…যাহা পাই তাহা চাই না

প্রতীকী চিত্র

পঙ্কজকুমার চট্টোপাধ্যায়

৫ আগস্ট নাটকীয় ভাবে বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামি লিগের সরকারের পতন হলো। শেষ মুহূর্তে প্রাণে বাঁচতে পারলেন হাসিনা সামরিক বাহিনীর বাদান্যে যারা তাঁর নিরাপত্তা দিতে অক্ষম হয়েও তাঁর দেশত্যাগের পথ সুগম করে দিয়েছিল। সেই মুহূর্ত থেকে আমি এটিএন বাংলার নিউজ কভারেজ দেখে এসেছি, এই কারণে যে এক চাত্র আন্দোলনের ফলে এমন ভাবে এক গণতান্ত্রিক দেশের সরকারের পতন ন্যূনতম হিংসা এবং রক্তপাতের মধ্য দিয়ে হয়ে গেল তা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। এখানে বলে রাখি এর আগে ফেসবুকে আমি ময়মসিংহের এক মহিলা কবির পোস্ট অনুসরণ করে সেনাদের সামনে ছাত্র শহিদ আবু সায়েদের দু’হাত প্রসারিত করে দাঁড়ানো পোস্ট দেখে চমকে যাই। মন্ত্রমুগ্ধের মতো আমি এর পর থেকে এটিএন বাংলার নিউজ কভারেজ সকাল থেকে রাতে অনুসরণ করে গেছি। ছাত্র নেতাদের পরিণত বক্তৃতা শুনে মুগ্ধ হয়েছি। বৃদ্ধ বয়সেও আমি উত্তেজনা অনুভব করেছি এমন এক অভ্যুত্থানের সাক্ষী হতে পেরে (টেলিভিশনের এটিএন চ্যানেল ভালই কভারেজ করেছিল)। ৫ আগস্ট টেলিভেশনে ঢাকা শহরে দেখেছি মানুষের ঢল, তরুণদের হাতে লাঠি বা ওই জাতীয় কিছু। আবালবৃদ্ধবনিতা সবাই এগিয়ে চলেছে গণভবনের (শেখ হাসিনার সরকারি বাসভবন) দিকে। এমন পরিবেশে সাধারণ মানুষ (মহিলা, শিশুসহ) রিকশা করে বা হেঁটে যাচ্ছেন নিজের গন্তব্যপথে। তছনছ করা গণভবন তখন এক দর্শনীয় জিনিস।

ছাত্র নেতাদের অনুরোধে নোবেলজয়ী মহম্মদ ইউনুস দেশে ফিরলেন এবং ৮ আগস্ট দেশের অন্তর্বর্তী সরকারের মুখ্য উপদেষ্টা হিসেবে শপথ নিলেন। আন্দোলনের পুরোধা ছাত্রদের দাবি ছিল অন্তর্বর্তী সরকারে কোনও রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি থাকবেন না। ঠিক হল ৯ আগস্ট ১৬ জনের উপদেষ্টামণ্ডলি মুখ্য উপদেষ্টার অধীনে শপথ নেবেন। শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান আমি পুরোটাই দেখবো বলে এটিএন বাংলার চ্যানেলে চোখ রেখে আছি। মিনিট পাঁচেক দেরিতে অনুষ্ঠান শুরু হল। শপথ গ্রহণের প্রাক্কালে এক ঘোষণায় শোনা গেল যে ১৬ জনের জায়গায় ১৭ জন উপদেষ্টা শপথ নেবেন। ছাত্রদের প্রতিনিধি হিসেবে শপথ নিলেন নাহিদ ইসলাম এবং আসিফ মাহমুদ। কিন্তু ১৭তম প্রার্থী কে বা ১৬ জনের প্রাথমিক নাম নির্বাচনের পরে কার নাম প্রস্তাবিত উপদেষ্টামণ্ডলতে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন মুখ্য উপদেষ্টা? তিনি হলেন হেফাজত-এ-ইসলাম পার্টির উপপ্রধান প্রফেসর এএফএম খালিদা হোসেন। এই দল হল কট্টরপন্থী ধর্মীয় শিক্ষকদের (উলেমা) এবং ছাত্রদের সংগঠন। তখনই আমার মোহভঙ্গ হলো। আমি বুঝে গেলাম যে মৌলিক কিছু পরিবর্তন নিয়ে আসার পথে বাংলাদেশ যাচ্ছে না। তখনই আমি হোয়াটসঅ্যাপে আমার বাংলাদেশি বন্ধুকে জানাই, ‘ঘুরপথে এক মৌলবাদি প্রবেশ করলেন।’ বন্ধুর উত্তর, ‘তাই দেখছি দাদা।’


আসলে সেই মুহূর্তে বাংলাদেশের আন্দোলনের ধোঁয়াশাচ্ছন্ন চিত্রটা অনেকটাই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। কর্মক্ষেত্রে প্রাক্তন মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবারের মানুষদের কোটার বিরুদ্ধে যে আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তার লক্ষ্য একসময়ে হয়ে গেল আওয়ামি লিগ। সামান্য একদফা দাবির আন্দোলনকে সার্বিক শাসক বিরোধী আন্দোলনে পরিণত করে দিল কোন অনুঘটক, তা এখন আর বুঝতে কারও অসুবিধা হচ্ছে না।
অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের আগে থেকেই সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণের বিক্ষিপ্ত সংবাদ বাংলাদেশের সংবাদ মাধ্যমেই প্রচারিত হচ্ছিল। সেই সময় ফেসবুকে আমার বন্ধু ময়মনসিং শহরের হিন্দু ধর্মস্থানগুলিকে সাধারণ মানুষ পাহারা দিচ্ছেন এমন ছবি পোস্ট করেছিলেন। সাধারণ মানুষের এক প্রতিনিধি হিসেবে তিনিও আশায় ছিলেন সংখ্যালঘুদের উপর আক্রমণ ব্যাপক আকার ধারণ করবে না। কিন্তু, তা যে হবার নয়, সেটা এখন পরিষ্কার হয়ে গেছে।

১৯৭১ সাংল বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেও বুজিবের আমলেই মৌলবাদের বীজ বাংলাদেশের মাটিতে রোপিত হয়। ১৯৭২ সালে তিনি ইসলাম-বিরোধী কার্যকলাপ, যেমন জুয়া, ঘোড়দৌড় এবং মাদকসেবন বন্ধ করার নির্দেশ কার্যকরী করেন। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ ‘অর্গানাইজেশন অফ ইসলামিক কান্ট্রিজ’-এ যোগ দেয়। তাঁর নিজের হাতে রোপণ করা ইসলামিক মৌলবাদের বীজ বাংলাদেশে ধীরে ধীরে মহীরুহে পরিণত হয়। সামান্য পরিসংখ্যানই তার সাক্ষ্য দেয়। ১৯৭৪ সালে মুসলমান ও হিন্দু জনসংখ্যা বাংলাদেশে ছিল যথাক্রমে ৮৫.৪০ শতাংশ ও ১৩.৫০ শতাংশ। কিন্তু ১৯৯১, ২০০১ এবং ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী বাংলাদেশে মুসলমান ও হিন্দু জনসংখ্যা যথাক্রমে (৮৮.৩০ শতাংশ, ১০.৫০ শতাংশ), (৮৯.৭০ শতাংশ, ৯.২০ শতাংশ) এবং (৯০.০০ শতাংশ, ৮.৫০ শতাংশ)।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ১৫ বছরের আওয়ামি লিগ সরকারের শাসনকালে শেষ দিকে একনায়কতন্ত্রের পরিবেশ কায়েম হয়েছিল। ছাত্র বা সাধারণ মানুষের বিক্ষোভের কারণ সেই একনায়কতন্ত্রের চরম বিচ্যুতিগুলি হলেও, এটা মনে রাখতে হবে যে, পিছনে রাজনীতির মদত রয়েছে, শুধু মৌলবাদ নয়। সেটই প্রত্যক্ষ হলো যখন ‘বঙ্গবন্ধু’ মুজিবের বাড়ি এবং মূর্তি ভেঙে দেওয়া হলো। আওয়ামি লিগের কর্মীরা আক্রান্ত হলেন। ছাত্র রাজনীতির মৌলিক লক্ষ্য তো এটা ছিল না। বাংলাদেশে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি এই ডামাডোলের সুযোগে আওয়ামি লিগের অস্তিত্ব বিলোপের চেষ্টা করছে সুচারু পরিকল্পনা করেই। আর সেই অনুকূল পরিবেশ সাহায্য করছে মৌলবাদিদের সংখ্যালঘুদের অস্তিত্ব আরও সংকটাপন্ন করে তুলতে।

একটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রশাসনের দায়িত্বে যাঁরা আছেন, তাঁরা ভালোই জানেন যে, তাঁরা সাংবিধানিকভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধি নন। তাই প্রশাসনের নীচের স্তরের আনুগত্য তাঁরা আশা করতে পারেন না। দ্রুত সুষ্ঠু পরিবেশে নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠিত না হলে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ ক্রমশ খারাপের দিকে যাবে। এটা সেই দেশের বা প্রতিবেশী দেশের কাছে মঙ্গলকর নয়।

কর্ম-সংস্থানের ক্ষেত্রে ‘কোটাবিরোধী’ আন্দোলন এক সময় পরিণত হল তথাকথিত ‘দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধে’। আর প্রথম মুক্তিযুদ্ধের নায়ক আওয়ামি লিগ দলকে ঝাড়ে-বংশে উৎপাটিত করাই যদি এই ‘মুক্তিযুদ্ধের’ লক্ষ্য হয়, তবে একে আসল ‘মুক্তিযুদ্ধ’ নাম দিলেই ভালো হতো। রাজনীতি বা মৌলবাদের বাইরে থাকা সাধারণ মানুষের পরিপ্রেক্ষিতে কী চাওয়া হয়েছিল আর কী পাওয়া গেল, তা বিচার করলে বলতে হয় ‘যাহা চাই তাহা ভুল করে চাই / যাহা পাই তাহা চাই না’।