একশো দিনের কাজের প্রকল্প— মনরেগা— শুধু একটি সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প নয়, ভারতের গ্রামীণ অর্থনীতির মেরুদণ্ড। সেই প্রকল্পের নাম বদলের সিদ্ধান্ত যে আসন্ন, তার ইঙ্গিত আগেই মিলেছিল। গত সোমবার তা বাস্তব রূপ নিল। নরেন্দ্র মোদী সরকার লোকসভায় যে বিল পেশ করেছে, তাতে ‘মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল রুরাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি অ্যাক্ট’-এর পরিবর্তে প্রস্তাব করা হয়েছে নতুন নাম— ‘বিকশিত ভারত— গ্যারান্টি ফর রোজগার অ্যান্ড আজীবিকা মিশন (গ্রামীণ)’, সংক্ষেপে ‘ভিবি-জিরামজি’। এই নামকরণেই স্পষ্ট, জাতির জনকের নাম সরিয়ে এক নতুন রাজনৈতিক আদর্শের বার্তা দেওয়ার চেষ্টা করছে কেন্দ্র।
কিন্তু বিরোধীদের আপত্তি কেবল নাম বদলেই সীমাবদ্ধ নয়। তাঁদের অভিযোগ, এই বিলের মাধ্যমে মনরেগা প্রকল্পের মৌলিক চরিত্রই বদলে ফেলা হচ্ছে। সোমবার সাংসদদের মধ্যে যে বিলটি সার্কুলেট করা হয়েছে, সেখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে— নতুন প্রকল্পের মোট ব্যয়ের ৪০ শতাংশ বহন করতে হবে রাজ্য সরকারগুলিকে। এতদিন পর্যন্ত এই প্রকল্পের সম্পূর্ণ অর্থ জোগাত কেন্দ্র। ফলে রাজ্যগুলির উপর আর্থিক চাপ যে বিপুল পরিমাণে বাড়বে, তা নিয়ে প্রায় সর্বসম্মত মত তৈরি হয়েছে।
সিপিএম সাংসদ জন ব্রিটাসের বক্তব্য, কেরালার মতো ছোট রাজ্যকেও বছরে অতিরিক্ত দুই থেকে আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয় করতে হতে পারে। প্রশ্ন উঠছে— যখন রাজ্যগুলির আর্থিক অবস্থাই ক্রমশ দুর্বল করা হচ্ছে, তখন কেন এমন একটি বিল আনা হল, যা কেন্দ্রের দায়িত্ব আরও কমিয়ে দেয়?
নতুন প্রকল্পে কাজের দিন বাড়িয়ে ১২৫ করার কথা বলা হলেও, তাতে শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। প্রস্তাবিত বিলে চাষের মরসুমে বছরে অন্তত দু’মাস কাজ বন্ধ রাখার শর্তের উল্লেখ রয়েছে বলে সরকারি সূত্রের দাবি। ফলে কাগজে কলমে কাজের দিন বাড়লেও বাস্তবে গ্রামীণ শ্রমিকরা কতটা উপকৃত হবেন, তা নিয়ে গভীর সংশয় থেকেই যাচ্ছে।
সমালোচনা কেবল বিরোধী শিবিরে সীমাবদ্ধ নয়। এনডিএ-র শরিক চন্দ্রবাবু নাইডুর দল টিডিপিও এই বিল নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। তাদের আশঙ্কা, পরিকল্পনার বাইরে কোনও অতিরিক্ত খরচ হলে তার দায়ও রাজ্যগুলিকেই বহন করতে হবে। এতে প্রকল্পের সর্বোচ্চ উপভোক্তাদের কাছে পৌঁছনো আদৌ সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যাচ্ছে।
বিরোধীদের অভিযোগ আরও তীব্র। তাঁদের মতে, গ্রামীণ কর্মসংস্থান ও রোজগারের মতো সংবেদনশীল বিষয়েও মোদী সরকার রাজনৈতিক খেলায় নেমেছে। শর্তসাপেক্ষ প্রকল্প ও রাজ্যগুলির উপর আর্থিক বোঝা চাপানোর এই সিদ্ধান্ত কোনওভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। সেই কারণেই বিলটি খতিয়ে দেখতে যৌথ সংসদীয় কমিটি (জেপিসি) গঠনের দাবি উঠেছে।
এর পাশাপাশি মহাত্মা গান্ধীর নাম সরিয়ে ‘রামজি’ সংযুক্ত করার বিষয়টিকে ধর্মীয় ও আদর্শিক রাজনীতির অংশ বলেও কটাক্ষ করেছে বিরোধীরা। তৃণমূল সাংসদ কাকলি ঘোষ দস্তিদার লোকসভার বিষয় উপদেষ্টা কমিটিতেই এই বিলের বিরোধিতা করেন। ডেরেক ও’ব্রায়েন আরও সরাসরি আক্রমণ শানিয়ে বলেন, মনরেগা থেকে গান্ধীর নাম মুছে ফেলা মানে জাতির জনককে অপমান করা। কংগ্রেস সাংসদ প্রিয়াঙ্কা গান্ধীও প্রশ্ন তুলেছেন— প্রকল্পের নাম বদলাতে গিয়ে প্রশাসনিক কাঠামো, নথি, স্টেশনারি বদলে যে বিপুল অর্থ ব্যয় হবে, তার বাস্তব সুফল কী?
সব মিলিয়ে প্রশ্ন একটাই— মনরেগার নাম বদল কি শুধুই প্রশাসনিক সংস্কার, না কি তার আড়ালে লুকিয়ে আছে ইতিহাস মুছে দেওয়ার ও দায়িত্ব ঝেড়ে ফেলার রাজনীতি? গ্রামীণ ভারতের কর্মসংস্থান সুরক্ষার প্রশ্নে এই সিদ্ধান্ত যে আরও বিস্তৃত ও স্বচ্ছ আলোচনার দাবি রাখে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।