দিঘায় জগন্নাথ মন্দির: মমতার স্বস্তি, বিজেপির অস্বস্তি

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

পুলক মিত্র

এই মুহূর্তে রাজ্য রাজনীতির সবচেয়ে বর্ণময় চরিত্র হয়ে উঠেছেন বিজেপির প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি তথা প্রাক্তন সাংসদ দিলীপ ঘোষ। বেফাঁস মন্তব্যের জন্য হামেশাই খবরের শিরোনামে আসা এই বিজেপি নেতা রাজ্য সরকারের আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে সস্ত্রীক শুধু জগন্নাথ মন্দিরই দর্শন করেননি, সেইসঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ কথাও বলেছেন, যা পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে নয়া বিতর্ক তৈরি করেছে।

বিভিন্ন সময়ে মমতাকে যিনি কঠোর ভাষায় আক্রমণ করে থাকেন, সেই দিলীপবাবুকে তৃণমূল নেত্রীর সঙ্গে পাশাপাশি বসে গল্প করতে দেখে বেজায় চটেছেন রাজ্য বিজেপির শীর্ষ নেতারা। কেউ কেউ প্রশ্ন করছেন, দিলীপ ঘোষ কি তৃণমূলে যোগ দিতে চলেছেন? দিলীপবাবু অবশ্য তৎক্ষণাৎ জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি রাজনীতি ছাড়তে পারেন, কিন্তু কখনই বিজেপি ছাড়বেন না। তবে জগন্নাথ মন্দিরের উদ্বোধনী দিনে বিজেপির এই দাপুটে নেতার হাজিরা নিয়ে আগামী বেশ কিছুদিন ধরে বাংলার রাজনীতিতে যে জলঘোলা চলতে থাকবে, তা বলাই বাহুল্য।


আসলে দিঘায় সরকারি উদ্যোগে জগন্নাথ মন্দির নির্মাণ নিয়ে যতই বিতর্কের ঝড় ওঠুক, এই মন্দির তৈরির মাধ্যমে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আবারও বুঝিয়ে দিলেন, রাজনৈতিক পরিপক্কতায় তিনি কেন অন্যদের, বিশেষত বিজেপির চেয়ে কয়েক কদম এগিয়ে। পশ্চিমবঙ্গে পরবর্তী বিধানসভা নির্বাচনের এক বছর আগে এই মন্দিরের উদ্বোধন করে তিনি এক ঢিলে অনেকগুলি পাখি মেরেছেন।

৩০ এপ্রিল এই মন্দিরের উদ্বোধনের দিনেই কাঁথিতে পাল্টা “সনাতনী সম্মেলন”-এর ডাক দিয়েছিলেন রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী, যা কার্যত কোনও নজরই কাড়তে পারেনি। সেখানে তিনি সদম্ভে ঘোষণাও করে দিয়েছেন, দিঘার জগন্নাথ মন্দিরে তিনি কখনই পা রাখবেন না। অন্যদিকে, তারই দলের নেতা দিলীপ ঘোষ সস্ত্রীক উপস্থিতি এতে অন্যমাত্রা যুক্ত করেছে। বলতে গেলে, মিডিয়ায় প্রচারের আলো কেড়ে নিয়েছেন দিলীপবাবু।

স্থানীয় বাসিন্দারা তো বটেই, এই মন্দিরকে ঘিরে পর্যটকদের মধ্যেও বাড়তি উৎসাহ তৈরি হয়েছে। মন্দির উদ্বোধনের দিনেই তা বোঝা গিয়েছে। সেদিন সন্ধ্যায় জগন্নাথ দেব দর্শনে মন্দিরে ভিড় করেছেন কাতারে কাতারে মানুষ। মন্দিরকে ঘিরে আশার আলো দেখছেন ব্যবসায়ীরা। দিঘা রাজ্যের এক উল্লেখযোগ্য পর্যটন কেন্দ্র। এখানে গড়ে উঠেছে অজস্র হোটেল, রেস্তোরাঁ। স্থানীয় পর্যটন ব্যবসায়ী, হোটেল মালিক, রেস্তারাঁ মালিকরা মনে করছেন, এই মন্দির তৈরির ফলে এখানকার পর্যটন ব্যবসায় আরও চাঙ্গা হবে।

রাজ্যের মানুষ তো বটেই, জগন্নাথ মন্দিরের টানে এখন দিঘায় ছুটে আসবেন বিদেশি পর্যটকরাও। মন্দিরটির পরিচালনায় দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ইসকনকে। গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে রয়েছে ইসকনের কোটি কোটি ভক্ত। উদ্বোধনের দিনেই তার কিছুটা আঁচ পাওয়া গেছে। সেই ভক্তরাও এবার দিঘায় ভিড় করবেন, এমনটাই আশা এখানকার ব্যবসায়ীদের।

দিঘা এখন আর শুধুমাত্র একটি পর্যটন স্থল নয়, এর একটি ধর্মীয় পরিচয়ও গড়ে উঠেছে। দিঘা আর পুরীর মধ্যে কেউ কেউ তুলনা টানছেন। সেই প্রসঙ্গে না গিয়েও বলা যায়, পুরীর সঙ্গে টেক্কা দেওয়ার জন্য দিঘায় জগন্নাথ মন্দির তৈরি করা হয়নি। দুটিরই আলাদা আলাদা তাৎপর্য রয়েছে। কিন্তু ধর্মপ্রেমী মানুষ পুরীর মতো দিঘাতেও ভিড় জমাবেন, এমনটি বলা যেতেই পারে। তাছাড়া, দিঘা আর পুরীর মধ্যে ভৌগোলিক দূরত্বও বেশি নয়। তাই পুরীর মানুষও দিঘার এই মন্দির দর্শনে আসবেন।

বলতে গেলে, বিগত কয়েক বছরে দিঘা আমুল বদলে গিয়েছে। দিঘা এখন দেশের যে কোনও প্রথম সারির পর্যটন কেন্দ্রের সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে। সুন্দর প্রশস্ত রাস্তা, আধুনিক বিলাসবহুল হোটেল, বড় বড় রেস্তোরাঁ, আলো ঝলমলে সমুদ্র সৈকত, সবকিছু মিলিয়ে এ যেন এক অন্য দিঘা, যার কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জগন্নাথ মন্দির দিঘার মুকুটে এখন এক নতুন পালক যুক্ত করেছে। আকারে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের এই মন্দির অনেকটাই বড়। মন্দিরের বাইরের অংশ পুরীর জগন্নাথ মন্দিরের আদলে হলেও, এর ভিতরের সজ্জা নজর কাড়ার মতো।

এবার আসা যাক বিজেপির অস্বস্তির প্রসঙ্গে। মন্দির নির্মাণ নিয়ে আগেই রাজ্য সরকারকে বারেবারে নিশানা করেছে বিজেপি। এবার সেই মন্দিরে দিলীপের পদার্পণ গেরুয়া শিবিরে রীতিমতো গৃহযুদ্ধ বাঁধিয়ে দিয়েছে। একদিকে দিলীপ ঘোষ, অন্যদিকে, শুভেন্দু সহ অন্য নেতারা। মুহূর্তে মুহূর্তে তাঁদের আক্রমণের লক্ষ্য হচ্ছেন দিলীপবাবু। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের এক সময়ের সেবক দিলীপবাবু জানতেন তাঁর উপস্থিতি নিয়ে যথেষ্ট জলঘোলা হবে। তাই তিনিও এক ইঞ্চি জমি ছাড়তে নারাজ। তাঁর আক্রমণের মূল লক্ষ্য হচ্ছেন শুভেন্দু।

শুভেন্দুর নাম না চাঁচাছোলা ভাষায় তাঁকে নিশানা করেছেন দিলীপ। বলেছেন, “মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আঁচলের ছায়ায় যাঁরা বড় হয়েছেন, তাঁদের কাছ থেকে দিলীপ ঘোষ বিজেপি শিখবে না! যাঁরা কালীঘাটের উচ্ছিষ্ট খেয়েছেন, আজ বিজেপির উচ্ছিষ্ট খেয়ে বেঁচে আছেন, তাঁরা দিলীপকে ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট দিচ্ছেন।” তিনি আরও বলেছেন, “অন্য দল থেকে বিজেপিতে অনেকে কামাতে এসেছেন। বিজেপি এখন দোকান হয়ে গিয়েছে! পুরনো বিজেপির স্বাদ-গন্ধ কিছু নেই।”

২০১৬ সালে প্রথম বার বিধানসভা নির্বাচন লড়ে বিধায়ক হয়েছিলেন দিলীপ। ২০১৯ সালে প্রথম বার লোকসভা নির্বাচনে দাঁড়িয়েই সাংসদ হন তিনি। এরপর ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন। জেতা আসন মেদিনীপুর থেকে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এর পিছনে শুভেন্দুর হাত ছিল বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা। রাজ্য বিজেপিতে দিলীপ এবং শুভেন্দুর মধ্যে সম্পর্ক কখনই মসৃণ ছিল না। এখন তা প্রকাশ্যে আরও তিক্ত চেহারা নিল, যা তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছে তৃণমূল শিবির।

তবে দিঘার জগন্নাথ মন্দির পূর্ব মেদিনীপুরে শুভেন্দুর রাজনৈতিক ভিত্তি অনেকটাই দুর্বল করে দেবে, এমনটা আঁচ করতে পারছেন শিশির-পুত্র। অন্যদিকে, দিঘার জগন্নাথ মন্দিরে কখনো পা রাখবেন না, একথা ঘোষণা করে তিনি কার্যত দিঘার মানুষের ভাবাবেগে আঘাত দিয়েছেন। তবে এই মুহূর্তে বিজেপি বা আরএসএস, কেউই দিলীপকে খুব বেশি ঘাঁটাবে বলে মনে হয় না। কারণ দিলীপের জনভিত্তি এবং দলের পুরনো নেতাকর্মীদের মধ্যে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা।

দিলীপের সঙ্গে রাজ্য নেতৃত্বের এই সংঘাত বিজেপির অন্দরমহলে অস্বস্তির বাতাবরণ তৈরি করলেও, দিঘার জগন্নাথ মন্দিরের হাত ধরে তৃণমূলে এখন বইছে স্বস্তির হাওয়া। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, জগন্নাথ মন্দির হল মমতার মাস্টারস্ট্রোক এবং মমতা জানেন, খেলাটা কখন, কীভাবে খেলতে হয়।