বর্তমান বিশ্বে ভয়ঙ্কর একটি সত্য হলো তথ্য মাধ্যমের শক্তি। এখন বিশ্বের সবচেয়ে প্রভাবশালী তথ্যমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নিয়ন্ত্রণ চলে গিয়েছে মাত্র কয়েকজন ব্যক্তির হাতে। তাঁরাই বিশ্বে শীর্ষে প্রযুক্তি ধনকুবেরদের তালিকায় রয়েছেন। চার শীর্ষ ধনী এখন এমন সব প্রতিষ্ঠানের মালিক বা প্রধান বিনিয়োগকারী, যা বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি মানুষের মতামত ও সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করে। প্রযুক্তি ও বাণিজ্যের জগৎ ছাড়িয়ে গণমাধ্যমের ওপর এই নজিরবিহীন নিয়ন্ত্রণ জনমনে গণতন্ত্র, তথ্যের স্বাধীনতা এবং মতপ্রকাশের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীর উদ্বেগ ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
সম্প্রতি ব্লুমবার্গ বিলিয়নিয়ারস ইনডেক্স এবং অন্যান্য সংবাদ মাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের তালিকার শীর্ষে রয়েছেন ইলন ম্যাস্ক (টেসলা, স্পেসএক্স), ল্যারি এলিসন (ওরাকল), মার্ক জুকেরবার্গ (মেটা) ও জেফ বেজোস (অ্যামাজন)। অবশ্য এই তালিকায়, বিশেষ করে প্রথম দু’টি স্থানে প্রায়ই পরিবর্তন দেখা যায়। তবে বার্ষিক তালিকার দিকে তাকালে একটি নির্দিষ্ট চিত্র পাওয়া যায়। ফোর্বস ম্যাগাজিনের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত তালিকা অনুযায়ী, বিশ্বের শীর্ষ চার ধনী ব্যক্তি ও তাঁদের আনুমানিক সম্পদের পরিমাণ ছিল নিম্নরূপ: ১) ইলন মাস্ক (৩৪২ বিলিয়ন ডলার), ২) মার্ক জুকেরবার্গ (২১৬ বিলিয়ন ডলার), ৩) জেফ বেজোস (২১৫ বিলিয়ন ডলার) এবং ল্যারি এলিসন (১৯২ বিলিয়ন ডলার) এই চার শীর্ষ ধনী ব্যক্তিই এখন শীর্ষস্থানীয় চারটি গণমাধ্যমের নিয়ন্ত্রক। নিচে এঁচের সম্পর্কেই একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ তুলে দেওয়া হলো।
জেফ বেজোস ও দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট। অ্যামাজন ও ব্লু অরিজিনের প্রতিষ্ঠাতা জেফ বেজোস ২০১৩ সালে ২৫০ বিলিয়ন ডলারে কিনে নেন আমেরিকার অন্যতম প্রভাবশালী পত্রিকা ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’। বেজোসের বিপুল অর্থ ও প্রযুক্তিগত জ্ঞান পত্রিকাটিকে ডিজিটাল যুগে ঘুরে দাঁড়াতে সাহায্য করলেও এর সম্পাদকীয় স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।
সমালোচকদের মতে, বেজোসের ব্যবসায়িক স্বার্থের সঙ্গে সংঘাত লাগতে পারে এমন কোনও সংবাদ ওয়াশিংটন পোস্ট কতটা নিরপেক্ষভাবে প্রকাশ করতে পারে, তা একটি বড় উদ্বেগের বিষয়।
ইলন মাস্ক ও এক্স (টুইটার)। টেসলা ও স্পেসএক্সের প্রধান নির্বাহী ইলন মাস্ক ২০২২ সালে ৪৪ বিলিয়ন ডলারে কিনে নেয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ট্যুইটার, যার নতুন নাম এখন ‘এক্স’। মাস্কের দাবি, তিনি বাক্ স্বাধীনতা রক্ষার জন্য এই প্ল্যাটফর্ম কিনেছেন। কিন্তু বাস্তবে এক্সের প্রচার এখন সরাসরি তাঁর নিয়ন্ত্রণে। কোন খবর বা মতামত বেশি প্রচার পাবে এবং কোনটি মুছে দেওয়া হবে, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এখন মাস্কের হাতে। তাঁর ব্যক্তিগত এবং ব্যাবসায়িক এজেন্ডা যে এই প্ল্যাটফর্মের তথ্যপ্রবাহকে প্রভাবিত করতে পারে, তা নিয়ে বিশ্বজুড়ে বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন।
মার্ক জুকেরবার্গ ও মেটা: মার্ক জুকেরবার্গ সরাসরি কোনও সংবাদমাধ্যম কেনেননি, কিন্তু তাঁর প্রতিষ্ঠিত মেটা প্ল্যাটফর্মস (ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম ও হোয়াটসঅ্যাপ) এখন বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের কাছে সংবাদ পৌঁছনোর প্রধান মাধ্যম। বিশ্বের তথ্যপ্রবাগের উপর তাঁর যে পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে, তা কোনো কোনো ক্ষেত্রে সরাসরি মালিকানার চেয়ে বেশি শক্তিশালী।
ল্যারি এলিসন এবং ট্যুইটার ও টিকটক। ওরা কলের সহ প্রতিষ্ঠাতা ল্যারি এলিসন সরাসরি কোনও সংবাদমাধ্যম কেনেননি, কিন্তু তিনি ভিন্ন উপায়ে গণমাধ্যমের উপর প্রভাব বিস্তার করেছেন। ইলন মাস্ক যখন টুইটার (বর্তমান এক্স) কেনেন, তখন এলিসন ছিলেন অন্যতম প্রধান বিনিয়োগকারী। তিনি ১ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছিলেন। এই বিপুল আর্থিক সহায়তা মাস্ককে প্ল্যাটফর্মটি অধিগ্রহণ করতে সাহায্য করে।
বিশ্লেষকদের মতে, সরাসরি মালিক না হয়েও এলিসন গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিনিয়োগের মাধ্যমে পরোক্ষভাবে তথ্যের প্রবাহকে প্রভাবিত করার ক্ষমতা রাখেন। তাঁর এই ভূমিকা দেখিয়ে দেয়, গণমাধ্যমের উপর ধনকুবেরদের প্রভাব কেবল সরাসরি মালিকানার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চিনা বাইটড্যান্সের চুক্তির ফলে ল্যারি এলিসন সরাসরি টিকটকের মালিক না হলেও তাঁর কোম্পানি ওরাকলের মাধ্যমে তিনি এই প্রভাবশালী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ওপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পাচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় ব্যাপক প্রভাব বিস্তারের সুযোগ পাচ্ছেন। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উদ্বেগের কারণে বাইটড্যান্সকে টিকটকের মার্কিন কার্যক্রম বিক্রি বা আলাদা করার নির্দেশ দেওয়া হয়। এই প্রেক্ষাপটে ওরাকল একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। যেমন—প্রযুক্তিগত অংশীদারিত্বের ক্ষেত্রে ওরাকল টিকটকের মার্কিন ব্যবহারকারীদের সমস্ত ডেটা তাদের ক্লাউড পরিকাঠামোতে সংরক্ষণ ও পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে।
চুক্তির অধীনে ওরাকল টিকটকের মূল রিকমেন্ডেশন অ্যালগরিদমটি তদারকি করবে। এর উদ্দেশ্য হলো প্ল্যাটফর্মের কনটেন্ট প্রবাহ যেন কোনও বিদেশি স্বার্থ দ্বারা প্রভাবিত বা ম্যানিপুলেট না হয়, তা নিশ্চিত করা।
ল্যারি এলিসন একটি মার্কিন কনসোর্টিয়ামের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যা টিকটকের নতুন মার্কিন ইউনিটের একটি বড় অংশ (প্রায় ৮০ শতাংশ) অধিগ্রহণ করবে বলে জানা গিয়েছে। সুতরাং ল্যারি এলিসন তাঁর প্রযুক্তি সংস্থা ওরাকলকে কাজে লাগিয়ে টিকটকের ভবিষ্যৎ নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় ভূমিকা রাখছেন। মিডিয়া বিশ্লেষকদের মতে, এই প্রভণতা অত্যন্ত বিপজ্জনক।
সবচেয়ে প্রভাবশালী চার মিডিয়ার লাগাম এখন চার শীর্ষস্থানীয় ধনীর হাতে।