বিক্ষোভে আদিবাসীরা

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

ব্রাজিলের বেলেমে রাষ্ট্রসঙ্ঘের উদ্যোগে ৩০তম জলবায়ু পরিবর্তন শীর্ষ সম্মেলন (কপ-৩০) চলছে। এরই মধ্যে কপ-৩০ সম্মেলন চত্বরের বাইরে আমাজন অঞ্চলের আদিবাসীরা তীব্র বিক্ষোভ দেখান। তাঁদের স্পষ্ট দাবি, জলবায়ু সঙ্কট ও কর্পোরেট জমি অধিগ্রহণ এবং মূল নিবাসী মানুষের গণউচ্ছেদ রুখতে বিভিন্ন দেশের সরকারকে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। শুধু মুখের কথা নয়, এমন কিছু আইন তৈরি করতে হবে, যা সমস্ত দেশ মানতে বাধ্য হবে। বিক্ষোভকারীরা রাষ্ট্রসঙ্ঘের সভাকক্ষে ঢোকার অনুমতি চান, যাতে তাঁরা দাবিগুলি বিভিন্ন সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের সামনে তুলে ধরতে পারেন। বিক্ষোভকারীদের মুখে স্লোগান ছিল— ‘আমাদের জমি আমরা বিক্রি করবো না।’

ব্রাজিলের টুপিনাম্বা আদিবাসী সম্প্রদায়ের নেতা নাটো বলেছেন, ‘জমির বিনিময়ে টাকা দিলে তা আমরা কি ধুয়ে খাবো? কৃষি বিপণন সংস্থা, জ্বালানি সংস্থা, বেআইনি খনি মালিক বা কাঠ ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে আমাদের জমি দখলমুক্ত হোক, আমরা এই দাবিই তুলছি।’ বিক্ষোভকারীদের রুখতে নিরাপত্তারক্ষীরা তাঁদের সঙ্গে ধস্তাধস্তিতে জড়িয়ে পড়ে। কয়েকজন আহতও হন। ব্যারিকেড তৈরি করা হয় রাষ্ট্রসঙ্ঘের সভাকক্ষের সামনে। সম্মেলন চত্বরের এক কক্ষে রাষ্ট্রসঙ্ঘের আধিকারিকদের বৈঠক চলাকালীন আদিবাসী বিক্ষোভকারীরা ঢোকার চেষ্টা করেন। তাঁদের বাধা দেওয়া হয়। কক্ষের বাইরে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে নিরাপত্তারক্ষীদের বিবাদের সময় সভার প্রতিনিধিরা বৈঠক ছেড়ে অন্যত্র চলে যান।

উদ্বোধনী ভাষণে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা আশ্বাস দেন, এবারের সম্মেলনে আদিবাসী মানুষের প্রতিনিধিত্বের জায়গা থাকবে। এর জেরে গত কয়েকদিন ধরে আমাজন অঞ্চল থেকে শয়ে শয়ে নৌকা ও স্টিমারে বেলামে এসে হাজির হন কয়েক হাজার আদিবাসী মানুষ। অরণ্যের অধিকার, জলবায়ু সঙ্কট মোকাবিলায় সমস্ত দেশের সক্রিয় ভূমিকা এবং কর্পোরেট জমি অধিগ্রহণের বিরোধিতায় সরব হন বিক্ষোভকারীরা। ব্রাজিলের আদিবাসী নেতা রাওনি মেতুকাতিরে। আদিবাসী ও মূলনিবাসী মানুষের আরও বেশি স্বাধিকার ও নিরাপত্তার দাবিতে সরব হয়েছেন। আমাজন অঞ্চলে শিল্পায়নের অজুহাতে আদিবাসীদের জমির কর্পোরেট অধিগ্রহণের তাঁরা বিরোধিতা করেছেন। গত কয়েক বছরে আমাজন অঞ্চলের আদিবাসীদের ওপর জলবায়ু সঙ্কট মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। এর ফলে নানা রকম মহামারী নেমে আসছে। গত কয়েক বচরে আমাজন অঞ্চলে রেকর্ড হারে ডেঙ্গু সংক্রমণ দেখা দেয়। বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে এই অঞ্চলে মশার প্রজনন বাড়ছে। তার ফলে এই ধরনের মারাত্মক সংক্রমণের প্রবণতা বাড়ছে।


এদিকে জলবায়ু সঙ্কট নিয়ে বিভ্রান্তি ও ভুয়ো তথ্য রোধে কার্যকর পদক্ষেপের দাবি তুলে কপ-৩০ সম্মেলনের প্রতিনিধিদের একটি খোলা চিঠি পাঠিয়েছেন প্রায় ৪০০টি বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক সংস্থা। এ বিষয়ে তাঁরা ‘দৃঢ়, সক্রিয় এবং বাধ্যতামূলক’ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন।

আমাজনের মূলনিবাসীদের মতোই প্রশান্ত মহাসাগরের টুভালু, কিরিবাতি ও মার্শাল দ্বীপপুঞ্জের মতো বিভিন্ন ছোট ছোট দ্বীপ জলবায়ু পরিবর্তনের জেরে অস্তিত্ব সঙ্কটের মুখোমুখি। কপ-৩০-এ তাঁরা জোরালো পদক্ষেপের দাবি তুলেছেন। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র দুই মিটার উচ্চতায় অবস্থিত এই দ্বীপগুলো বাড়তে থাকা সমুদ্রস্তর, লবণাক্ত জলের অনুপ্রবেশ ও তীব্র ক্ষয় প্রক্রিয়ায় বিপর্যস্ত। নাসা ও আইপিসিসি-র গবেষণা ইঙ্গিত দিচ্ছে, আগামী দশকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা আরও বাড়বে। এর ফলে এখানকার বাসযোগ্যতা ও জীবিকার ওপর ব্যাপক প্রভাব পড়বে। তাই এই দ্বীপরাষ্ট্রগুলি অভিযোজন তহবিল ও বিপর্যয়ের ক্ষতিপূরণের দাবি তুলেছে। পাশাপাশি, বিশ্ব উষ্ণায়নকে ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখার দৃঢ় প্রতিশ্রুতির দাবি করা হয়েছে। প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলির বক্তব্য আরও জোরালো করতে অস্ট্রেলিয়ার সরকার তাদের সঙ্গে যৌথভাবে ২০২৬-এ কপ-৩১ সম্মেলনের আয়োজন করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
জলবায়ু সংক্রান্ত তথ্যের সত্যতা ও নির্ভরযোগ্যতা নিশ্চিত করার আবেদন করে ৪০০টি বৈজ্ঞানিক ও সামাজিক সংস্থা তাদের চিঠিতে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, মিথ্যা প্রচার ও বিভ্রান্তিকর তথ্য জনগণের মধ্যে এই বিষয়ে একরকম উদাসীনতা তৈরি করে। আন্তর্জাতিক স্তরে কার্যকর জলবায়ু নীতি বাস্তবায়নকে তা ব্যাহত করে এবং পরিবেশ বান্ধব জ্বালানির গ্রহণযোগ্যতা ক্ষুণ্ণ করে। অভিযোগ উঠেছে, জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্প জনমতকে প্রভাবিত করতে ইচ্ছাকৃতভাবে বিভ্রান্তিকর প্রচার চালাচ্ছে। সামাজিক মাধ্যম, সংবাদমাধ্যম ও নানা বিজ্ঞাপনী প্ল্যাটফর্মের কঠোর নিয়ন্ত্রণের দাবি উঠেছে। রাষ্ট্রসঙ্ঘের জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনের ইতিহাসে এই প্রথম ভুয়ো তথ্যের প্রচার সংক্রান্ত সমস্যা আনুষ্ঠানিক আলোচনা সূচিতে স্থান পেয়েছে।

কপ-৩০ শুরু হতেই প্রথম বিশ্বের দেশগুলির থেকে জলবায়ু সঙ্কট মোকাবিলায় আরও বেশি সক্রিয়তা ও দায়বদ্ধতার দাবিতে একজোট হয়েছে উন্নয়নশীল দেশগুলি। এই সম্মেলন আমেরিকা কার্যত বয়কট করেছে। সম্মেলনের উদ্বোধনী ভাষণে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কটাক্ষের সুরে বলেছেন, ‘এখনও কিছু দেশের রাষ্ট্রপ্রধান জলবায়ু সঙ্কটের বাস্তবতা অস্বীকার করেন। এই সমস্ত ব্যক্তি যুদ্ধ চালাতে প্রতি বছর প্রায় ৩ লক্ষ কোটি ডলার খরচ করেন। তাঁদের বোঝা উচিত, জলবায়ু সঙ্কট মোকাবিলায় প্রতি বছর অন্তত ১.৩ লক্ষ কোটি ডলার খরচ করা ঢের বেশি সাশ্রয়ী।’