কুমারেশ চক্রবর্তী
বিশ্বের দুই প্রান্তে দুই যুদ্ধ প্রায় স্থায়ী যুদ্ধের রূপ নিয়েছে। মাসের পর মাস, বছরের পর বছর চলছে তো চলছেই। দুই যুদ্ধেরই দুই নায়ক দুই মহা শক্তিধর রাষ্ট্র। দুটো যুদ্ধই চলছে জেদের বসে, দুটো যুদ্ধই অন্যায় যুদ্ধ, দুটোতে না মানা হচ্ছে আইন না আন্তর্জাতিক নিয়ম-কানুন। এবং বলা বাহুল্য, দুই যুদ্ধেই প্রধান শিকার লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ মানুষ যার মধ্যে অধিকাংশই নারী শিশু এবং প্রবীণ মানুষ। আশা করি পাঠক অনুমান করতে পারছেন এই দুই যুদ্ধের চালক কারা? বলাবাহুল্য ইসরাইল এবং রাশিয়া। এই দুই মহা শক্তিধর রাষ্ট্র দুই সামরিক দিক দিয়ে দুর্বল কিন্তু মানসিক শক্তিতে মহিয়ান দুই সত্তাকে কে ধ্বংস করতে উন্মতের মতো উদ্যত হয়েছে।
কোন নিয়ম-কানুন আন্তর্জাতিক আইন না মেনেই ইজরাইল যেমন গাজা সহ সমগ্র প্যালেস্টাইনবাসীদের ধ্বংস ও মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তেমনি অন্যপ্রান্তে রাশিয়া ইউক্রেনকে প্রায় ধ্বংস করেই ফেলেছে। এই দুই দেশের উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। আর এই দুই যুদ্ধেই ভারত নানাভাবে জড়িয়ে আছে। প্রথমদিকে ভারতের ভূমিকা ছিল ইতিবাচক। ভারত সঠিক সক্রিয় ভূমিকা নিয়েছিল যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য। কিন্তু বর্তমানে ভারতের ভূমিকার পরিবর্তন ঘটে গেছে। এখন ভারতের ভূমিকা কি তা বলা মুশকিল। এটা বড় রহস্য! তবে রহস্যের পর্দা সরিয়ে যদি অন্তর্দৃষ্টি নিক্ষেপ করা যায় তাহলে দেখা যাবে, বিশ্বের দুই প্রান্তের দুই যুদ্ধেই ভারত অপ্রত্যক্ষভাবে ইসরাইল অপরদিকে রাশিয়াকে সাহায্য করে চলেছে। বিশেষ করে ইজরাইল যুদ্ধে ভারতের এই ভূমিকা দুঃখজনক, অমানবিক, অন্যায় ও অপ্রত্যাশিত। কারণ বিশ্বে ভারতের শান্তিরক্ষক হিসেবে একটা ভাবমূর্তি তৈরি হয়ে আছে যার সঙ্গে ভারতের বর্তমান আচরণ মোটেই মেলে না। এটা ঠিক যে ভারত সরাসরি ইজরাইল কিংবা রাশিয়াকে সাহায্য করছে না। কিন্তু অপ্রত্যক্ষভাবে ভারত জড়িয়ে পড়ছে। সরাসরি সাহায্য না করলেও বাণিজ্যিকভাবে ভারত দায়িত্ব অস্বীকার করতে পারে না।
দেখা যাক, ইজরাইল-আরব যুদ্ধের ক্ষেত্রে ভারতের ভূমিকা কি। ইসরাইলের ব্যাপারে মূলত বাণিজ্যিক দিক দিয়েই ভারত সাহায্য করে চলেছে। আর এই সাহায্যে ভারতের প্রধান মাধ্যম হল টাটা গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রি। শুধু ভারত নয় সমগ্র বিশ্বেই একটা কথা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে, টাটা মানে ভরসা। টাটা মানে আস্থা। টাটা মানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়। টাটা মানে শ্রমিক স্বার্থ রক্ষা। টাটা মানে উন্নয়ন, টাটা মানে আইন। টাটা মানে এক দানশীল মানবিকতার প্রতিমূর্তি। সেই টাটা কোম্পানি এখন ইজরাইলের অন্যতম প্রধান সহযোগী সংস্থা হিসেবে ইজরাইল কর্তৃক লক্ষ লক্ষ শিশু নারী ও মানুষের হত্যার দায় অভিযুক্ত। কারণ টাটা যে সমস্ত যুদ্ধ সরঞ্জাম ইজরাইলকে সরবরাহ করছে তা এই গণহত্যায় ব্যবহার করা করছে ইজরাইল সরকার। টাটার আয় ও উৎপাদনের একটা বড় অংশ হলো যুদ্ধ সরঞ্জাম তৈরি করা এবং দেশে-বিদেশে তা সরবরাহ করা। এর মধ্যে আছে মাটি থেকে আকাশে উৎক্ষেপণযোগ্য বারাক, ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যবহারযোগ্য অংশ যা নৌবাহিনীর প্রতিরক্ষায় ব্যবহৃত হয় এবং যা গাজাতে ব্যবহার হয়েছে, টিএএসএল এফ, সিক্সটিন যুদ্ধবিমান ও সামরিক হেলিকপ্টারের অংশ প্রভৃতি। এইসব যুদ্ধ সরঞ্জাম ব্যাপকভাবে ইজরাইল গাজা যুদ্ধে ব্যবহার করছে। তাছাড়া আছে জাগুয়ার ল্যান্ড রোভার এবং হালকা সাজোয়া গাড়ির চেসিস ভারত থেকে আমদানি করছে ইজরাইল সরকার। এসবই টাটা কোম্পানির তৈরি। এমনকি টি সি এস ইসরাইল সরকারের ডিজিটাল পরিকাঠামো তৈরি করে দিচ্ছে যা যুদ্ধের ক্ষেত্রে একান্ত অপরিহার্য বিষয়। তাই টাটার অন্যতম প্রধান ক্রেতা হল ইসরাইল।
একটি নির্ভরযোগ্য আন্তর্জাতিক সংস্থা টিআরটি ওয়ার্ল্ডের প্রতিবেদনে এইসব তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, এগুলি শুধুমাত্র ব্যবসায়িক সম্পর্ক নয়। এর দ্বারা অর্থাৎ ভারতের এই পুঁজি ইজরাইলের সাম্রাজ্যবাদী এবং দখলদারির নীতির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত হয়ে গেছে। যদিও এই প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে টাটা কোম্পানি কোনো জবাব দেয়নি আবার অভিযোগগুলি অস্বীকারও করেনি। অবশ্য শুধু টাটা কোম্পানিকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, আরো বহু বহুজাতিক সংস্থা ইজরায়েলকে নানাভাবে বাণিজ্যগত দিক থেকে সাহায্য করছে। যা প্রকারান্তরে গাজা যুদ্ধের সমর্থন বলেই মনে করা হয়। এইসব সংস্থা নৈতিকতার প্রতীক হিসেবে নিজেদের প্রচার করে, বিজ্ঞাপনে, সংবাদ মাধ্যমে তাদের মানবিকতার দিকগুলো বারবার তুলে ধরে, অথচ আসলে তারা সাম্রাজ্যবাদের দোসর। এক্ষেত্রে ইজরাইলের গণহত্যার অংশীদার বলা যেতে পারে। এইসব বহুজাতিক সংস্থাগুলির মধ্যে আছে আমাজন, গুগল, এইচপি, ক্যাটারপিলার প্রভৃতি যারা শান্তি এবং মানবিকতার প্রচার করে অথচ গণহত্যার সমর্থক।
টাটা অবশ্য নতুন করে ইজরাইলের সঙ্গে বাণিজ্য শুরু করেছে এ কথা বলা যায় না! কারণ ১৯৯০ থেকেই ইজরাইলের সঙ্গে টাটা কোম্পানির বাণিজ্য চলে আসছে এবং ইজরাইলের অস্ত্র উৎপাদনে বিভিন্ন যন্ত্রাংশ সরবরাহ করে সাহায্য করছে। বর্তমানে তা বিশাল আকার ধারণ করেছে। অবশ্য শুধু টাটা নয়, ভারত বর্তমানে ইজরাইল উৎপাদিত অস্ত্রের অন্যতম প্রধান ক্রেতা। ইজরাইল যত অস্ত্র উৎপাদন করে তার প্রায় অর্ধেক ভারত কিনে নেয়। আবার ইজরাইলের সঙ্গে যৌথভাবে বহু অস্ত্র নির্মাণে সে বর্তমানে অনেকগুলি প্রকল্প গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে আছে বারাক ৮, বিভিন্ন ধরনের অত্যাধুনিক ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র।
অথচ একটা সময় ভারত ছিল প্যালেস্টাইনের সবচেয়ে বড় সমর্থক ও সক্রিয় সাহায্যকারী। বিশ্বের একমাত্র প্রতিষ্ঠান পিএলওকে ভারত রাষ্ট্রের মর্যাদা দিয়েছিল। তাদের দূতাবাস দিল্লিতে খোলা হয়েছিল এবং প্যালেস্টাইন মুক্তি সংগ্রামের এই সংগঠনের প্রধানকে ভারত রাষ্ট্রপ্রধানের মর্যাদা দিয়েছে, তারা ভারতে এলে সেই ভাবে আপ্যায়ন করা হয়েছে এবং তাদের সর্বতোভাবে সাহায্য করা হয়েছে। এই রাষ্ট্রের মুক্তির জন্য ভারত সারা বিশ্বে প্রচার করেছে। ভারতের এই সক্রিয় ইতিবাচক ভূমিকার জন্যই প্যালেস্টাইন মুক্তি সংগ্রামের স্বপ্ন অনেকাংশেই সফল হয়েছিল। অথচ সেই ভারত আজ প্যালেস্টাইন মুক্তি সংগ্রামের পথে প্রত্যক্ষভাবে কাঁটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বিশেষ করে গত পাঁচ সাত বছর যাবত ভারতের এই আচরণ সমগ্র বিশ্বের মুক্তিকামী ও শান্তিকামি মানুষের কাছে অত্যন্ত বিস্ময়ের বস্তু হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে ভারতের ভাবমূর্তি এখন অনেকাংশেই মলিন হয়ে গেছে, যা কেন্দ্রীয় সরকার অস্বীকার করতে পারে না।
ভারতের এই নেতিবাচক ভূমিকার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার অনেক সাফাই গাইতে পারে কিন্তু সত্যকে আড়াল করতে পারবে না। ভারত যদিও বারবার বলেছে, ‘আমরা এখনো প্যালেস্টাইনের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী,এই দেশকে স্বাধীন রাষ্ট্রের মর্যাদা দিয়ে থাকি, এখন ইসরাইল সহ পশ্চিমি দুনিয়া প্যালেসটাইনকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকার করলে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’ কিন্তু এইসব ভালো ভালো কথা বলে শাক দিয়ে মাছ ঢাকা যাবেনা। ভারতের বাণিজ্য, ভারতের পুঁজি, অপ্রত্যক্ষভাবে গাজার শিশু হত্যার জন্য নারী হত্যার জন্য অনেকাংশেই দায়ী, এ কথা কি সরকার অস্বীকার করতে পারবেন ?
আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে ভারতকে দায়ী করা না গেলেও ভারতের টাটা কোম্পানি-সহ বিভিন্ন কোম্পানিগুলিকে কিন্তু যুদ্ধ অপরাধে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। কারণ আন্তর্জাতিক আইনে বলা আছে, সরাসরি যুদ্ধ ছাড়াও যারা যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা করে যেমন অর্থ, অস্ত্র, যন্ত্র, যন্ত্রাংশ দিয়ে সাহায্য করে তারাও যুদ্ধাপরাধী হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকে।
উদাহরণ হিসেবে ১৯৮০ সালের দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী আন্দোলনের কথা বলা যায়। সেই সময় আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে যুক্ত বানিজ্য প্রতিষ্ঠানগুলিকেকে বাধ্য করা হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে বাণিজ্য বন্ধ করতে। সেই আইন অনুসারে ভারত কি পারে না টাটা সহ বিভিন্ন কোম্পানিগুলিকে ইজরাইলের সঙ্গে এই মারণ খেলার অংশ না নিতে বাধ্য করতে?
বিশেষ করে টাটা কোম্পানি যাদের নীতি হচ্ছে শুধুমাত্র মুনাফার জন্য ব্যবসা নয়, মানুষের জন্য ব্যবসা। তারা শতাধিক বছর ধরেই এই তত্ত্বের প্রমাণ দিয়ে এসেছে। বর্তমানে সেই পথ থেকে সরে আসা কি আমরা আটকাতে পারি না? আর টাটা কোম্পানির কর্ণধারদের উদ্দেশে বলি, আপনারা কি এই গণহত্যার কাজে অংশগ্রহণ করেই চলবেন নাকি টাটা পরিবারের ঐতিহ্যকে রক্ষা করবেন? ভেবে দেখবেন কি?