সৈয়দ হাসমত জালাল
একজন তরুণ রাজনৈতিক নেতার মৃত্যু কীভাবে একটি দেশের সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়কে আগুনের মুখে ঠেলে দিতে পারে— বাংলাদেশ আজ সেই কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে।
শরীফ ওসমান বিন হাদির হত্যাকাণ্ড নিছক আর একটি রাজনৈতিক খুন নয়। এটি ঘটেছে এমন এক সময়ে, যখন ২০২৪ সালের রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর বাংলাদেশ এখনও তার নতুন ভারসাম্য খুঁজে পায়নি। দীর্ঘ শাসনের অবসান যেমন আওয়ামী লীগ-বিরোধীদের মধ্যে প্রত্যাশা তৈরি করেছিল, তেমনই অন্যদিকে একধরনের অনিশ্চয়তাও বেড়েছে। সেই শূন্যতা ও দোলাচলের মধ্যেই নতুন প্রজন্মের কিছু মুখ উঠে এসেছে, যাঁরা বিশ্বাস করেন— দলীয় রাজনীতির বাইরে গিয়েও রাজনীতির ভাষা ও নৈতিকতা বদলানো সম্ভব।
হাদি ছিলেন সেই প্রজন্মের প্রতিনিধি। ‘ইনকিলাব মঞ্চ’ কোনও প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল নয়। তবু অল্প সময়ের মধ্যেই এটি ক্ষমতার অলিন্দে ও আলোচনায় ঢুকে পড়েছে। কারণ হাদির বক্তব্য একাধিক দিক থেকে বর্তমান অন্তর্বর্তী শাসকের কাছেও অস্বস্তিকর হয়ে উঠেছিল। তিনি ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের তীব্র সমালোচনা করেছেন, অন্তর্বর্তী ব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা ও জবাবদিহির অভাব নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন এবং একই সঙ্গে ভারত–বাংলাদেশ সম্পর্কের অসমতা নিয়ে প্রকাশ্যে কথা বলেছেন। এই তিনটি অবস্থান তাঁকে দ্রুত জনপ্রিয় করেছিল ঠিকই, কিন্তু একই সঙ্গে আবার তাঁকে কিছুটা বিপদের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন মুখ মানেই শুধু সম্ভাবনা নয়— প্রায়শই তা পুরনো ক্ষমতার জন্য সরাসরি চ্যালেঞ্জও।
হাদিকে প্রকাশ্য রাস্তায় গুলি করে হত্যা করা হয়। হামলার ধরন দেখে স্পষ্ট, এটি ছিল পরিকল্পিত ও পেশাদারি মস্তিষ্কপ্রসূত ঘটনা। এই ধরনের হত্যাকাণ্ডে তাই প্রশ্নটা কেবল ‘কে গুলি করল’— শুধু এই প্রশ্নের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না। আরও গভীর প্রশ্ন উঠে আসে— ‘কে লাভবান হল?’ পুরনো শাসকগোষ্ঠীর অবশিষ্ট শক্তি? অন্তর্বর্তী ব্যবস্থার ভিতরের দ্বন্দ্ব? নাকি এমন শক্তি, যারা চায় রাজনীতির ভাষা আবার ধর্মীয় ও হিংসার মেরুকরণের পথে ফিরে যাক? তদন্ত চলছে, কিন্তু এই অঞ্চলের রাজনৈতিক ইতিহাস বলে— হত্যার চেয়েও তার পরবর্তী প্রতিক্রিয়াই অনেক সময় বেশি প্রভাব ফেলে দেশের রাজনীতি, শাসনপ্রক্রিয়া ও জনমানসেও।
হাদির মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়তেই রাজপথ উত্তাল হয়। বিক্ষোভ, ভাঙচুর, আগুন— এসব যে ঘটতে পারে, তা কি অনুমান করা খুব কঠিন ছিল? তা নিশ্চয়ই ছিল না। কিন্তু সেই ক্ষোভ খুব দ্রুত দিশাহীন হয়ে পড়ে। সংবাদমাধ্যম, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠে আক্রমণের লক্ষ্য। এর মধ্যে সবচেয়ে গভীর এবং প্রতীকী আঘাতটি আসে ‘ছায়ানট’ সংস্থার উপর।
একজন রাজনৈতিক নেতার হত্যার প্রতিক্রিয়া কেন এসে পড়ে একটি সংগীত ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানে— এই প্রশ্নেই বাংলাদেশের বর্তমান সংকটটি সবচেয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ‘ছায়ানট’ কোনও সাধারণ সাংস্কৃতিক সংগঠন নয়। এর জন্মই হয়েছিল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দমননীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ হিসেবে। ১৯৬১ সালে, তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে, যখন পাকিস্তানি রাষ্ট্রযন্ত্র রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গান ও চর্চাকে ‘হিন্দুয়ানি’ ও ‘অ-ইসলামিক’ বলে নিষিদ্ধ করার চেষ্টা চালাচ্ছিল, তখনই বেশ কয়েকজন সংগীতশিল্পী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব— যেমন সনজীদা খাতুন, ওয়াহিদুল হক, কামাল লোহানী ও আরও অনেকে ‘ছায়ানট’ নামে এই সাংস্কৃতিক সংস্থার প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁদের লক্ষ্য ছিল খুব স্পষ্ট— বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির ধারাবাহিকতাকে রক্ষা করা এবং ধর্মীয় পরিচয়ের নামে সাংস্কৃতিক দমনের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো।
‘ছায়ানট’ শুরু থেকেই সংগীত শিক্ষার উপর জোর দিয়েছিল। রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, দেশাত্মবোধক গান, লোকসংগীত ও শাস্ত্রীয় সংগীত— সব মিলিয়ে এটি এক ধরনের সাংস্কৃতিক পাঠশালা হয়ে ওঠে। কিন্তু ‘ছায়ানট’-এর কাজ কেবল সংগীত শেখানোতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এটি ছিল একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন। পাকিস্তান আমলে রাষ্ট্র যখন বাঙালি পরিচয়কে সংকুচিত করে দিতে চাইছিল, ‘ছায়ানট’ তখন গান ও অনুষ্ঠানের মাধ্যমে নাগরিক প্রতিরোধের ভাষা তৈরি করেছিল।
এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ রমনা বটমূলে পয়লা বৈশাখ উদ্যাপন। ছায়ানটের উদ্যোগেই এই অনুষ্ঠান ধীরে ধীরে একটি সর্বজনীন সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত হয়, যেখানে ধর্মের ঊর্ধ্বে উঠে বাঙালি পরিচয় উদ্যাপিত হয়। সামরিক শাসন, নিষেধাজ্ঞা ও নানা ধরনের চাপ সত্ত্বেও এই অনুষ্ঠান চলেছে। মুক্তিযুদ্ধের পরও ‘ছায়ানট’ তার এই ভূমিকা বজায় রাখে। ফলে ‘ছায়ানট’ কেবল একটি প্রতিষ্ঠান নয়, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের একটি ঐতিহাসিক ও জীবন্ত স্মৃতি।
এই ইতিহাসই ব্যাখ্যা করে কেন রাজনীতি যখন নিজের যুক্তি হারায়, তখন সে ‘ছায়ানট’-এর মতো প্রতীকের উপর আঘাত হানে। সংস্কৃতি তখন সহজ লক্ষ্য হয়ে ওঠে। কারণ তাকে ‘এলিট’, ‘অ-ইসলামিক’, কিংবা ‘বিদেশি প্রভাবিত’ বলে চিহ্নিত করা যায়। এই যুক্তির ভিতরেই জন্ম নেয় বিপজ্জনক সরলীকরণ— ‘ছায়ানট’ মানে রবীন্দ্রনাথ, রবীন্দ্রনাথ মানে ভারত, অতএব ‘ছায়ানট’ মানে বহিঃশত্রু। এই সরলীকরণই হিংসাকে নৈতিকতার মোড়ক দেয়।
এই প্রেক্ষাপটে ভারত আবার সামনে আসে, কিন্তু তা একটি বাস্তব প্রতিবেশী রাষ্ট্র হিসেবে নয়, বরং একটি রাজনৈতিক প্রতীক হিসেবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত কখনও বন্ধু, কখনও আধিপত্যবাদী শক্তি, আবার সংকটের সময় অদৃশ্য শত্রু। ২০২৪ সালে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সে সম্পর্কে ভারতের নীরবতা এবং শেখ হাসিনাকে ভারতে আশ্রয় দেওয়ার কারণে বাংলাদেশের জনমানসে ভারত-বিরোধী মনোভাবকে আরও ছড়িয়ে দেওয়া সহজ হয়েছে।
হাদির মৃত্যুর পর তাই তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই শোনা যায় ভারত-বিরোধী স্লোগান, হামলাকারীদের ভারতে পালিয়ে যাওয়ার কাল্পনিক অভিযোগ। এখানে যুক্তির চেয়ে আবেগই বেশি কাজ করছে। কারণ ভারতকে দোষী অভিযুক্ত করলে অভ্যন্তরীণ ব্যর্থতা আড়াল করা যায়, ক্ষোভের একটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য তৈরি হয় এবং বিভক্ত জনতাকে একত্র করা সহজ হয়। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে এই কৌশল বহুবার দেখা গিয়েছে।
সবচেয়ে বিপজ্জনক বিষয়টি হল— এই প্রক্রিয়ায় ভারত-বিরোধিতা আর নীতিগত সমালোচনার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না। তা ধীরে ধীরে পরিচয় রাজনীতিতে বা আইডেন্টিটি পলিটিক্সে পরিণত হয়। আর সেই পরিচয় রাজনীতির প্রথম শিকার হয় সংস্কৃতি, সংখ্যালঘু গোষ্ঠী এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। ‘ছায়ানট’-এ আগুন লাগানো মানে তাই কেবল একটি ভবন পোড়ানো নয়— এটি একটি ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক স্মৃতি ও ঐতিহ্যকে অপরাধী বানানোর চেষ্টা।
ওসমান বিন হাদির হত্যার বিচার আদৌ হবে কি না, তা নির্ভর করবে বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সদিচ্ছার উপর। কিন্তু তার চেয়েও বড় প্রশ্নটি হল— বাংলাদেশ কি রাজনীতি, সংস্কৃতি ও প্রতিবেশী সম্পর্ক— এই তিনটিকে আলাদা করে দেখার সৎসাহস রাখে? যদি রাজনৈতিক হত্যার প্রতিক্রিয়া হয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উপর হামলা, যদি বিচারহীনতার ক্ষোভ এসে পড়ে সংগীতপ্রতিষ্ঠানে, যদি প্রতিবেশী রাষ্ট্র হয়ে ওঠে অভ্যন্তরীণ ব্যর্থতার প্রতীক— তবে এই আগুন থামবে না।
‘ছায়ানট’-এর মতো সংস্থা পুড়লে শুধু একটি ভবন নয়, পুড়ে যায় একটি জাতির আত্মবিশ্বাস। আর সেই ক্ষতির হিসাব কোনও সরকার, কোনও রাজনৈতিক আন্দোলন, কেউই সহজে দিতে পারে না।