নপরাজিত মুখোপাধ্যায়
ভারত–বাংলাদেশ সীমান্তে অনুপ্রবেশ নিয়ে গণমাধ্যমে প্রচুর আলোচনা হয়ে থাকে; প্রধানত বলা হয় বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীরা ভারতে ঢুকছে। তারা কাজের সন্ধানে আসে এবং সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। দিল্লি, মুম্বাই, বেঙ্গালুরু বা ভারতের অন্য বড় শহরে কোনো বাঙালি শ্রমজীবী নারী-পুরুষকে দেখলেই তাকে বাংলাদেশি বলা হয় এবং দুর্ব্যবহার করা হয়। রাজনীতিবিদরা প্রায়ই এই বিষয়টি প্রতিপক্ষকে বদনাম করতে ব্যবহার করেন। পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকারের সময় বিরোধীরা নিয়মিত অভিযোগ করত যে শাসকদল অনুপ্রবেশকে উৎসাহ দিচ্ছে, রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড এবং অন্যান্য সুবিধা দিচ্ছে যাতে এই অনুপ্রবেশকারীরা আমাদের সমাজে মিশে যেতে পারে।
অভিযোগ ছিল, এভাবে তাদের শেষ লক্ষ্য হল শাসকদলের অনুগত ভোটার হিসেবে এই মানুষদের অন্তর্ভুক্ত করা। এখন পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি একই ধরনের আওয়াজ তুলছে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। সম্প্রতি বিহার নির্বাচনে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ঘোষণা করেন যে, বিহারকে অনুপ্রবেশকারী বা ‘ঘুসপেঠিয়া’দের থেকে মুক্ত করা হবে। এইভাবে রাজনৈতিক তির্যক কথাবার্তা চলতেই থাকে। এই শোরগোলের মধ্যে আমরা ভুলে যাই— ভারত–বাংলাদেশ সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব কার, তারা আদৌ কাজ করছে কি না এবং লোকসভা-বিধানসভার মাধ্যমে তারা ভারতের জনগণের কাছে কতটা দায়বদ্ধ।
১৯৪৭ সালে ভারত–পাকিস্তান বিভাজন ঘটে, যখন র্যাডক্লিফ অত্যন্ত নির্বিচারে মানচিত্রে রেখা টেনে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সীমানা ঠিক করেন। ল্যারি কলিন্স ও ডমিনিক লা পিয়ের তাঁদের বিখ্যাত বই ‘ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট’-এ লিখেছেন, “সার্জনের সূক্ষ্ম ছুরি ব্যবহার না করে র্যাডক্লিফ যেন বিশাল করাত দিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের সীমানা কেটে দিয়েছিলেন।” এই মন্তব্য থেকেই বোঝা যায় বিভাজন কতটা ত্রুটিপূর্ণ ছিল এবং এর ফলে সীমান্তবর্তী মানুষের জীবনে কী প্রভাব পড়েছিল। জানা যায়, অনেক বাড়ির উঠান বাংলাদেশে আর রান্নাঘর ভারতে পড়েছে। বিশ শতকের শেষ দশকে সীমান্তে বেড়া দেওয়ার পরে সমস্যাটি আরও বেড়ে যায়। এটি করা হয়েছিল অত্যন্ত অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে। অনেক ভারতীয় গ্রাম যেমন বেড়ার বাইরে, তেমনি আবার অনেক ভারতীয় চাষির চাষের জমি বেড়ার বাইরে পড়ে গেছে। এতে বড় সমস্যা তৈরি হয়েছে— বিএসএফ গেট করেছে, গ্রামবাসীদের পাস দিয়েছে, কিন্তু ভারতীয় নাগরিক হয়েও গ্রামবাসীরা নানা ধরনের হয়রানির অভিযোগ করেন। মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলি অভিযোগ করেছে— জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন এমন গর্ভবতী ভারতীয় মহিলাদেরও কখনও কখনও বিএসএফ হয়রানি করেছে এবং ভারতীয় হাসপাতালে যেতে বাধা দিয়েছে। এ ধরনের অভিযোগ আরও অনেক রয়েছে। অন্যদিকে বিএসএফ-এর অভিযোগ— চোরাচালানসহ নানা অপরাধমূলক কাজের কারণেই এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে হয়।
ভারত–বাংলাদেশ সীমান্তের দৈর্ঘ্য ২৫০০ কিলোমিটারের বেশি, যার মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ (১২০০ কিমি), আসাম, ত্রিপুরা ও মেঘালয়ের অংশ রয়েছে। সবচেয়ে বড় অংশ পড়ে পশ্চিমবঙ্গের সীমানা জুড়ে। পশ্চিমবঙ্গে প্রায় ২৭২ কিলোমিটার সীমান্ত সম্পূর্ণ নদীনির্ভর, যেখানে বেড়া দেওয়া অসম্ভব। এর মধ্যে রয়েছে সুন্দরবন, উত্তর ২৪ পরগনার টাকি, বসিরহাট ইত্যাদি অঞ্চল। নদীপথে সীমিত টহল ছাড়া এই অংশে সীমান্ত রক্ষার কোনো বাস্তব উপায় নেই। আশ্চর্যের বিষয়, নদীর প্রকৃতির কারণে ভারত–বাংলাদেশ সীমান্তের প্রথম কাস্টমস চেকপোস্ট ভারতের ভেতরে প্রায় ৭০ কিলোমিটার দূরে ফ্রেজারগঞ্জে।
স্বাধীনতার পর, যখন বাংলাদেশ ছিল পূর্ব পাকিস্তান, তখন সীমান্ত পাহারা দিত পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের স্পেশাল আর্মড পুলিশ। সে সময় অবৈধ অনুপ্রবেশের প্রায় কোনো খবর ছিল না, বরং পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের গুলিবর্ষণের খবর বেশি শোনা যেত। ১৯৬৫ সালে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিএসএফ সীমান্তরক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়। তার পর থেকেই নানা সমস্যা শুরু হয় এবং আজও চলছে। সমস্যাগুলি হল— অনুপ্রবেশ, মানবপাচার, চোরাচালান, অস্ত্রচোরাচালান এবং কখনও কখনও চরমপন্থী বা জঙ্গিদের যাতায়াত। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের জন্মের পর পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে ওঠে। ১৯৭২ সালে ইন্দিরা–মুজিব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেখানে দুই দেশের নাগরিকদের চলাচল সংক্রান্ত একটি ধারা খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। বাংলাদেশি নাগরিকরা বৈধ ভিসা নিয়ে ভারতে প্রবেশ করলে ছয় মাসের মধ্যে ফরেনার্স রেজিস্ট্রেশন অফিস বা বিদেশি নিবন্ধন দফতরে নাম নথিভুক্ত করতে হয় না। অন্য দেশের নাগরিকদের ক্ষেত্রে এক সপ্তাহের মধ্যে এটি বাধ্যতামূলক। পাকিস্তানিদের ক্ষেত্রে ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই করতে হয় এবং ভিসায় উল্লেখিত পয়েন্ট ছাড়া অন্য কোথাও যেতে হলে এফআরও-র অনুমতি লাগে। বাংলাদেশের নাগরিকদের এই ছাড়ের ফলে তারা বৈধভাবে ভারতে ঢুকেই সহজে অদৃশ্য হয়ে যাওয়ার প্রচুর সুযোগ পায়! আমরা এই বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে শুধুই অনুপ্রবেশ নিয়ে শোরগোল করি।
এরপর আসে ভারত–বাংলাদেশ সীমান্ত রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন। এই দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে বিএসএফ-এর, যা কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীনে। পশ্চিমবঙ্গের মতো রাজ্যের এখানে কোনো ভূমিকা নেই। সাম্প্রতিক সংশোধনে বিএসএফ-এর এক্তিয়ার শূন্যরেখা থেকে ভারতের ভেতরে ৫ কিলোমিটার থেকে বাড়িয়ে ৫০ কিলোমিটার করা হয়েছে। এতে রাজ্যগুলির আপত্তি ছিল, তারা মনে করেছে এটি রাজ্যের এক্তিয়ারে হস্তক্ষেপ; কিন্তু কেন্দ্র তাদের সিদ্ধান্তে অনড় ছিল। যুক্তি দেওয়া হয়— এতে অনুপ্রবেশ, গরু পাচার, অস্ত্র পাচার ইত্যাদি রোধে বিএসএফ আরও কার্যকর হবে। প্রশ্ন থেকেই যায়— আমাদের একমাত্র সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ তাদের দায়িত্ব কতটা সফলভাবে পালন করছে। অস্ত্র, মাদক, সোনা, জাল নোট উদ্ধার, মানবপাচারকারী ও জঙ্গি চক্র ধরার পরিসংখ্যান সাধারণ মানুষের জানা নেই। শুধু অবৈধ প্রবেশকারী এবং কথিত রোহিঙ্গা আটক সম্পর্কিত কিছু তথ্যই মাঝে মাঝে প্রকাশ পায়।
আগে কেন্দ্র-রাজ্য সহযোগিতায় BADP বা বর্ডার এরিয়া ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট নামে একটি তহবিল ছিল। এই অর্থে স্বাস্থ্যকেন্দ্র, লাইব্রেরি, অ্যাম্বুলেন্স, প্রাথমিক স্কুল এবং সীমান্ত সড়ক নির্মাণ করা হত। জানা যায় কেন্দ্রের আর্থিক সংকটের কারণে এই প্রকল্প বন্ধ হয়েছে। আরেকটি ভালো উদ্যোগ ছিল সীমান্তবর্তী জেলার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, পুলিশ সুপার এবং বিএসএফ ব্যাটালিয়নের কমান্ড্যান্টদের নিয়মিত বৈঠক, যা এখন প্রায় বন্ধ। একইভাবে ভারত–বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী জেলার ডিএম-দের দুই বছরে একবার হওয়ার কথা ছিল, এমন বৈঠকও এখন আর হয় না। ফলে বহু গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা অমীমাংসিত থেকে যায়। আরও একটি বড় সমস্যা ছিল কোচবিহারের ছিটমহল। ২০১২ সালে এক ছিটমহলে খুনের ঘটনা ঘটলে কোচবিহার পুলিশকে সেখানে প্রবেশ করতে বাংলাদেশের অনুমতি পেতে প্রায় দুই সপ্তাহ অপেক্ষা করতে হতো। কারণ সেই ছিটমহলে পৌঁছতে বাংলাদেশি ভূখণ্ড ব্যবহার করতে হতো।
দুঃখজনক যে, এত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কখনোই লোকসভা, রাজ্যসভা বা বিধানসভায় বিশদ আলোচনার বিষয় হয় না। গণমাধ্যমে আমরা দেখি, রাজনীতিবিদেরা একে অপরকে অনুপ্রবেশ উৎসাহিত করার অভিযোগে দোষী করেন, কিন্তু অনুপ্রবেশ ঠেকানোর দায়িত্বে থাকা বিএসএফ-এর ভূমিকা নিয়ে কথা হয় না। গত বছর সিবিআই এক বিএসএফ কমান্ড্যান্টকে চোরাচালান চক্রে যুক্ত থাকার অভিযোগে গ্রেপ্তার করেছিল, তারপর আর কিছু জানা যায়নি। একবার এক সিনিয়র বিএসএফ কর্মকর্তাকে দুই বছরে কত অস্ত্র বা বিস্ফোরক উদ্ধার হয়েছে— এই প্রশ্ন করলে তিনি সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেননি। ২০১১ সালে কলকাতায় এক জঙ্গি গ্রেপ্তার হয়েছিল। জিজ্ঞাসাবাদে সে জানিয়েছিল, ভারত–নেপাল সীমান্ত দিয়ে ভারতে ঢুকে পরে পেট্রাপোল-বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে গিয়েছিল। প্রশ্ন থেকেই যায়, এটা কীভাবে সম্ভব?
সুতরাং মূল কথা হল, ভারত–বাংলাদেশ সীমান্ত সমস্যা অত্যন্ত গুরুতর। এখানে আমলাতন্ত্র এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিশেষত সীমান্তরক্ষী বিএসএফ-এর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এটি কোনো রাজনৈতিক দলবাজির বিষয় নয়,দেশের নিরাপত্তার প্রশ্ন। এই মুহূর্তে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কঠোর জবাবদিহি নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি।
(লেখক রাজ্য পুলিশের প্রাক্তন ডিজি)