসাবেই দেখত। খুব গোঁড়া পরিবারেও জিমের সামনে মহিলাদের আসায় কোনও ‘পর্দা’ ছিল না। মোকামাঘাটে থাকার সময় স্থানীয় কুলিদের সঙ্গে মিশেছেন। স্কুল করে দিয়েছেন তাঁদের ছেলেদের পড়ার জন্য। হকি ও ফুটবল টিম গড়ে খেলেছেন এই ‘নেটিভ’দের সঙ্গেও। নৈনিতাল, কালাধুঙ্গি ছেড়ে চলে যাওয়ার সময় ঘর-জমি দিয়ে গিয়েছেন তাঁদের, এমনকী মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তাঁর খাজনা পর্যন্ত দিয়ে এসেছেন।

স্থানীয় মানুষরা কষ্ট পাবে ভেবে প্রায় নীরবে নিঃশব্দে এ দেশ ছাড়েন জিম ও তাঁর দিদি ম্যাগি।
ভারত স্বাধীন হল ১৯৪৭ সালের ১৫ অগস্ট। আর তাঁরা ভারত ছাড়লেন ওই বছরই নভেম্বরে।

২১ নভেম্বর নৈনিতালের গার্নি হাউস বিক্রি হয়ে গেল। তার ক’দিনের মধ্যেই বাড়ির বাগানে একটি গাছের চারা রোপণ করে ও জঙ্গলে বন্দুকগুলো ‘সমাধিস্থ’ করে চিরদিনের মতো ভারত ছাড়লেন জিম ও ম্যাগি। লখনউ স্টেশনে সাহেবকে বিদায় জানাতে এসে কেঁদে ফেলে রাম সিংহ। জিম ও ম্যাগির চোখও শুষ্ক ছিল না। সাগরপাড়ি দিয়ে জাহাজ মোম্বাসা পৌঁছায় ১৫ ডিসেম্বর। করবেটরা সেখান থেকে যান নাইরোবি। পরে আস্তানা গাড়েন নিয়েরে। জার্মানদের হাত থেকে দখলমুক্ত হয়ে ওই অঞ্চল তখন ব্রিটিশ উপনিবেশ।

দু’টি বিশ্বযুদ্ধের সূত্রে ও পরে লন্ডন-সহ ব্রিটেন সফর করলেও জিম বা ম্যাগি কিন্তু স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন না খাঁটি ইওরোপিয়ানদের সঙ্গে। আসলে ‘ডোমিসাইল্ড ইংলিশ’ হিসাবে কোথাও একটা হীনমন্যতা হয়তো ছিল। কারও কারও অভিমত, সিপাহি বিদ্রোহের ‘ভূত’ ঘাড় থেকে নামেনি। আশঙ্কা ছিল, স্বাধীন ভারতে নতুন শাসক শ্রেণি প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে উঠতে পারে। তাছাড়া, করবেট সাহেবের বাবা সিপাহী বিদ্রোহের সময় সিপাহিদের হাতে মারা গিয়েছিলেন। তাই, সাত-পাঁচ ভেবে সে জন্যই ভারত ত্যাগের সিদ্ধান্ত।

বন্ধু ব্র্যান্ডারকে চিঠিতে লিখছেন, ‘দ্য ইন্ডিয়া দ্যাট ইউ অ্যান্ড আই লাভড হ্যাজ বিন স্যাক্রিফাইজড অন দ্য অলটার্স অফ অ্যাম্বিশান অ্যান্ড গ্রিড।’ এই চিঠি গার্নি হাউস ছাড়ার এক মাস আগে লেখা। শান্তি পুরো পাননি নিয়েরেতে গিয়েও। ১৯৫৪ সালের ১৭ নভেম্বর জেফরি জে কাম্বারবেলকে লিখছেন, ‘দ্য জ্যাকারান্ডাজ আর ইন ফুল ব্লুম, অ্যান্ড আ ফিউ মাইলস অ্যাওয়ে— বম্বস আর বার্স্টিং। হিউম্যান বিয়িংস আর নেভার হ্যাপি আনলেস দে আর ফাইটিং…।’

নিজের রাইফেলগুলো নৈনিতালের জঙ্গলে পুঁতে এলে কী হবে, আফ্রিকাতে এসেও গুলিগোলার আওয়াজ থেকে নিষ্কৃতি নেই জিমের। মাঝে মাঝে মনে হয়, ভারতই ভাল ছিল। ম্যাগিকে বলেন। কিন্তু যাওয়া আর হয়নি।

ভোরের পঞ্চচুল্লি, নন্দা, ত্রিশূলে আলোর অভিষেক দেখে বড় হয়ে ওঠা জিম ১৯৫৫ সালের ১৯ এপ্রিল ঘুমিয়ে পড়েন চিরদিনের জন্য। ‘আমার ভারত’ থেকে অনেক দূরে। আফ্রিকায়। এ ট্র্যাজেডি শুধু জিমের নয়। প্রতিটি ভারতবাসীর। তিনি জিম করবেট। আয়ার্ল্যান্ড থেকে ভাগ্যান্বেষণে ভারতে এসেছিলেন করবেটের পূর্বপুরুষ। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের আঁচ লেগেছিল এই পরিবারের গায়েও। সেই সূত্রেই নিতান্ত স্বল্পবিত্ত এই পরিবার চলে আসে কুমায়ুনের নৈনিতালে। করবেটের মা মেরি জেন ছিলেন আগরার চার্লস জেমস ডয়েলের স্ত্রী।

বিদ্রোহী সিপাহিদের হাতে চার্লসের মৃত্যু ঘটে। মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনটি শিশুসন্তান নিয়ে অকূলপাথারে পড়েন মেরি। কিছু দিন পর মুসৌরিতে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় ক্রিস্টোফার উইলিয়াম করবেটের। ক্রিস্টোফারও তখন তিনটি সন্তান নিয়ে বিপত্নীক। ১৮৫৮ সালে ক্রিস্টোফার ও মেরি দু’তরফের ছ’টি সন্তান নিয়ে শুরু করেন নতুন সংসার।

মুসৌরি ও মথুরায় দু’বছর কাটিয়ে ১৮৬২ সালে করবেট পরিবার চলে আসে নৈনিতালে। তত দিনে সেনার চাকরি ছেড়ে পোস্টমাস্টারের চাকরি নিয়েছেন ক্রিস্টোফার। পরে বাড়ি করেন নৈনিতালে। জিম জন্মগ্রহণ করেন নৈনিতালেই।
বিশ্বযুদ্ধে যোগদান ও ব্যবসার সূত্রে বছরে মাস তিনেকের জন্য আফ্রিকায় যাওয়া ছাড়া জিমের জীবনের ৯০ ভাগই কেটেছে ভারতের (তৎকালীন সংযুক্ত উত্তর প্রদেশ) নৈনিতাল অঞ্চলে।

নভেম্বরের শেষে রীতিমতো কড়া শীত নৈনিতালে। আর শেষরাতেই ঠান্ডার কামড়টা সবচেয়ে প্রবল।
রাম সিংহকে তৈরি থাকতে বলেছিলেন সাহেব। সময়মতোই এসে গিয়েছিল সে। দেখে, বাংলোর বারান্দায় পায়চারি করছেন সাহেব। হাতের টর্চটা জ্বেলে একটা বস্তার উপর ফেললেন।

ইঙ্গিত করলেন বস্তাটা তুলে নিতে। কাঁধে তুলে রাম সিংহ বুঝল, বেশ ভারী বস্তাটা। কিন্তু কী আছে এতে, প্রশ্ন করল না।
প্রভুর আদেশ চিরদিন বিনা প্রশ্নে পালন করে এসেছে সে। কুয়াশা মোড়া ম্লান জ্যোৎস্নায় থমথম করছে নির্জন বনস্থলী। এই গাছপালা, এই নির্জনতা আর কত দিন থাকবে কে জানে?

সব কিছু বড় দ্রুত বদলে যাচ্ছে। আর সে জন্যই তো তিন পুরুষের বাস উঠিয়ে চলে যাওয়ার কঠোর সিদ্ধান্তটা নিতে হল।
বারান্দায় সিঁড়ি বেয়ে নেমে সাহেব একটা সিগারেট ধরালেন। রাম সিংহ তাঁর এক সঙ্গীকে নিয়ে সাহেবের পরবর্তী নির্দেশের অপেক্ষায়। সাহেব আঙুলটা তুলে ইঙ্গিত করলেন বনের দিকে। শীতের শেষরাতে ভিজে ঘাসপাতা মাড়িয়ে তিন জোড়া পা চলল জঙ্গলের গভীরে। অ্যাকাশিয়া, ওক আর বার্চের আড়ালে কুয়াশার জাল ছিঁড়ে কখনও-সখনও উঁকি মারছে কৌতূহলী শুকতারা। সূর্য উঠে আকাশ রাঙা হতে এখনও অনেক দেরি। প্রায় মিনিট চল্লিশ হাঁটার পর জঙ্গল যেখানে বেশ ঘন, একটা বড় গাছের নীচে রাম সিংহদের দাঁড়াতে বললেন সাহেব। আরও একটু ভিতরে ঘন ঝোপের মধ্যে টর্চের আলো ফেললেন। দুটো বড় পাথর দিয়ে জায়গাটা চিহ্নিত করাই ছিল।

সাহেব এ বার বললেন বস্তাটা খুলতে। ভিতর থেকে বেরোল শাবল, কোদাল, তিনটে রাইফেল ও দুটো শটগান। অনেক দিন আগে সেই ১৯২৬ সালে এরই একটা রাইফেল অবসান ঘটিয়েছিল রুদ্রপ্রয়াগের চিতাবাঘের আতঙ্কের। গর্তটা বেশ গভীর করে খোঁড়ার পর সাহেব একবার দেখে নিলেন। হাতে তুলে নিলেন একটা একটা করে আগ্নেয়াস্ত্র। পরম আদরে চুমু খেলেন। তারপর নিজের সন্তানের মতো যত্নে সেগুলোকে একে একে নামিয়ে দিলেন গর্তের মধ্যে। রাম সিংহ হাউহাউ করে কাঁদছিল। সাহেব ওর মাথায় হাত রাখলেন। গর্তটা ভরাট করা হল। সাহেব এ বার নৈনিতালের গার্নি হাউস-এর দিকে পা বাড়ালেন দুই সঙ্গীকে নিয়ে।

শিকার করা, শিকার-কাহিনি লেখা ছাড়াও তিনি লিখেছেন ‘মাই ইন্ডিয়া’র মতো বই। যে বইয়ের ছত্রে ছত্রে মিলবে ব্রিটিশ রাজের গুণকীর্তন নয়, দুঃখী ভারতবাসীর কথা। তাঁর মৃত্যুর সাত দশক পরে তাই বারবারই প্রশ্ন গুঞ্জরিত হয়— জিম যদি ভারতবর্ষকে এতটাই ভালবেসে থাকেন, তবে কেন ‘বাণপ্রস্থ’ নিয়ে আফ্রিকায় চলে গেলেন তিনি? তাঁর গুণমুগ্ধ পাঠকেরা প্রশ্ন না তুললেও নামজাদা কিছু শিকারি কিন্তু সন্দেহের কাঁটা বিদ্ধ করতে ছাড়েননি জিম করবেটকে।

ধৃতিকান্ত লাহিড়ী চৌধুরীর একটি লেখায় পাই ১৯৫৬ সালে নৈনিতালে গিয়ে মিস্টার বেনসন নামে এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান শিকারির দেখা পান তিনি। জিমের খ্যাতি তখন তুঙ্গে। বই বিক্রি হচ্ছে হু হু করে। জানা গেল, বেনসন জিমের থেকেও বেশি সংখ্যায় বাঘ মেরেছেন এবং ভারত সরকার নরখাদকের উপদ্রব হলেই তাঁকে ডাকেন।

এই সাহেবের কাছে জিম করবেটের নাম করতেই বিদ্রুপের স্বরে তিনি বলে উঠলেন— ‘ইয়েস করবেট। হি রাইটস আ লট। হাঃ হাঃ হাঃ।’ অর্থাৎ জিমের লেখায় অনেক জল আছে। আর তাতেই তাঁর জনপ্রিয়তা। শুধু বেনসন নয়, ভারতে ব্যাঘ্র প্রকল্পের প্রথম অধিকর্তা কৈলাস সাংখালাও জিম করবেটকে প্রকারান্তরে ধাপ্পাবাজ বলতে ছাড়েননি।

জিমের জোর তাঁর মিতকথন ও অরণ্যের প্রতি, অরণ্যসংলগ্ন সকল প্রাণীর প্রতি একশো শতাংশ প্রেম। কয়েক বছর ধরে মাইলের পর মাইল দৌড় করানো রুদ্রপ্রয়াগের চিতা যে দিন তাঁর রাইফেলের গুলিতে মারা পড়ল তখন তাঁর লেখায় কোথাও নেই জয়ীর গর্ব। সাফল্যের উল্লাস।

শুধু তাঁর মনে হল, নিরীহ দরিদ্র পাহাড়ি মানুষগুলোকে নরখাদকের আতঙ্ক থেকে তিনি মুক্তি দিতে পেরেছেন। এটা ছিল তাঁর ‘কর্তব্য’।

নিরাবেগ কলমের আঁচড়ে জিম লিখছেন— ‘রাত দশটায় গুলি চালিয়েছি। কয়েক ঘণ্টা পরে চাঁদ উঠল। গাছের মগডালে উঠলাম, কিন্তু ছড়ানো ডালপালার জন্য ঠিক দেখতে পেলাম না। আবার মাচানে নামলাম। কিন্তু এখান থেকেও পাহাড়ের যে দিকে চিতা বাঘটা গেছে বলে মনে হল সে দিকটা দেখা যাচ্ছিল না। তখন বাজে রাত তিনটে। দু’ঘণ্টা পরে চাঁদ অস্ত যেতে থাকল। গাছ থেকে নামলাম। ছাগলটা বন্ধুসুলভ গলায় ডেকে আমাকে অভ্যর্থনা করল। ছাগলটার পিছনে একটা লম্বা পাথরের ওপর এক ইঞ্চি চওড়া রক্তের দাগ। যে সতর্কতা সাধারণত মাংসাশী পশুর রক্তের দাগ অনুসরণ করতে অবলম্বন করতে হয়। আমি তা উড়িয়ে দিলাম। রাস্তা থেকে নামলাম, পাথরের অন্য পাশে রক্তের দাগ দেখলাম। পঞ্চাশ গজ অবধি অনুসরণ করলাম। দেখলাম চিতাবাঘটা মরে পড়ে আছে।

শনাক্ত করার মতো কোনও দাগ দেখা যাচ্ছিল না। তবুও আমার এক মুহূর্তের জন্যও সন্দেহ হয়নি যে এটাই সেই নরখাদক। এ কোনও পিশাচ নয় যে রাতের প্রহর ধরে আমাকে লক্ষ করছে।

ওকে কাবু করার ব্যর্থ প্রচেষ্টায় নিঃশব্দ পৈশাচিক হাসিতেও গড়াগড়ি দিয়েছে। সেই সুযোগের আশায় ঠোঁট চেটেছে, যখন আমাকে অসতর্ক অবস্থায় পেয়ে আমার গলায় দাঁত বসাবে।

এখানে পড়ে আছে একটা বুড়ো চিতাবাঘ। ভারতে সবার চেয়ে ঘৃণ্য ও সন্ত্রাস সঞ্চারকারী জন্তু। যার একমাত্র অপরাধ প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে নয়, কিন্তু মানুষের নিয়মের বিরুদ্ধে— সে মানুষের রক্তপাত করেছে। মানুষকে আতঙ্কিত করার জন্য নয়, শুধু নিজের প্রাণরক্ষার জন্য। সে এখন গর্তের ধারে থুতনি রেখে শুয়ে আছে। চোখ দুটি আধবোজা, তার শেষ ঘুমে শান্তিতে মগ্ন।’

ভারতে দেশিয় রাজন্যদের ‘শিকার খেল’ নতুন কিছু নয়। এ দেশে ব্রিটিশরাজ কায়েম হওয়ার পর লাট-বেলাটের দলও শৌর্যের প্রতীক হিসাবে বিরাট দলবল নিয়ে গিয়ে অরণ্যে শ্বাপদ নিধনে মেতেছেন। পরবর্তী জীবনে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ নিয়ে উঠেপড়ে লাগলেও তথ্য হিসাবে উল্লেখ করা দরকার যে এমন শিকারে রাজপুরুষদের সঙ্গ দিতে হয়েছে জিমকেও।
‘ডোমিসাইল্ড ইংলিশ’ জিম নিজের প্রভাব বাড়াতে রাজপুরুষদের তুষ্ট রাখতে চাইতেন এমন কথাও উঠেছে। তবে জিম ব্যাপারটা যে পরবর্তী জীবনে প্রসন্ন চিত্তে মানতে পারেননি সেটাও সত্য।

জিমের নামেই এ দেশে প্রথম ন্যাশনাল পার্ক। ১৯৫৭ সালের আগে ছিল হেলির নামে। অরণ্য ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ নিয়ে যাঁরা চর্চা করেন তাঁদের অনেকেই আজ মনে করেন ভারতে এই সংরক্ষণের অগ্রপথিক জিম করবেটই। তবে ভুলে গেলে চলবে না যে জিমের আগে সংরক্ষিত অরণ্যের প্রস্তাব দিয়েছিলেন দুই ব্রিটিশ ফরেস্ট অফিসার। ই আর স্টিভেন্স এবং তারপর ই এ স্মাইথস। যথাক্রমে ১৯১৬ এবং ১৯১৭ সালে। কিন্তু তদানীন্তন ব্রিটিশ রাজপুরুষ পারসি উইন্ডহ্যাম সে প্রস্তাব অগ্রাহ্য করেন।

জিম করবেটকে নিয়ে বিতর্ক থাক। তবে তাঁর মৃত্যুর দীর্ঘ সত্তর বছর পর জিমের রচনা ও তাঁর জীবনী নতুন করে নেড়েঘেঁটে মনে হচ্ছে ‘কার্পেট সাহেব’-কে নিয়ে নতুন করে চর্চা হওয়া প্রয়োজন। শুধু শিকার-কাহিনির লেখক হিসাবে জিমের পরিচয় খণ্ডাংশ মাত্র। তিনি ভারতের ‘বাঘ্র সংরক্ষণ’-এর অগ্রদূত। বন্যপ্রাণীদের পরমাত্মীয়।