‘এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাব…’

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

কবিতা মুখোপাধ্যায়

বাংলার কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য বলেছিলেন— ‘… প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,/এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি—’। পৃথিবী থেকে কবেই বিদায় নিয়ে চলে গেছেন তিনি। আর আমরাও অনেকটা পথ চলে এসেছি কিন্তু। সুকান্ত ভট্টাচার্যের মতো কোনও কণ্ঠ সেভাবে উঠে আসে না। আর যদি আসেও সে কণ্ঠ যে আমাদের কান অতিক্রম করে হৃদয়ে প্রবেশ করে না। আগামী পৃথিবী ভরে উঠবে পাখির গানে, প্রকৃতির হাসিতে, শিশুর কলতানে এ দুঃস্বপ্ন আমরা দেখি না, আমাদের কাছে শুধু সত্যি হয়ে উঠছে— ‘ধূসর পৃথিবী / প্রকৃতির মাঝে দাঁড়িয়ে / স্থির’।

প্রতিবারের মতো এবারও ব্রাজিলের বেলেম শহরে আয়োজিত হল বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন। প্রতিটি সম্মেলনেই পৃথিবী নামক গ্রন্থটিকে সুস্থভাবে বাঁচিয়ে রাখার জন্য বহু মূল্যবান সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং সম্মেলন শেষে সেগুলিকে কফিনে চালান করা হয়— এর ব্যতিক্রম কিছু নেই। আসলে আর-বিশ্বের মানুষের মধ্যে এই সচেতনতা বোধটিই গড়ে ওঠেনি, যে পৃথিবীর বুকে শ্বাস নিয়ে আমরা বেঁচে আছি তার রক্তেই বাহিত হচ্ছে ক্যানসারের জীবাণু। প্রতিদিন প্রতিনিয়ত আমরা নিরলসভাবে চালিয়ে যাচ্ছি অত্যাচার, পরিণামের কথা মাথায় না রেখেই।


দিনটা ছিল ছট্ পূজার শেষ দিন। বাইরে আঁধার তখনও তার ঘোমটা খোলেনি। ঘুম ভেঙ্গে গেল বাহির শব্দে, ডিজে-এর কোলাহলে। বুঝলাম পূণ্যার্থীরা উদিত সূর্য্যের আরাধনায় রত। বড় পবিত্র মুহূর্তে। প্রকৃতি এবং মানুষের মেলবন্ধন। অথচ সেই সূর্য্য ওঠার প্রাক্ মুহূর্তে প্রকৃতির নিস্তব্ধতাকে খান খান করে বাজছে ডিজে, ধোঁয়ায় দূষিত হয়ে ওঠে পরিবেশ। ঠিক তখনই মনে পড়ে যায় ছট্ পুজোর পবিত্র স্নানের জন্য দিল্লিতে দূষণ পীড়িত যমুনা নদীর কোলে আলাদা করে পানীয় জলে ভর্তি পুকুর তৈরির হাস্যকর প্রচেষ্টার কথা। বিস্ময় লাগে যে বিপুল অর্থ ব্যায় প্রকৃতির জল ভাণ্ডারের অপচয় ঘটিয়ে মানুষের পানীয় জলড়কে কোনও একজন ব্যক্তির অসাধারণত্বের প্রমাণের জন্য বা রাজনৈতিক দলের স্বার্থে এ ধরনের কর্মকাণ্ড বারে বারেই ঘটে চলেছে। অথচ যে উদ্যোগে, যে অর্থ ব্যয়ে এ ধরনের কর্মকাণ্ড করা হয় তার অর্ধেক নিষ্ঠায় যদি ‘যমুনা’-র স্বাস্থ্য উদ্ধারে ব্যয়িত হত তবে দিল্লিকে আজ বিশ্বের প্রথম শ্রেণির দূষণ যুক্ত অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত হতে হত না। কী বিস্ময়কর ভণ্ডামি মানুষের!

শুধু ছট্ পুজো নয় সমস্ত উৎসব সৃষ্টি করছে শব্দ দূষণ, বায়ু দূষণ এবং সংস্কৃতি দূষণ যা এক ভয়ঙ্কর জায়গায় পৌঁছে গেছে। আজকাল উৎসবের নামে যা উঠে আসছে তাতে আর যাই হোক উৎসবের মাহাত্ম বৃদ্ধি তো হয়ই না বরং তৈরি হয় এক ধরনের আন্তসার শূন্যতা। আমরা বর্তমান পৃথিবীর মানুষরা ভুলে গেছি অনাবিল আনন্দ বলতে কী বোঝায়? এখন আমরা ‘আনন্দ’ কবি না, করি ‘মস্তি’। এখন গান হয় না। তার জায়গায় উঠে আসে উচ্চগ্রামে ‘সঙ্গীত’। হিমের রাতে দীপাবলিতে আমরা মাটির প্রদীপ জ্বালাতে ভুলে গেছি, যে প্রদীপের আলো ফসলের বহু কীটকে নাশ করতে সাহায্য করত। তার জায়গা নিয়েছে উজ্জ্বল বৈদ্যুতিন আলোকের সমারোহ যা গাছের নিদ্রা, পাখির নিদ্রা হরণ করছে।

যে কোনও পুজো বিয়েবাড়ি, জন্মদিন বা অন্নপ্রাশন নির্বাচনে বা খেলায় জয়লাভ সবেতেই বাজি ফাটছে পরিবেশের সমস্ত শুদ্ধতাকে, পবিত্রতাকে ছিন্ন ভিন্ন করে। রাতের পাখির বা প্রাণীর জীবনকে উৎকণ্ঠিত করে নানা ধরনের বাড়ি ফাটিয়ে মানুষ তার উৎসবের ‘সেলিব্রেশন’ করছে। এ পৃথিবী যে তাদের একার নয়-এই সত্যিটাকে সম্পূর্ণভাবে নস্যাৎ করে। বহু নিষেধ, আইন রয়েছে কিন্তু কোনও প্রয়োগ নেই তার, নেই লাগাম। অথচ এই শব্দ দূষণ থেকে শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, অসুস্থ মানুষকে রক্ষা করার জন্য ২০০২ সালে বিচারপতি ভগবত ব্যানার্জি এবং হাইকোর্টের আইনজীবী গীতানাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই ঐতিহাসিক প্রয়াসকে আমরা বেমালুম ভুলে গেছি, ভুলে থাকছি।

প্রতিবার কালীপূজা, দেওয়ালীর সময় শব্দ বাজি নিয়ন্ত্রণে চলতে থাকে চোর-পুলিশের খেলা। অবশ্যই চোরের পিছনে নীরব সমর্থন থাকে প্রশাসনের, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের। কিন্তু বলির পাঁঠা হন আইন রক্ষক (পুলিশ বাহিনী)রা। তারা হল সর্বস্তরে নিন্দিত, প্রমাণিত হন অপদার্থ হিসেবে। কিন্তু সত্যিই কি তাই? শিকলে হাত-পা বাঁধা পুলিশ কীভাবে করবেন শব্দ বাজি বা নিষিদ্ধ বাজি দমন? যদি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত আগেই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন এই সমস্ত বাজি তৈরির ক্ষেত্রে তবে তো এত কথা বা দূষণ সৃষ্টি হয় না। এছাড়া যেটা সব চাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, সে জল নষ্ট করা থেকে শুরু করে দূষণ সৃষ্টিকারী কর্মকাণ্ডকে প্রতিহত করার জন্য প্রয়োজন নাগরিকদের সচেতনতা।

মানুষের সচেতনতা যে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। পরিবেশ বিজ্ঞানী, কৃষি বিজ্ঞানীরা বার বার সচেতন করছেন যে ধান কাটার পর পড়ে থাকা কাটা অংশগুলোকে না পুড়াতে। যে কাজ মাটির স্বাস্থ্যের যেমন ক্ষতি করছে, সেই সঙ্গে বহু বন্ধু কীটকেও ধ্বংস করে আখেরে ক্ষতি করছে কৃষিকাজেই। অথচ প্রতিবছরই মাঠে মাঠে আগুন জ্বালাবার দৃশ্য আজ আমাদের চোখে সয়ে গেছে। অথচ ছোটবেলায় দেখেছি বর্ষাকালে ধান ক্ষেতে কত ধরনের চুনো মাছ, যাদের সৃষ্টি হত প্রাকৃতিক উপায়ে। আজ আর সে সব নেই, জন্ম হয় না। এখন তাদের নতুন করে সৃষ্টির উদ্যোগ চলছে। তবে প্রকৃতি কৃপণ হলে বা মুখ ফিরিয়ে নিলে কোনও প্রচেষ্টাই সফল হবে না।

একটা সময় মানুষই সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাণ বলে বিশ্বাস করতাম। স্কুল জীবনে এ বিষয়ে অনেক প্রবন্ধ লিখেছি কিন্তু আজ এমন এক পৃথিবীতে এসে দাঁড়িয়েছি যেখানে বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, জলদূষণ শুধু নয় দূষণ ঘটে যাচ্ছে ভাষায়, সংস্কৃতিতে মানুষ শুধু মূক ও বধিরের মতো জীবন যাপন করে চলেছে। আমরা ভুলে গেছি আমাদের বহু চর্চিত দীর্ঘ দিনের লালিত সংস্কৃতি চর্চাও যা পারোক্ষে ক্ষতি করছে আমাদের পরিবেশের আমাদের পুজো, উৎসবগুলি কেমন যেন হারিয়ে ফেলছে তার গাম্ভীর্য, মাহাত্ম্য, ‘হিমের রাতে ওই গগনের দীপগুলি রে…’ এর জায়গায় উজ্জ্বল বৈদ্যুতিন আলোর সজ্জা, কান ফাটানো শব্দ বাজি যা ব্যহত করছে দীপাবলির মাধুর্য, স্নিগ্ধতা। যার প্রভাব পড়ছে পরিবেশের উপর। আমরা ভুলে যাই জোনাকির প্রয়োজনীয়তা, ভুলে যাই গাছেদের নিদ্রার প্রয়োজনীয়তা যা ব্যহত হয় অতিরিক্ত আলোয়, বিঘ্ন ঘটায় তাদের নিদ্রার। মানুষের দাবী তারাই শ্রেষ্ঠ অথচ সেই মানুষই আজ বসুমতীকে এমন জায়গায় পৌঁছে দিয়েছে যে আমাদের কানে পৃথিবীর আর্তনাদ পৌঁচ্ছাছে না— আমাকে বাঁচাতে দাও, আমি যে বাঁচতে চাই … প্রকৃতির চোখে জল, বুক ভরা অভিমান নিয়ে বলছে ‘তোমরো এতোটাই মূর্খ যে এই সার কথাটা উপলব্ধি করতে অক্ষম আমি না থাকলে তোমরাও থাকবে না। তোমাদের চৈতন্য কবে হবে?

২০১৫ সালে প্যারিস চুক্তি সমগ্র বিশ্বের তাপমাত্রা কমানোর যে চুক্তি হয়েছিল সেটি বাস্তবায়িত যে হয়নি সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না। কেন না বর্তমানে দেখা যাচ্ছে যে বিশ্বের তাপমাত্রা বৃদ্ধির যে সীমা ধার্য হয়েছিল সে তাপমাত্রা অতিক্রম করতে চলেছে। এখনও সময় আছে এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাবার অঙ্গিকার আমরা করি। আর একদিনও দেবী নয়।