বিভেদ ও মেরুকরণের রাজনীতিকে চ্যাম্পিয়ন করতেই বাংলাভাষা বিদ্বেষ ও শ্রমিক হেনস্থা

বাড়িতে দুশ্চিন্তায় রুবিকুল ও জাফর আলির বৃদ্ধা মা।

বিহারে ভোটার লিস্টে নিবিড় সংশোধন (স্পেশ্যাল ইনটেনসিভ রিভিশন বা এসআইআর) প্রক্রিয়া শুরু এবং দিল্লিতে জয়হিন্দ ক্যাম্পে বাংলা ভাষায় কথা বলা পরিযায়ী শ্রমিকদের বিতাড়নের এমন সমাপতন সত্যিই আশ্চর্যের! আরও আশ্চর্যের হলো পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) সভাপতি ও রাজ্যসভার সাংসদ শমীক ভট্টাচার্য বাঙালি হয়েও অক্লেশে বলছেন বাংলা ভাষা বলে কিছু নেই! অথচ তাঁরই দলের বর্ষীয়ান কেন্দ্রীয় নেতা ও দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী এই রাজ্য সফরে এসে শ্রমজীবীদের হেনস্থার প্রশ্নে টু শব্দটি না করে বাংলাভাষাকে তিনি ও তাঁর কেন্দ্রের সরকার ধ্রুপদি ভাষার মর্যাদা দান করেছেন, সেকথা সগর্বে বলে যাচ্ছেন। তাহলে সবটাই কি গেম-প্ল্যান! সেটিং তত্ত্ব! শমীকের অজ্ঞতা! নাকি ধ্রুপদি বাংলা ভাষাকে অমর্যাদা করে গোবলয়ের রাজনীতিতে দড় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) এবং তার রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি নেতৃত্বের সুনজরে (গুড বুক) থাকার শমীকের এ এক অন্যরকম কৌশল!

শমীকের জেনে রাখা দরকার বাঙালির অস্তিত্ব পাঁচ হাজারেরও বেশি পুরনো এবং বাংলা ভাষাও দু’হাজার বছরের বেশি পুরনো। বাংলা ভাষায় কথা বলা জনগোষ্ঠী ভারতবর্ষের মধ্যে দ্বিতীয় এবং সমগ্র পৃথিবীতে দশের মধ্যেই। বাংলা ভাষাকে বিশ্বের দরবারে মর্যাদার আসনে বসিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর, মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সহ উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর শিল্পী সাহিত্যিকরা। বিজেপি যে দ্বিতীয়বার ত্রিপুরা রাজ্যে ক্ষমতা দখল করেছে তা তিপ্রামথা রাজনৈতিক দলের জন্য। এই তিপ্রামথার অন্যতম (প্রধানতমও বটে) পৃষ্ঠপোষক ত্রিপুরার রাজবাড়ির বর্তমান উত্তরাধিকারীরা। ত্রিপুরা রাজ্যের রাজারা ছিলেন তিব্বতি-বর্মি শাখার বোড়ো গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ত্রিপুরীরা তিপরা আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মানুষ। কিন্তু তাঁরাও বহু প্রাচীন কাল থেকে বাংলা ভাষার মাধ্যমেই সমস্ত রকম রাজকার্য নির্বাহ করতেন। তাঁদের মুদ্রা, অধ্যাদেশ, দানপত্র, দলিল দস্তাবেজ, রেভিনিউ স্ট্যাম্প, তাম্রপত্রে বাংলাভাষা তথা বাংলা হরফ ব্যবহার করা হতো। ত্রিপুরা রাজ্যে বাঙালিদের বসবাস পাঁচশো বছরেরও বেশি। ত্রিপুরার রাজারাই বিভিন্ন সময়ে ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য প্রভৃতি বাঙালি কুল-ঠিকুজির ভাগ হওয়া মানুষদের জমি জায়গা দিয়ে এবং অনেককে রাজকার্যে নিযুক্ত করেন। এবং ওই রাজ্যে তাঁদের পাকাপাকিভাবে বসবাসের ব্যবস্থাও করেন। বিজেপি এসব জেনেও বাংলাভাষায় ভিনরাজ্যে কথা বললে হেড কনস্টেবল বা তার ঊর্ধ্বতম অফিসার যে কাউকে ধরতে পারে এমনই আইন তারা পাশ করেছে।

স্মর্তব্য, ত্রিপুরা রাজ্যটি ছিল সম্পূর্ণ স্বাধীন দেশীয় হিন্দু রাজ্য। অতি প্রাচীন এই রাজ্যটির রাজারা ইংরেজ সরকারের দাক্ষিণ্য পাওয়া রাজা ছিলেন না। তাঁরা ছিলেন বংশানুক্রমিক ‘মহারাজা’ খেতাবের অধিকারী। ব্রিটিশ সরকার ১৭৬১ খ্রিস্টাব্দে ত্রিপুরা রাজ্যটি (মূলত সমতল ত্রিপুরা অংশটি সমতল ও পার্বত্য ত্রিপুরায় বিভক্ত ছিল) ইংরেজ সরকার দখল করলেও ১৮৭১ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ত্রিপুরার রাজারা ছিলেন কার্যত স্বাধীন। এই ত্রিপুরাতে বাঙালিরা পূর্ব পাকিস্তান থেকে বারে বারে উৎখাৎ হয়ে ছোট্ট এই রাজ্যে আশ্রয় পেয়ে স্থায়ী বাসিন্দা হয়েছেন। বিশেষ করে ১৯৪৬-এর নোয়াখালি দাঙ্গা, ১৯৪৭ সালের দেশভাগ, ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পরে। কালে কাল ত্রিপুরার রাজন্যবর্গের পৃষ্ঠপোষকতায় বাঙালিরা আশ্রয় পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে সেই রাজ্য পরিচালনা করছেন। বিজেপি যে সে রাজ্যে উপর্যুপরি দু’বার ক্ষমতা দখল করেছে— সেখানে চলছে বাঙালিরাজ। বর্তমানে ৩৭ লক্ষাধিক জনসংখ্যার ৬৯ শতাংশ বাঙালি। অথচ একসময় সে রাজ্যে আদিবাসীরাই ছিলেন সংখ্যাগরিষ্ঠ। যাঁদের সাহায্যে শমীকের দল ত্রিপুরায় দ্বিতীয়বার ক্ষমতা দখল করে রাজ চালাচ্ছে তাঁদের (ত্রিপুরার রাজন্যবর্গ) এই রাজ্যেও বিংশ শতাব্দীর শুরুর লগ্ন থেকে বাংলাভাষা ও বাঙালিদের পৃষ্ঠপোষকতা করে আসছে। ত্রিপুরা কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক ও বিশিষ্ট রবীন্দ্র গবেষক ও বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়, কলকাতা, বর্ধমান, প্রেসিডেন্সি, রবীন্দ্রভারতী, বিশ্বভারতী সহ বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে নানান সময়ে পাঠদান করা ড. শিশিরকুমার সিনহা জানুয়ারি ২০২৫-এ ‘ত্রিপুরা ও রবীন্দ্রনাথ এবং বাংলাভাষা ও সাহিত্যের রূপান্তরে কয়েকজন বিশিষ্ট সাহিত্য-সাধক’ বইয়ে (অক্ষর পাবলিকেশনস, আগরতলা) পুঙ্খানুপুঙ্খ এসব লিখেছেন।


অধ্যাপক সিনহা জানাচ্ছেন রাজা যযাতি থেকে মহারাজ কিরীটবিক্রম কিশোর মাণিক্য পর্যন্ত ত্রিপুরার ১৪৪ জন রাজার তালিকা পাওয়া যায়। মহারাজ ধর্ম মাণিক্যই (১৪৩১-১৪৬২) প্রথম রাজা, যাঁর শাসনকালে যথার্থ অর্থে পৃষ্ঠপোষকতার সূচনা হয়। কিন্তু বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষক মহারাজ বীরচন্দ্র মাণিক্য। তিনি রবীন্দ্রনাথকে যুবাবস্থায় নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন। অধ্যাপক সিনহা লিখছেন— ‘মহারাজ বীরচন্দ্রের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতার আরও পরিচয় পাওয়া যায় ভাগবত গ্রন্থের বাংলা অনুবাদ প্রকাশের মধ্যে। পণ্ডিত রামনারায়ণ বিদ্যারত্ন বহরমপুর থেকে যে ভাগবত গ্রন্থের অনুবাদ করেন, সেটি গ্রন্থটির মূদ্রণ ও প্রচার ও বিনামূল্যে বিতরণের দায়ভার মহারাজ গ্রহণ করেন। তাছাড়া কবি নরহরি চক্রবর্তী কর্তৃক সংকলিত হস্তলিখিত ‘গীত চন্দ্রোদয় পদাবলী’ গ্রন্থটির ‘অষ্টকাল রাগানুরাগ’ খণ্ড পর্যন্ত তাঁর প্রচেষ্টায় মুদ্রিত হয়।’ (ত্রিপুরা রবীন্দ্রনাথ ও বাংলা ভাষা, পৃষ্ঠা: ৬৬-৬৭)

বাংলা ভাষা ও বাঙালিদের সাহিত্য, শিল্প, সংস্কৃতি, সংগীত, চারুকলা, শিক্ষা ও বিজ্ঞানের জন্য ত্রিপুরার মহারাজারা বংশপরম্পরায় শতাব্দীর পর শতাব্দী যেভাবে পৃ,্ঠপোষকতা করেছেন তা তুলনারোহিত। শমীক ভট্টাচার্য বাংলা ভাষা বলে কিছু নেই বলতে পারেন কিন্তু সেই ভাষার উন্নতিকল্পে বা সেই ভাষায় ব্যুৎপত্তি অর্জন করে যে সমস্ত বাঙালি সাধক কষ্টে দিনাতিপাত করেছেন, তাঁদের অকাতরে ত্রিপুরার মহারাজারা সাহায্য করে গিয়েছেন। আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর বিজ্ঞানাগার প্রতিষ্ঠা, বিলেতে যাওয়ার রাহাখরচ, বিলেতে গবেষণা সম্পূর্ণ করার জন্য বিভিন্ন সময়ে মহারাজের অনুপ্রেরণ, কবি হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের আর্থিক দূরবস্থা দূর করার জন্য মাসিক বৃত্তি প্রদান, ড. দীনেশচন্দ্র সেনের বঙ্গভাষা ও সাহিত্যে অবদানর জন্য বৃত্তিপ্রদান এসবই অতুলনীয় ঘটনা যা বিশেষভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। বীরচন্দ্র ও রাধাকিশোর যেভাবে সাহিত্য, শিল্পকলা, সংগীত, শিক্ষা প্রভৃতির পৃষ্ঠপোষকতা করেছিলেন, বীরেন্দ্রকিশোর ও বীরবিক্রমকিশোরও সেই পরম্পরা রক্ষা করেছিলেন। একইভাবে ১৯৪১, ১৯৪৬, ১৯৪৭-এর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় পূর্ববঙ্গের ছিন্নমূল বাঙালিদের নিশ্চিত আশ্রয় দান করে মানবিকতার যে পরিচয় স্বাক্ষর রেখেছিলেন, তা চিরস্মরণীয়। ড. সিনহা তাঁর গবেষণালব্ধ বইয়ে এসব পৃষ্ঠার পরতে পরতে উল্লেখ করেছেন। এসব শমীক ভট্টাচার্যদের জানার কথা নয়, তাঁরা এসব জানতেও চান না। যে কোনও উপায়ে তাঁদের অপর খুঁজে বেড়াতে হয়, রাজনীতির বেসাতি করতে হয়, শ্রমজীবীদের (হিন্দু ও মুসলমান নির্বিশেষে) হেনস্থা ও নিপীড়ন করে বাংলাদেশি সন্দেহে ধরপাকড় করে হয় ডিটেনশন ক্যাম্পে প্রেরণ কিংবা বাংলাদেশে পুশ ব্যাক (ঠেলে পাঠানো) করতে হয়। পাঁচটি পর্বে লেখা দুই মলাটে ২৭২ পৃষ্ঠার বইটি পড়লে বাংলাভাষা ও বাঙালিদের সম্পর্কে যে কেউ সম্যক অবহিত হবেন। অধ্যাপক সিনহাকে লাখো কুর্নিশ।

গত সোমবার (১ সেপ্টেম্বর ২০২৫) থেকে বলবৎ হওয়া অভিবাসন ও বিদেশি আইনে কেবল সন্দেহের বশে কাউকে গ্রেপ্তার করার অধিকার দেওয়া হয়েছে পদমর্যাদায় হেড কনস্টেবলকে। ধর্মীয় মেরুকরণের লক্ষ্যে এসব যে কেন্দ্রের বিজেপি পরিচালিত এনডিএ সরকার করছে বিশেষজ্ঞদের অভিমত অন্তত তাই। মাসাধিককাল জুড়ে পরিযায়ী শ্রমিকদের হরিয়ানা, দিল্লি, ওড়িশা ইত্যাদি রাজ্যে হেনস্থা ও নিপীড়নের শিকার হতে হচ্ছে তথাকথিত বিজেপির ডবল ইঞ্জিন সরকারের হাতে। শ্রমিকরা বাংলাভাষায় কথা বললেই তাঁদের বৈধ কাগজপত্র আছে কী নেই, সেই সংক্রান্ত বিষয়ে কোনওরূপ পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করেই বা সংশ্লিষ্ট সরকারের কাছে (এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ সরকার) তাঁদের হোয়ারঅ্যাবাউট জানতে না চেয়েই গ্রেপ্তার ও পুশব্যাক করা হচ্ছে বা হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল সরকারের সুপ্রিমো মুখ্যমন্ত্রী তাঁদের রাজ্যে ফিরিয়ে এনে মাসিক ভাতা দেওয়ার কথা (মাসে ৫ হাজার টাকা) বলছেন। কিন্তু একথা জোরের সঙ্গে বলতে তিনি পারছেন না, ভারতবাসী হিসাবে যে কেউ যে কোনও রাজ্যে কাজ করতে যাওয়ার সাংবিধানিক অধিকারী। কেন একজন শ্রমজীবী পরিযায়ী হন তা কি তিনি বা তাঁর মন্ত্রীরা ভেবে দেখেছেন বা পর্যালোচনা করেছেন? গ্রামেগঞ্জে কর্মসংস্থানের কোনও সুযোগ নেই। না কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে, না রাজ্য সরকারের তরফে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা হয়নি দীর্ঘ এক দশকে।

এ রাজ্যে তৃণমূল সরকার ঘোষণা করেছে ৮০টি ধরনের পেশার ক্ষেত্রে ন্যূনতম মজুরি চালু করার কথা। কিন্তু আজ পর্যন্ত কোনও পেশার ক্ষেত্রেই এই ন্যূনতম মজুরি দেওয়ার কথা থাকলেও শ্রমিকরা তা পাচ্ছেন না। এক হিসেবে নাগরিক মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক নব দত্ত জানিয়েছেন, বিড়ি শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি ২৫৭ টাকা দেওয়ার কথা। কিন্তু তাঁরা সাকুল্যে ন্যূনতম মজুরি ১৩৭ টাকা থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত প্রতি হাজার বিড়ি বাঁধার জন্য। এক হাজার বিড়ির সঙ্গে আরও ২০০ বেশি বিড়ি বাঁধতে হবে, তবেই এক হাজার বিড়ি বাঁধার মালিক নির্ধারিত মজুরি শ্রমিক পাবেন। শ্রী দত্ত জানিয়েছেন, বিড়ি মজুরদের মজুরি চুরি করে বছরে দশ হাজার কোটি টাকা সাশ্রয় করছে বিড়ি মালিকরা এবং এর বিরুদ্ধে কোনও ট্রেড ইউনিয়ন কিংবা সরকার মালিককে বাধ্য করাতে পারেনি শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি দিতে। কাজ পাওয়ার সাংবিধানিক অধিকারকে অস্বীকার করে চলছে অনুদানের রাজনীতি।

চা বাগিচা শ্রমিক, পাট শিল্পের শ্রমিক কেউই ন্যূনতম মজুরি পান না। ফলে পেশার বিভিন্ন ক্ষেত্রে কর্মরত শ্রমিকরা বেশি মজুরি পাওয়ার আশায় ভিন রাজ্যে পাড়ি দেন। সেই সমস্ত রাজ্যে একজন শ্রমিক দিনে প্রায় ৬০০ থেকে ৯০০ টাকা পর্যন্ত (অবশ্যই যোগ্যতা অর্থাৎ কর্মদক্ষতা অনুযায়ী) রোজকার করতে পারেন। সুন্দরবনের পুরুষ মানুষরা সন্তানদের (বিদ্যালয়ছুট) নিয়ে ভিন রাজ্যে পাড়ি দেন হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে। সুন্দরবনে নদীবাঁধ ভাঙতে ভাঙতে (প্রাকৃতিক কারণেই বেশি) নোনা জল ক্ষেতে বারে বারে প্লাবন ঘটালে শস্য উৎপাদন আর সম্ভব হয় না। কতজন আর মধু সংগ্রহ, মীন ধরা, কাঁকড়া, মাছ ধরতে গিয়ে বাঘের পেটে যাবেন? জনসংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়ে ৪৫ লক্ষেরও বেশি দাঁড়িয়েছে। এই বিপুল সংখ্যক মানুষ রুটিরুজির জন্যই ভিনদেশে পাড়ি জমান কাজের সন্ধানে। মহাত্মা গান্ধী গ্রামীণ রোজগার নিশ্চয়তা আইনের আওতায় একশ দিনের কাজে বিগত পাঁচ বছর ধরে বন্ধ আছেঠ কেন্দ্র-রাজ্য আকচা-আকচিতে। এদিকে গ্রামীণ মজুররাও কৃষিক্ষেত্রে কোনও কাজ পাচ্ছেন না। কেন না কৃষকদের সিংহভাগ অংশই বর্তমানে ৫ থেকে ১০ বিঘা জমির মালিক, যাঁরা জমি লিজে দিয়ে দেন।

একজন কৃষক বা একাধিক কৃষক সেই জমি চাষ করে জমি মালিককে নির্দিষ্ট শস্য উৎপাদন অনুযায়ী বা বাৎসরিক টাকা দিয়ে জমি চাষ করে থাকেন। এক্ষেত্রে ভূমিহীন কৃষকদের কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকে না। যদিও বা থাকে তাঁরা ন্যূনতম মজুরি পান না। যে সমস্ত জেলায় নিবিড় কযষি উৎপাদন ব্যবস্থা চালু আছে, সেখানে মজুরি কিছুটা বেশি কিন্তু ঠিকা প্রথায় চাষ হলে মজুরদের সংখ্যা কমে যায়। ফলে পরিযান ছাড়া গ্রামীণ ভূমিহীনদের অন্য কোনও বিকল্প থাকে না। লাঙল যার জমি তার এই স্লোগান কবেই পুরনো হয়ে গিয়েছে। জমি যার চাষ তার এই স্লোগানে ভূমিহীন কৃষক আজ কাজ পান না। মালদা, মুর্শিদাবাদ, দুই ২৪ পরগনা, পূর্ব মেদিনপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর প্রভৃতি জেলা থেকেই পরিযায়ী শ্রমিক ভিনরাজ্যে পাড়ি জমান। এবং এদের সিংহভাগ অংশই মুসলমান। এবং বিজেপি-আরএসএস-এর রাজনীতিতে এরা অপর বিভেদের রাজনীতিকে মূলধন করে এরা (বিজেপি) সর্বত্র সবকিছু দখলে নিতে উদ্যত। এদের কাছে বাংলা ভাষা ভাষাই নয় এবং যাঁরা বাংলা ভাষায় কথা বলে বিশেষ করে পরিযায়ীরা তাঁরাই আইনের (অভিবাসন ও বিদেশি আইন) ঘেরা পরিযায়ীরা তাঁরাই আইনের (অভিবাসন ও বিদেশি আইন) ঘেরাটোপে বন্দি হবেন। মেরুকরণের রাজনীতির জন্যই আইন পাশ।

এ বছরের শেষে (অক্টোবরের শেষে বা নভেম্বরে) বিহারের বিধানসভা নির্বাচন। এসআইআর চালু করে ৬৫ লক্ষ বিহারবাসীর নাম খসড়া লিস্ট থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে রাহুল গান্ধী (জাতীয় কংগ্রেস), তেজস্বী যাদব (রাষ্ট্রীয় জনতা দল) ও দীপঙ্কর ভট্টাচার্য (সিপিআইএমএল লিবারেশন) দুই সপ্তাহের বেশি দিন ধরে সাসারাম থেকে পটনা পর্যন্ত ১৩০০ কিলোমিটার যে এসআইআর বিরোধী ভোটার অধিকার যাত্রা করলেন, বিহারের রাজনীতিই নয়, সারা দেশের রাজনীতিতে তার ব্যাপক সাড়া পড়েছে। সে কারণেই ইস্যু ঘুরিয়ে দিতে বিজেপির প্রয়োজন ছিল অন্যরকম বিদ্বেষ-পরিযায়ী নিপীড়ণ, বাংলাভাষী নিপীড়ণ। কারণ আগামী বছর বাংলার নির্বাচন। মেরুকরণ ছাড়া জেতা অসম্ভব। দীর্ঘদিন ধরে তারা কি ক্ষমতার বাইরে এই রাজ্যে থাকবে? সেটিং থাকা মানে চিরদিন তৃণমূলকে ক্ষমতায় রেখে দেওয়া এ ধরনের চিন্তা যাঁরা করছেন বিশেষজ্ঞরা বলছেন তা ভুল চিন্তা। হিন্দু-হিন্দি-হিন্দুস্তান গড়তে হলে যে কোনও ধরনের বিদ্বেষ তাঁরা করতে পারেন। হিন্দু মহাসভার স্রষ্টা বাংলাভাষী শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় হলেও এবং তাঁকে সংঘবাহিনী গুরু মানলেও বাংলাভাষা বিদ্বেষী হতে খোদ বাঙালি বিজেপি নেতারও অসুবিধা হচ্ছে না। বিভেদের রাজনীতির এমনই মহিমা! বাংলার বিপ্লবী, বামপন্থী, গণতান্ত্রিক ও দেশপ্রেমিক শক্তিকেই বিজেপির ভয় বেশি। সে কারণে যে কোনওভাবে হোক বাংলাকে বিপর্যস্ত কর— এই রাজনীতিতে তারা এগোচ্ছে। এই সময় শাসক দলকে বাদ দিয়ে সব শক্তির ঐক্যবদ্ধ হওয়া ও রাস্তার লড়াইয়ে থাকাই একমাত্র বিভেদের রাজনীতির মোকাবিলা করতে পারে।