পঙ্কজকুমার চট্টোপাধ্যায়
অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে এশীয় নারী হিসেবে সহিত্যে প্রথম নোবেল পুরস্কার পেলেন ৫৩ বছর বয়সী দক্ষিণ কোরীয় সাহিত্যিক হান কাং। সেই দেশের প্রথম নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির আনন্দে দক্ষিণ কোরীয় মানুষ উচ্ছ্বাসে মেতে ওঠেন। সরকারি কাজ বন্ধ হয়ে যায় এবং সরকারি কর্মীরা উল্লাস করতে থাকেন। দেশের প্রেসিডেন্ট ইয়ুন সুক ইয়েওল হানকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, ‘আপনি আমাদের আধুনিক ইতিহাসের বেদনাময় ক্ষতগুলিকে মহান সাহিত্যে পরিণত করেছেন। কোরীয় সাহিত্যের মূল্যকে ঊর্ধে আসীন করার জন্য আমি আপনাকে সম্মান জানাই।’’ প্রেসিডেন্টের এই উক্তি প্রহসনে পর্যবসিত হয় যখন মাত্র তিন মাস পরেই ৩ ডিসেম্বর তিনি সেই দেশে সামরিক আইন জারি করেন। রাস্তায় টহল দিতে থাকে সাঁজোয়া ট্যাঙ্ক বাহিনী। আর নাগরিকের, সংবাদমাধ্যমের বাকস্বাধীনতা এবং সমাবেশের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। এই ভাবে তিনি কি নিজেই দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাসে এক বেদনাময় ক্ষত সৃষ্টি করলেন না, দেশের গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকে অসম্মান জানিয়ে?
ইতিহাসের যে বেদনাময় ক্ষতের ইঙ্গিত প্রেসিডেন্টের উক্তিতে আছে তা মূলত ১৯৮০ সালের গোয়াংজু বিদ্রোহ বা ‘মে ১৮’ নামে পরিচিত। ১৯৬১ সালে থেকে দীর্ঘ ১৮ বছর ধরে দেশের একনায়ক পার্ক চুং হি আততায়ীর হাতে ২৬ অক্টোবর নিহত হলেও দেশে একনায়কত্বের অবসান হয়নি। তাঁর উত্তরাধিকারি চোই কিয়িউ-হা-এর হাতে দেশের ক্ষমতা কার্যকরি ভাবে আসেনি। সেনাবাহিনীর প্রধান চুন দু-হোনানের নেতৃত্বে ১২ ডিসেম্বর সামরিক অভ্যুত্থান হয় এবং চুন নতুন একনায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তিনি বিরোধী দলের নেতা এবং কর্মীদের গ্রেপ্তার করতে থাকেন। ছাত্র ও শিক্ষকদের নেতৃত্বে দেশের অবহেলিত প্রদেশ দক্ষিণ জেওলার রাজধানী গোয়াংজু শহরে বিদ্রোহ শুরু হয়। উত্তর কোরিয়া এই অবস্থার সুযোগ নেবে এই অজুহাতে আমেরিকার কার্টার প্রশাসনের সহযোগিতায় চুন দু-হোনানের নেতৃত্বে সামরিক বাহিনী সামরিক আইনের ক্ষমতায় বলীয়ান হলে ছাত্র-শিক্ষক-নগরবাসীদের উপর আক্রমণ চালায়। ধর্ষণ, হত্যা এবং নিপীড়ন করা হয়। গণহত্যায় ৬০০ থেকে ২৩০০ মানুষ মারা যান।
এই ঘটনার সময় গোয়াংজুর অধিবাসী নোবেল জয়ী হানের বয়স মাত্র দশ। যদিও হান কাং খুব কম বয়সে গোয়াংজু ত্যাগ করেন তবুও শহরের উত্তরাধিকার তাঁকে তাড়া করে বেরিয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার ইতিহাসে এক প্রধান ঘটনা গোয়াংজু বিদ্রোহ এমন এক গুরুত্বপূর্ণ এবং বেদনাময় মুহূর্ত যে হান কাং-এর লেখাকে প্রভাবিত না করে পারেনি। এই দুঃখজনক ঘটনায় তৎকালীন সামরিক একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে অসংখ্য মানুষ নিহত হয়েছেন। হান কাং এই ঘটনার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত না হলেও, বিদ্রোহের কাহিনিগুলিতে এবং সমষ্টিগত বেদনায় তিনি ব্যক্তিগত সম্পর্ক খুঁজে পান।
হান কাং-এর সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য গ্রন্থের অন্যতম ‘হিউম্যান অক্টস’-এ তিনি গোয়াংজু বিদ্রোহের ভয়ঙ্করতার মুখোমুখি কাহিনিবিন্যাসের পথে এগিয়েছেন। ছয়টি আখ্যানের মধ্য দিয়ে তিনি এক বালকের কাহিনি বলেছেন যে বিদ্রোহের সময় মারা যায় এবং অন্য আরও কয়েকজনের কাহিনি লিপিবদ্ধ করেন যারা বিদ্রোহের ভয়াবহতার স্মৃতি নিয়ে বেঁচে আছেন। এই কাহিনি একই সঙ্গে গোয়াংজুর মানুষদের সহনশীলতার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ এবং ব্যক্তিগত ও জাতীয় চেতনার গভীরে নিহিত বেদনার অন্বেষণ। তিনি সচেষ্ট থেকেছেন যাঁদের কণ্ঠরোধ করা হয়েছে তাদের কণ্ঠদান করতে এবং ইতিহাসে উপেক্ষিত বা অবভাসিত এক ট্রাজেডির স্মৃতি সংরক্ষণ করতে।
গোয়াংজু বিদ্রোহের পর থেকেই বিরোধী নেতা কিং দে-জুং-এর নেতৃত্বে একনায়কতন্ত্র বিরোধী আন্দোলন চলতে থাকে। দীর্ঘ ১৭ বছর পরে ১৯৯৭ সালে কিম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিলে দেশে গণতান্ত্রিক সরকারের প্রতিষ্ঠা হয়। কিন্তু, গণতান্ত্রিক রাজনীতির উপর আঘাত আসতেই থাকে। এর আগে ২০১৬ সালে দেশের নারী প্রেসিডেন্ট পার্ক গেউন-হিয়ে-এর বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আসে যে ‘শমনীয়’ প্রথারনেতা চোই তায়ে-মিন-এর কন্যা চোই সুন-সিল প্রেসিডেন্টের উপর অস্বাভাবিক প্রভাব খাটাচ্ছেন। এই দুই নারীর যৌথ কেলেঙ্কারির বিরুদ্ধে পার্লামেন্ট ইমপিচমেন্টের মুখোমুখি হন প্রেসিডেন্ট এবং ক্ষমতাচ্যুত হন। এই অপসারণকে দেশের সুপ্রিম কোর্ট ৮-০ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় মান্যতা দেয়।
দেশে গত ৩ ডিসেম্বর সামরিক আইন লাগু হবার পরেও শাসক দল পিপল পাওয়ার পার্টি (পিপিপি) প্রথম দিকে প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্ট প্রক্রিয়াকে সমর্থন জানায়নি। দল ভেবেছিল ইয়ুন নিজেই ক্ষমতা থেকে সরে আসবেন। কিন্তু বিফল হয়ে দলনেতা হান দোং-হুন জানান, ‘‘ইমপিচমেন্টের থেকেউত্তম পথ আমরা খোঁজবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু, তাতে আমরা সফল হইনি।’’ পরে গত শনিবার ১৪ ডিসেম্বর পার্লামেন্টে ইমপিচমেন্ট অনুমোদন লাভ করে। শাসক দলের বেশ কিছু সদস্য ইমিপচমেন্টের পক্ষে ভোট দেন। এবার নিয়ম অনুযায়ী দেশের সুপ্রিম কোর্ট আগামী ৬ মাসের মধ্যে ইমপিচমেন্টের উপর রায় দেবেন এবং পরবর্তী দুই মাসের মধ্যে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। দেখা যাক ইয়ুন সুপ্রিম কোর্টকে প্রভাবিত করতে পারেন কিনা। সেই দেশের সংবিধানে সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতা এখনও অক্ষুণ্ণ আছে। ইজরায়েলের একনায়ক বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু গাজা যুদ্ধের আগে এই কারণেই চেষ্টা করেছিলেন সুপ্রিম কোর্টের প্রভাব থেকে দেশের প্রেসিডেন্টের পদকে মুক্ত রাখতে।
গত ৬ ডিসেম্বর স্টকহোমে নোবেল পুরস্কার অনুষ্ঠানের প্রাক্কালে তিনি এক সাক্ষাৎকারে জানান, ‘অনেক কোরিয়াবাসীর মতো আমি ব্যথিত এবং আমি দেশের পরবর্তী ঘটনাবলীর উপর নজর রাখছি। ‘হিউম্যান অ্যাক্টস’ লেখার সময় আমি ১৯৭৯ সাল এবং ১৯৮০ সালের অভ্যুত্থানের মধ্যবর্তী সময়ের সামরিক আইন পরিস্থিতি জানতে অনেকসময় ব্যয়করেছি। তাই ২০২৪ সালে আমার চোখের সামনে এক সমতুল পরিস্থিতির সাক্ষী হওয়া… এক চমকে যাওয়ার মতো ঘটনা।’
তবে, আগামী ছয় মাস দক্ষিণ কোরিয়ার গণতন্ত্রের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। গত ৩ ডিসেম্বর আমেরিকার ‘স্কুল অফ সোশ্যাল ওয়ার্ক’-এর দক্ষিণ কোরিয় ‘অধ্যাপক’ এবং ‘অ্যাসোসিয়েট ডিন ফর রিসার্চ’ হিয়েউক ‘ক্রিস’ হাম দক্ষিণ কোরিয়াতে একটি বিবাহানুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। তিনি বস্টন ইউনিভার্সিটির ‘পিওভি’ পেজে লিখেছেন, ট্রাম্পের শাসনে দ্বিতীয়বারের মতো আসতে চলা আমেরিকার দেশবাসীকে দক্ষিণ কোরিয়ার সাম্প্রতিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মনে রাখতে হবে যে ‘গণতন্ত্র কখনও নিশ্চিত বা প্রতিশ্রুত নয়।’