স্নেহাশিস সুর
রাষ্ট্রসঙ্ঘের জলবায়ু পরিবর্তন প্রতিরোধ সংক্রান্ত ৩০তম আন্তর্জাতিক সম্মেলন সোমবার থেকে ব্রাজিলের বেলেম শহরে শুরু হয়েছে। এর পোশাকি নাম কপ-৩০। কপ মানে কনফারেন্স অফ পার্টিজ। পরিবেশ সংক্রান্ত বার্ষিক এই বিশ্ব সম্মেল নের যথেষ্ট গুরুত্ব রয়েছে। উন্নত ও উন্নতিশীল সব রকমের দেশই এখানে আসে। উন্নত দেশগুলি শিল্পোন্নয়নের নামে যেভাবে এতকাল পরিবেশ ধ্বংস করেছে, তার ক্ষতিপূরণ বাবদ তারা যাতে পরিবেশের উন্নয়নে সারা বিশ্বে অর্থ বরাদ্দ ক রে, তার জন্য উন্নতিশীল দেশরা চাপ দেয়। গতবছরে ২৯তম কপ হয়েচিল আজারবাইজানের রাজধানী বাকুতে। কপ-২৯-এর মূল কেন্দ্রে ছিল জলবায়ু দূষণের হাত থেকে উন্নতিশীল ও অনুন্নত দেশগুলিকে বাঁচাতে উন্নত দেশগুলির কাছ থেকে অর্থ বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য উন্নতিশীল ও অনুন্নত দেশগুলির দর কষাকষি। তাই কপ-২৯ ছিল আর্থিক কপ।
এবারের কপ-৩০-এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে ‘কিছু করে দেখাও’। পরিবেশকে বাঁচাবার কথা বহুদিন ধরে হচ্ছে। তাই এবার বলা হচ্ছে কিছু করা হোক যা কাজে দেয় পরিবেশ দূষণ থেকে পৃথিবীকে বাঁচাতে। এবার প্যারিস চুক্তির দশ বছর হচ্ছে। চুক্তিটি হয়েছিল প্যারিসে ২০১৫ সালে আর চালু হয় ২০১৬ সালে। এই চুক্তিতে মূলত উষ্ণায়ন রোধে পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির পরিমাণ ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে এবং কার্যত ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখার অঙ্গীকার করা হয়। এর জন্য মূলত দূষিত গ্যাস নির্গমন কমাবার সিদ্ধান্ত হয়। তার জন্য জীবাশ্ম থেকে আসা জ্বালানি বা ফসিল ফুয়েল বা কয়লার ব্যবহার ব্যাপকভাবে কমানোর দিকে জোর দেওয়া হয়। কিন্তু বাকু-র কপ-২৯-এ কার্যত সেই অগ্রাধিকার থেকে বিভিন্ন দেশ কিছুটা সরে আসে বলেই মনে হয়েছিল।
এবারের কপ-৩০-এর কর্মসূচিতে প্যারিস চুক্তির সিদ্ধান্তগুলি কাজে লাগানোর একটা বিশ্বব্যাপী পর্যালোচনা গ্লোবার স্টক টেকিং— জিএসটি করা হবে। এছাড়া পরিবেশ দূষণ রোধে শুধু বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকারের দায়িত্বের বাইরে অসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং শিল্প সংস্থাগুলিকেও এগিয়ে আসার আহ্বান জানানো হয়েছে। সেই সঙ্গে প্রতিটি দেশ জলবায়ু দূষণ রোধ কর্মসূচিতে নিজেই যে অর্থ বরাদ্দ করে অর্থাৎ যে অর্থকে ন্যাশনালি ডিটারমিন্ড কন্ট্রিবিউশন বা এনডিসি বলে, সেটিও বাড়াবার আহ্বান জানানো হয়েছে।
এবারের বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন বসেছে ব্রাজিলের বেলেম শহরে। এই শহরটির অবস্থান অ্যামাজন জঙ্গলের ভিতরে বলা যায়। এর কারণ উন্নয়নের তাগিদে বনাঞ্চল যাতে নষ্ট করা না হয় বা পরিবেশ দূষণে বনাঞ্চলের যাতে ক্ষতি না হয়, তার জন্য সারা বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করা। কিন্তু এই ছোট শহর বেলামে বিশ্ব সম্মেলনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো গড়ে তুলতে বা এখানে যাবার রাস্তা চওড়া করতে যে পরিমাণ গাছ কাটা হয়েছে, সেই বিষয়টাও সকলের নজরে পড়েছে এবং তা নিয়ে সমালোচনাও যথেষ্ট হয়েছে। রাস্তা তৈরি ছাড়াও ব্রাজিলের বিরুদ্ধে আরেকটা বড় অভিযোগ যে, অ্যামাজনের জঙ্গল কেটে ক্যাশ ক্রপ হিসেবে প্রচুর সোয়াবিনের চাষ করছে। এতেও জঙ্গলের কার্যকারীতা নষ্ট হচ্ছে।
কপ সম্মেলনের আগে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়কদের সম্মেলন হয়। এবারেও হয়েছে। সেখানে বিশ্বব্যাপী বনাঞ্চল রক্ষা বিশেষত ট্রপিকাল ফরেস্ট রক্ষণাবেক্ষণের জন্য একটি বিশেষ পরিকাঠামো গড়া হয়েছে। ট্রপিকাল ফরেস্ট ফর এভার ফেসিলিটি সংগঠনে ভারত পর্যবেক্ষক হিসেবে থাকতে রাজি হয়েছে। কার্বন নির্মাণের কুফল থেকে পরিবেশকে বাঁচানোর জন্য ওইটি বিশ্বব্যাপী সর্বশেষ ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থার মাধ্যমে পৃথিবীর যেসব দেশে ট্রপিকাল ফরেস্ট আছে, তারা তা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রতি বছর টাকা পাবে।
কপ সম্মেলনকে ঘিরে প্রতি বছরই বহু সমীক্ষার প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। এবারে প্রথম দিনে যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, সেটি আন্তর্জাতিক পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি সংস্থার প্রতিবেদন। ইউএই-তে অনুষ্ঠিত ২৮তম কপ সম্মেলনে এই সংস্থা গঠিত হয় এবং এর কাজের এলাকা ছিল বিশ্বব্যাপী পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির ব্যবস্থার বাড়ানোর সমীক্ষা করা। কারণ, এ বিষয়ে লক্ষ্যমাত্রা ছিল বিশ্বে ২০৩০ সালের মধ্যে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির ব্যবহার বিশ্লেষণ করা আর এনার্জি এফিসিয়েন্সি মানে এই পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি ব্যবহারের ফলে শক্তি ব্যবহারের সামগ্রিক পারদর্শীতা দ্বিগুণ করা। এই প্রতিবেদনে দেখা গেছে সারা বিশ্বে অতিরিক্ত পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির উৎপাদন ক্ষমতা ৫৮২ গিগাওয়াট বেড়েছে। কিন্তু কপ-২৮শে নেওয়া এই পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি তিনগুণ লক্ষ্যমাত্রা অর্থাৎ ১১.২ টেডাওাট করতে যথেষ্ট নয়। এই লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে গেলে ২০২৫ থেকে প্রতি বছর পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির উৎপাদন ক্ষমতা ১৬.৬ শতাংশ হারে বাড়াতে হবে।
মার্কিন সংস্থা অ্যাডেলফি-র একটি প্রতিবেদনে এনার্জি ট্রানজিশন বা জীবাশ্ম থেকে তৈরি শক্তির ব্যবহার থেকে পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি ব্যবহারের দিকে বদলের পরিমাণ ২০২৩ থেকে ২০৫০-এর মধ্যে বর্তমান অবস্থা থেকে বাড়ালে এই অঞ্চলের মোট জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধির হার ১.১ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে এবং এই ক্ষেত্রে ১ কোটি ২০ লক্ষ নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ ঘটবে।
এই সংক্রান্ত আরও একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এটি প্রকাশ করেছে ইউনাইটেড নেশনস এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম (ইউএনইপি)। এটি তাদের দূষিত গ্যাস নির্গমণ সংক্রান্ত বার্ষিক প্রতিবেদন। এই প্রতিবেদনে দেখা গেছে কোনও কোনও দেশে দূষিত গ্যাস নির্গমণের হার তাদের নির্ধারিত পরিমামের চেয়ে বেশি। তাই সমীক্ষা গুরুত্বপূর্ণ কারণ যেখানে প্যারিস চুক্তিতে তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার ১.৫ ডিগ্রি বা ২.০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার কথা, সেখানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২..৬ ডিগ্রি থেকে ২.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যদি প্রতিটি দেশ তাদের নিজস্ব নির্ধারিত অর্থ পরিবেশ সংরক্ষণের কাজে ব্যয় করে তাহলে তা কমে ২.৩ ডিগ্রি থেকে ২.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে নামতে পারে।
প্রতিবারের মতো এবারেও অনেক আশা নিয়ে শুরু হয়েছে রাষ্ট্রসঙ্ঘের বিশ্ব পরিবেশ সম্মেলন কপ-৩০। তিরিশটি এই ধরনের বার্ষিক সম্মেলনের বিশ্বব্যাপী পরিবেশ দূষণের পরিস্থিতি যে জরুরি আকার ধারণ করেছে, তা এখন আর আলাদা করে বলার প্রয়োজন নেই। বিশেষ করে অনুন্নত ও উন্নতশীল দেশগুলির অবস্থা যে বেশি খারাপ, তাও সবার জানা। এই পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে যে কী করা দরকার, তাও এখন পরিষ্কার। প্রয়োজন এখন অর্থের। তার কতটা উন্নত দেশগুলি দেয়, সেটাই দেখার। তবে শুধু অর্থ নয়। যা করা দরকার সেটা করার সদিচ্ছারও প্রয়োজন। আর প্রয়োজন বিশ্বব্যাপী এক সুসংহত, সর্বসম্মত এবং সুঠাম ব্যবস্থার। যে ব্যবস্থা মেনে চলতে সবাই অঙ্গীকারবদ্ধই শুধু থাকবে না; তারা মেনে চলবেই। তবে এই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে পৃথিবী মুক্তি পাবে। ভালো কথা যে, বেলেমে অনুষ্ঠিত কপ-৩০ নীতিকথার চেয়ে কাজ করে দেখানোর দিকে জোর দিয়েছে। দেখা যাক সব দেশ এই বিষয়ে ঐকমত্য হয়ে কীভাবে পৃথিবীকে সুন্দর করে তোলার দিকে এগিয়ে যেতে পারে। এতেই কপ-৩০-এর সার্থকতা।