জল চাই, জল, জলই জীবন

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

হীরক কর

পুরুলিয়ার বান্দোয়ান ব্লকের প্রত্যন্ত গ্রাম‌ “মৃগিচামী”। সেখানে শবর শিশুদের জন্য ‘শ্রীমতী বহ্নি কর শবর সহজপাঠ’ চালাই আমরা।‌ বছর তিনেক আগে ওই স্কুলের জন্য সোলার সিস্টেমের মাধ্যমে পানীয় জলের প্রকল্প বানিয়ে দিয়েছিল, জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর। স্কুলের ভেতরের কল অনেক আগেই ভেঙেছিল, মাস ছয় আগে ভেঙেছে পানীয় জলের মূল পাইপ। চুক্তি অনুযায়ী মেরামতীর কাজ করার কথা জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরেরই। তাই ফোন করলাম, সংশ্লিষ্ট ইঞ্জিনিয়ারকে। তিনি ‘দেখছি’ বলে কর্তব্য সারলেন। ঠিকাদার সংস্থার কর্মীকে বললে, তাঁরা মিস্ত্রি পাঠিয়ে সরেজমিনে তদন্ত করে বাজেটটা বুঝে নিলেন। মিস্ত্রি বললো, তিন হাজার টাকা লাগবে। মজার কথা হল ভাঁড়ারে টাকা নেই বলে এই তিন হাজার টাকা না দিতে পারছে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতর, না দিতে পারছে ঠিকাদার সংস্থা। সরকারি লাল ফিতে ফাঁসের জন্য ওই টাকাটা আমিও নিজের পকেট থেকে দিতে পারছি না । আমাকে দিতে দেওয়া হচ্ছে না। কেননা সরকারি প্রকল্পে বেসরকারি কোনও স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা টাকা ইনভেস্ট করতে পারে না। মাঝখান থেকে এই গরমে পানীয় জলের জন্য ভুগছে, স্কুলের ছোট্ট ছোট্ট শিশুরা। আর গোটা গ্রাম ‘মৃগিচামী’।

এই গরমে পানীয় জলের অভাবে ধুঁকছে পশ্চিমবঙ্গ। অনেক জায়গায় সোলার পানীয় জলের প্রকল্প আছে। কিন্তু কাজ করে না। কোথাও কল আছে, কলে জং পড়েছে, তাই জল পড়ে না। সরকারি খাতায় এই রাজ্যে সর্বত্র কিন্তু পানীয় জলের ব্যবস্থা আছে। এই অবস্থায় পশ্চিমবঙ্গের ছটি জেলায় ‘জল জীবন মিশন’ প্রকল্পের কাজ দেখতে আসছে কেন্দ্রীয় সরকারের চারটি দল। ছিল মিশন ২০২৪। ২০১৯ সালে ‘জল জীবন মিশন’ প্রকল্প ঘোষণা করে কেন্দ্রীয় সরকার। লক্ষ্য ছিল, ২০২৪ এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের সমস্ত গ্রামে নলবাহিত পানীয় জল পৌঁছে যাবে। টাকা যোগায় জাপানি সংস্থা ‘জাইকা’। পুরুলিয়া শহরে জনস্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের বিশাল ‘জাইকা’ বিল্ডিং আছে। দেখলে মনে হবে আপনি আমেরিকায় ‘এফবিআই’ অফিসে এসে গেছেন। গত কয়েক বছরে ‘জাইকা’র টাকায় গ্রামে গ্রামে পানীয় জল পৌঁছাবার কাজ হয়েছে ভালই। কিন্তু মেনটেনেন্স এর কাজ একদমই হচ্ছে না।


জল জীবন প্রকল্পে পাহাড়ি রাজ্যগুলো বাদ দিয়ে বাকি সব রাজ্যে কেন্দ্রের খরচ ৫০ শতাংশ, বাকি ৫০ শতাংশ খরচ রাজ্যের। কিন্তু ২০২৪ এর লক্ষ্যমাত্র পূরণ হয়নি। এরপর প্রকল্পের মোট খরচ ধরা হয়েছিল ৩.৬০ লক্ষ কোটি টাকা। এখন লক্ষ্য ২০২৮ সালের মধ্যে এই প্রকল্পে কাজ শেষ করা হবে। তাই খরচ বের হয়েছে আনুমানিক ৮.২০ লক্ষ টাকা। এখন সরকারি কর্তারা মনে করছেন বহু প্রকল্পের খরচ ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছে। তাই কাজের অগ্রগতি দেখতে গোটা দেশে কেন্দ্রীয় অফিসারদের ১০০টি দল পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। এজন্য কেন্দ্রীয় সরকারের ৯৯ জন আমলাকে নোডাল অফিসার হিসাবে নিযুক্ত করা হয়েছে । এর মধ্যে পশ্চিমবঙ্গের ছটি জেলায় যাবার কথা চারটি কেন্দ্রীয় দলের। এর আগে এরকম দল এসে পানীয় জলের প্রকল্প পরিদর্শন করে গেছে। কিন্তু কোন প্রকল্পগুলো তাঁরা দেখবেন, সেটা নির্ধারণ করেন দফতরের ইঞ্জিনিয়াররাই। ফলে কেন্দ্রীয় সরকারের অফিসাররা কোথায় যাবেন সেইসব জায়গার প্রকল্পগুলো আগে থেকেই সাজিয়ে গুজিয়ে রাখা হয়। বাকিটা পাঠক বুঝে নিন।
এবার পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়ার চৌদ্দটি ব্লকের নলবাহিত জল প্রকল্প। পুরুলিয়ার উত্তর অংশে নলবাহিত জল প্রকল্পের কাজ খতিয়ে দেখতে কেন্দ্রীয় দল যাওয়ার কথা। নেতৃত্বে থাকবেন কেন্দ্রীয় উপভোক্তা খাদ্য ও গণকন্টন মন্ত্রকের অধিকর্তা এ বি এস শালিনী। কেন্দ্রীয় বিদ্যুৎ মন্ত্রকের অধিকর্তা প্রণব তয়ালের নেতৃত্বে একটি দল হাওড়ার শ্যামপুর-বাগনান উলবেরিয়ায় নলবাহিত জল প্রকল্প, দক্ষিণ ২৪ পরগনার ফলতা-মথুরাপুর জল প্রকল্পের কাজ দেখবেন। কিন্তু ছোট মাঝারি শিল্প মন্ত্রকে অধিকর্তা অঙ্কিতা পাণ্ডীর নেতৃত্বে একটি দল মালদার আর্সেনিক কবলিত এলাকা, এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধিকর্তা সন্দীপ কুমার মিশ্রের নেতৃত্বে একটি দল নদীয়ার আর্সেনিক কবলিত এলাকা ঘুরে দেখবেন।

কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গের জন্য জল জীবন মিশন বাস্তবায়নে বার্ষিক কর্মপরিকল্পনার অনুমোদন করে। এ রাজ্যে ২০২৪ সালের মধ্যে সমস্ত পরিবারে ১০০ শতাংশ ট্যাপ সংযোগ দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। এর জন্য রাজ্য সরকারের পূর্ণ সহযোগিতাও আহ্বান করা হয়। পশ্চিমবঙ্গে ১ কোটি ৬৩ লক্ষ গ্রামীণ পরিবারের মধ্যে এ পর্যন্ত মাত্র ২ লক্ষ ১৯ হাজার পরিবারকে ট্যাপ সংযোগ দেওয়া হয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবর্ষে এই ট্যাপ সংযোগের পরিমাণ ৫৫ লক্ষ ৬০ হাজারে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়। এই কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য পশ্চিমবঙ্গের পর্যাপ্ত আর্থিক তহবিলও রয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবর্ষে এ রাজ্যের জন্য ৯৯৩.৮৮ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে কেন্দ্র। এর মধ্যে ৪২৮.৩৭ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে। বাকি টাকা এখনও পড়ে রয়েছে। এর পাশাপাশি, আর্সেনিক ও ফ্লোরাইড প্রভাবিত অঞ্চলগুলোতে পরিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহের জন্য ১,৩০৫.৭ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে যার মধ্যে ৫৭৩.৩৬ কোটি টাকা খরচ করা হয়ছে। বাকি টাকা এখনও খরচ করা হয়নি। ২০২০-২১ অর্থবর্ষে পশ্চিমবঙ্গের জন্য অর্থ বরাদ্দ বাড়িয়ে ১,৬১০.৭৬ কোটি টাকা করা হয় । এর পাশাপাশি, জল জীবন মিশনের আওতায় পশ্চিমবঙ্গের জন্য বাড়ি বাড়ি ট্যাপ সংযোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে ৫,৭৭০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। এই অতিরিক্ত টাকা কাজের অগ্রগতির ওপর ভিত্তি করেই বরাদ্দ করেছে সরকার। জল সংযোগ দেওয়ার পাশাপাশি, জল সংরক্ষণের কাজ পরিচালনার জন্যও কেন্দ্রীয় সরকার বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের মোট ৪১,৩৫৭টি গ্রামের মধ্যে ২২,১৫৫টি গ্রামে ইতিমধ্যেই পাইপ-বাহিত জল সরবরাহের ব্যবস্থা করা হয়। কোনও গ্রাম যাতে এই কর্মসূচি থেকে বাদ না পড়ে, সেদিকেও রাজ্য সরকারকে নজর দিতে বলা হয়েছে। আগামী ৪ থেকে ৬ মাসের মধ্যে গ্রামের প্রতিটি ঘরে এই জল সংযোগ দেওয়ার জন্য রাজ্য সরকারকে প্রচারাভিযান চালাতেও বলা হয়েছে। কিন্তু ২০২৪ এর লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হয়নি।

পশ্চিমবঙ্গের অনেক অঞ্চলেই দূষিত পানীয় জল বিশেষত, আর্সেনিক এবং ফ্লোরাইডের কারণে মানুষ নানান স্বাস্থ্যগত সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। জল জীবন মিশনের আওতায় গুণমানসম্পন্ন বিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে। চলতি বছরের ৩১শে ডিসেম্বরের মধ্যে এই ধরনের অঞ্চলে অন্তত ১,৫৫৬টি পরিবারে বিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা স্থির করতে বলা হয়।

এর পাশাপাশি, জাপানি এনসেফেলাইটিস, অ্যাকিউট এনসেফেলাইটিস সিন্ড্রোম এবং রাজ্যের ক্ষতিগ্রস্থ ১০টি জেলায় অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পাইপ-বাহিত জল সরবরাহে গুরুত্ব দিতে বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে ২০২০-২১ অর্থবর্ষে অন্তত ২৫ লক্ষ ৪৬ হাজার পরিবারে ট্যাপ সংযোগ দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়। জল জীবন মিশনের আওতায় নারীর ক্ষমতায়নের পাশাপাশি, জলের গুণমানের ক্ষেত্রে নজরদারি চালানোর জন্য যাঁরা সামনের সারির কর্মী হিসেবে কাজ করেন তাঁদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্যও বলা হয়। গ্রাম পঞ্চায়েত পর্যায়ে সাধারণত পাঁচজন মহিলাকে নিয়ে জলের গুণগত মান পরীক্ষার জন্য প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। রাজ্যে সাধারণ মানুষের জন্য জলের গুণমান পরীক্ষাগার খোলার পরিকল্পনাও করা হয়েছে। এর পাশাপাশি, জলবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে গ্রামীণ মানুষের স্বাস্থ্যের উন্নতিতেও বিশেষ নজর দিতে বলেছে কেন্দ্রীয় সরকার। গ্রামের মহিলারা যাতে জলের কারণে তাঁদের মূল্যবান সময় নষ্ট না করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে পারেন, সেদিকেও নজর দিতে হবে। জল জীবন মিশন কেবলমাত্র সরকারের একটি কর্মসূচিই নয়, এটিকে একটি গণ-আন্দোলনের রূপ দেওয়ার পরিকল্পনাও নিয়েছে সরকার। গ্রামাঞ্চলে জল সরবরাহের পরিকাঠামো তৈরির পাশাপাশি, জল সংরক্ষণের জন্যও গ্রামীণ মানুষদের যুক্ত করতেও বলা হয়েছে ।

এই তথ্যচিত্রটি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বৃষ্টির জল সংরক্ষণের অগ্রণী প্রকল্পের ওপর ভিত্তি করে তৈরি, যেখানে রাজ্য জল তদন্ত অধিদফতরের এই বিষয়ে কার্যক্রমের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য জুড়ে সেচের উদ্দেশ্যে জলের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে, পানীয় জলের সামগ্রিক ঘাটতি মোকাবেলা এবং মৎস্য শিল্পে এর নিয়মিত সরবরাহ বজায় রাখার জন্য বৃষ্টির জল সংরক্ষণ এবং সাধারণভাবে জল সংরক্ষণের বিষয়টি উল্লেখযোগ্য গুরুত্বের সাথে উঠে এসেছে।

“জল ধরো-জল ভরো” কর্মসূচির উদ্দেশ্য হল সকল ধরণের জলাশয় যেমন ট্যাঙ্ক, পুকুর, জলাধার, খাল এবং ছাদে বৃষ্টির জল সংগ্রহের মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ কৃত্রিম রিচার্জে বৃষ্টির জল সংগ্রহ করা। সংরক্ষণ এবং সংরক্ষণের জন্য, বৃষ্টির জল/পৃষ্ঠের প্রবাহকে পরিত্যক্ত/পলিযুক্ত ট্যাঙ্কে আটকানো হয়, মূলত সেচের উদ্দেশ্যে যথাযথ পলি অপসারণের পরে।

রাজ্যের ভূগর্ভস্থ ও ভূ-পৃষ্ঠস্থ জলের পরিস্থিতির উদ্বেগজনক পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য, মূল্যবান জল সম্পদ সংরক্ষণের জন্য ২০১১-১২ সালে “জল ধরো-জল ভরো” নামক কর্মসূচি চালু করা হয়েছিল। এই কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নের জন্য, জল সম্পদ তদন্ত ও উন্নয়ন বিভাগ, রাজ্য সরকার ক্ষুদ্র সেচ কাঠামো নির্মাণ ও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে মূল্যবান জল সম্পদের উন্নতি ও প্রাপ্যতার জন্য বৃষ্টির জলের বৃহৎ পরিমাণে সংগ্রহের পাশাপাশি ভূ-পৃষ্ঠের জল প্রবাহ রোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
জলসম্পদ তদন্ত ও উন্নয়ন বিভাগ কেবল বিভিন্ন পরিকল্পনা তহবিলের অধীনে জল সংগ্রহের কাঠামো বাস্তবায়ন করছে না, বরং পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পিএন্ডআরডি বিভাগের সাথে একত্রে এমজিএনআরইজিএ কর্মসূচির অধীনে ট্যাঙ্ক এবং অন্যান্য জলাশয়ের পুনঃখননের কাজেও নিযুক্ত রয়েছে। সেচ/অন্যান্য উদ্দেশ্যে সঞ্চিত জলের ব্যবহারের সাথে সাথে ভূপৃষ্ঠের জল প্রবাহ রোধ করার জন্য চেক ড্যাম, জল সংগ্রহ ট্যাঙ্ক এবং ভূপৃষ্ঠের প্রবাহ ক্ষুদ্র সেচ প্রকল্পের মতো বিভিন্ন ধরণের কাঠামো তৈরি করা হচ্ছে।

তথ্য-প্রমাণ থেকে জানা যায়, মৌসুমি বর্ষার শুরুতে উল্লেখযোগ্য তারতম্য এবং এর স্বল্প সময়কাল প্রধান মৌসুমি ফসলের উপর প্রভাব ফেলে। বৃষ্টিপাতের তারতম্য ফসলের জমি এবং উৎপাদনশীলতা উভয়কেই প্রভাবিত করে, যার ফলে ফসলের উৎপাদন হ্রাস পায়। ফলে, জলাশয়ে জল ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধি শুষ্ক মৌসুমে সম্পূরক সেচের জন্য ব্যাপকভাবে সহায়তা করবে। কৃষিকাজের পাশাপাশি, মৎস্যচাষ কার্যক্রমও উন্নত হবে যার ফলে আয়ের আরও পথ তৈরি হবে। সারা বছর ধরে জলের সহজলভ্যতা স্থানীয় গ্রামবাসীদের তাদের গৃহস্থালির কাজকর্ম এবং পশুপালনের কাজেও সাহায্য করবে।

কৃত্রিম জল পুনঃপ্রবর্তনের মাধ্যমে জল সংরক্ষণ, সেচের জলের দক্ষ ব্যবহার, দূষণ নিয়ন্ত্রণ করে গুণমান সংরক্ষণ এবং সর্বোপরি জল সংকট নিরসনে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করার জন্য “জল ধরো-জল ভরো” কর্মসূচির গণসচেতনতামূলক প্রচারণা ইতিমধ্যেই কলকাতা অঞ্চল এবং রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় শুরু হয়েছে। এই প্রচারণার জন্য, জলসম্পদ তদন্ত ও উন্নয়ন বিভাগের অধীনে রাজ্য জল তদন্ত অধিদফতর কর্তৃক বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি, ও অলচিকি (সাঁওতালি ভাষা), নেপালি এবং উর্দুতে ছয়টি ভিন্ন ভাষায় একটি তথ্যচিত্রও তৈরি করা হয়েছে, যার নাম “জল ধরো জল ভরো”।
২০১৯ সাল পর্যন্ত – ২০, ৩,১৪,৫২২টি জলাশয়/ধারণ কাঠামো তৈরি/সংস্কার করা হয়েছে যার মধ্যে ৮৬,২৩২টি সমতুল্য ট্যাঙ্ক তৈরি করা হয়েছে, একযোগে ২,২৮,২২৫টি জলাশয় তৈরি/সংস্কার করা হয়েছে এবং ‘মনরেগা’-এর অধীনে ৬৫টি পুকুর তৈরি/সংস্কার করা হয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গে জল সঙ্কট একটি গুরুতর সমস্যা। এই সমস্যার বিষয়ে অবিলম্বে নজর দেওয়া প্রয়োজন। ভূগর্ভস্থ জলের অতিরিক্ত উত্তোলন এবং দ্রুত নগরায়নের ফলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে। এমনকি, বেশ কিছু জায়গায় জলের মান বিশেষত, আর্সেনিক এবং ফ্লোরাইড-এর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এমনকি, রাজ্যের খরাপ্রবণ অঞ্চলগুলোতে গ্রামীণ পরিবারগুলোর কাছে অপরিশোধিত জল সরবরাহের ফলে নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। এক্ষেত্রে রাজ্য সরকারকে বিশেষ নজর দিতে হবে।
এক দিকে বাড়ছে সমুদ্রের জলস্তর আর অন্য দিকে সমুদ্র লাগোয়া উত্তর ২৪ পরগনা, দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও কলকাতায় কমছে মাটির নীচের জলস্তর। বিশেষ করে কলকাতায় এই ঘটনা প্রবল ভাবে ঘটছে। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, মাটি টানছে লবণাক্ত জল৷ ফলে ভবিষ্যতে পানীয় জল বলে কলকাতার মাটির তলায় অবশিষ্ট আর কিছু থাকবে না । কারণ মাটির তলায় জল যেমন তুলে নেওয়া হচ্ছে, তার পাশাপাশি ভূগর্ভস্থ জল রিচার্জ করার কোনও পথ খোলা থাকছে না৷ বুজে যাচ্ছে বড় বড় পুকুর, উঠছে বহুতল।
জলাশয় বন্ধ করার মধ্যে দিয়েই বন্ধ হচ্ছে মহানগরের ভূগর্ভস্থ জলভাণ্ডারের রিচার্জের পথ। এ দিকে হুগলি নদীর জল তুলে তাকে পরিশোধন করে পানীয় জলে পরিণত করা হয়। একাংশের কাছে সেই জল না পৌঁছনোর জেরে একের পর এক গভীর নলকূপ লাগিয়ে জলের সংকট সামাল দিচ্ছে পৌর প্রশাসন।

কলকাতায় বাস্তবে জল সংরক্ষণের কোনও ছবির দেখা মেলেনি। আর তার জেরে কতটা বিপদের মুখে দাঁড়িয়ে কলকাতা? কলকাতায় কোনও জল সংরক্ষণের ব্যবস্থা নেই। পুকুর, জলাশয়গুলো কমে যাওয়ায় মাটির তলায় জলের অনুপ্রবেশ ঘটে না। উলটে বহুতলগুলো নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজের স্বার্থে পাম্প করে মাটির নীচের জল তুলে নেয়। ফলে কলকাতায় মাটির নীচে জলস্তরের তারতম্য বেশি লক্ষ্য করা যায়। মাটির ভারসাম্য যাচ্ছে। জল তুলে নেওয়াতে ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। অন্যদিকে, সমুদ্রের জলস্তর বৃদ্ধি পাওয়ায় সেই জলকে মাটি টানতে শুরু করবে। মহানগরের মাটির তলার জল লবণাক্ত হয়ে যাবে।

ভূতত্ত্ববিদরা জানান, কলকাতায় মাটির নীচে যে পরিমাণ জল আছে তার মাত্র ১ দশমিক ২ শতাংশ পানীয় জল। জলস্তর কমার জেরে সেই জল ক্রমশ আর্সেনিকপ্রবণ হয়ে যাচ্ছে। ফলে জল সংরক্ষণ না করা গেলে, মাটির নীচের জলের ভারসাম্য ধরে রাখতে না পারলে, ভবিষ্যতে বড় সংকটের মুখে দাঁড়াতে হবে। সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা প্রচার বাড়ানো গেলে হয়তো এই সংকট খানিকটা কমবে। কিন্তু, জল সংরক্ষণ নিয়ে আদৌ সরকার কি কিছু ভাবছে! এই নিয়ে কোনও সচেতনতা প্রচার বা পদক্ষেপ নেই কোথাও। জল ধরো জল ভরো প্রকল্পে গ্রামের দিকে কিছু পুকুর কাটলেও শহরে পুকুর বুজিয়ে বড় বড় বাড়ি হয়েছে। শহর যদি পুকুরহীন হয়, তাহলে সেই শহর কিন্তু দীর্ঘজীবী হয় না। বিভিন্ন জায়গায় ধস দেখা যায়। কারণ জল না থাকায় মাটির ভারসাম্য নষ্ট হয়, তাই এমন ঘটে।

কলকাতা কর্পোরেশনের এক আধিকারিক এ বিষয়ে বলেন, “কলকাতা শহরে পুকুর কটার মতো জায়গা বা অবস্থা নেই। তবে আমরা পুকুর ভরাট নিয়ে যথেষ্ট সজাগ। কোথাও এমন ঘটলে কঠিন পদক্ষেপ করা হচ্ছে। জলাশয় রক্ষায় লাগাতার কাজ করে চলেছি। বিভিন্ন জায়গায় পানীয় জলের বোস্টিং সেন্টার হচ্ছে৷ ফলে গভীর নলকূপের ব্যবহারও ধীরে ধীরে কমছে। এই দিনে সব নাগরিকের কাছে অনুরোধ, জলাশয় যাতে কোথাও না বুজিয়ে ফেলা হয়, সে দিকে লক্ষ্য রাখুন। আর সেরকম হলে আমাদের জানান।” পাশাপাশি আমাদের মত সাধারণ মানুষকে ‘জল’ অপচয় রোধে জোর দিতে হবে। কেননা, “জলই জীবন”।