এখন ডিসেম্বর। ভরা শীতকাল। কিন্তু সবজির দাম আকাশছোঁয়া। সাধারণের আয়ত্তের মধ্যে তা নেই। আপনারা কি শুনেছেন বেগুনের মূল্য কেজি প্রতি ১০০ টাকা? দু’দিন আগেও এই দর ছিল। এখন সামান কমে ৮০ টাকায়। শুধু বেগুন কেন, অনেক সবজির মূল্যও— যেমন ফুলকপি, বাঁধাকপি, পেঁয়াজকলি সব সবজির মূল্যই অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তবুও রাজ্য পেঁয়াজ ও আলুর দাম মোটামুটি কম আছে। কিন্তু নতুন আলুর মূল্য অনেক বেশি। একটি ছোট লাউয়ের মূল্য ১৫ থেকে ২০ টাকা। বড় ৩০ থেকে ৪০ টাকা। সবজির এই অস্বাভাবিক মূল্যের টাকাটা চাষিরা অর্থাৎ সবজি উৎপাদনকারীরা যদি পেত, তাহলে বলা যেত তাঁদের ঘরে কিছু টাকা আসছে। কিন্তু তারা পরিশ্রম করে খেতে যে সবজি ফলায়, তার ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত। তাহলে কারা এই টাকা তুলে নিয়ে পকেট ভর্তি করে? তারা ফড়েরা— মানে মিডলম্যানরা। তারাই চাষিদের ঠকিয়ে, সবজির ন্যায্য মূল্য থেকে বঞ্চিত করে একরকম জোড় করেই সবজি অধিকতর কম মূল্যে কিনে নেয়। এই ফড়েদের কৃষকদের ঠকানো আজ নতুন নয়— বহুদিন হল তারা এইভাবে চাষিদের উৎপাদিত ফসলের প্রকৃত মূল্য থেকে বঞ্চিত করছে। প্রশাসন তা ভালো করেই জানে, কিন্তু কোনও ব্যবস্থা নেওয়া থেকে দূরে। ফড়েরা আবার সবজি নিয়ে বাজারে এসে সবজি বিক্রেতাদের কাছ থেকে আরও বেশি মূল্যে তা ছেড়ে দেয়। বিক্রেতারা আবার তার ওপর মূল্য বাড়িয়ে বিক্রি করে। সেই বেশি মূল্যের বোঝাটা এসে পড়ে সাধারণ মানুষের ওপর— আপনারা যাঁরা বাজারে যান সবজি সহ অন্যান্য দ্রব্য কিনতে। সবজির এই মূল্য শুনে তাদের মাথায় হাত— কিছু করারও নেই। খেতে হলে চড়া মূল্যেই সবজি কিনতে হবে। নইলে তো গৃহিণীর রোষ বাড়বে। হেঁসেলে হাহাকার পড়বে। তাই তারা অসহায়।
বছর কয়েক আগে শহর ও শহরতলির বাজারে সবজির মূল্য অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পেলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই বৃষ্টির মধ্যে জলকাদা ভেঙে শহরের দু-তিনটে বাজারে ঢুকেছিলেন সবজির মূল্য সরজমিনে যাচাই করতে এবং বিক্রেতাদের কথা শুনতে। তিনি একটি দোকানে বেগুনের মূল্য জানতে চাইলে, দোকানি বলল ৮০ টাকা কেজি। মুখ্যমন্ত্রী শুনে অবাক হয়েছিলেন। বিক্রেতাদের নির্দেশ দিয়েছিলেন ৬০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে। তখন কিছু সময় বিক্রেতারা মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ মতোই ৬০ টাকা কেজি মূল্য দরে বেগুন বিক্রি করেছিলেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী বাজার ছেড়ে চলে গেলে বিক্রেতারা আবার আগের মূল্যেই বেগুন বিক্রি শুরু করে দেন। অর্থাৎ মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশকে তাঁরা আমল দিলেন না। তবে মুখ্যমন্ত্রীর বাজার পরিক্রমায় লাভ হয়েছিল এই যে সবজি ব্যবসায়ীরা একটু ভীত সন্ত্রস্ত হয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী এ ব্যাপারে আরও কঠোর পদক্ষেপ নিতে পারেন এই ভয়ে।
এই যে শীতের সবজির দাম এত বেশি, অর্থাৎ সাধারণ মানুষের তা কেনার নাগালের বাইরে— তা সত্ত্বেও সরকারের গঠিত টাস্ক ফোর্সের এখনও দেখা নেই। টাস্ক ফোর্সের সদস্যরা বাজারে নামলেও, সবজির মূল্যের কোনও হেরফের হয় না। তারা বিভিন্ন দ্রব্যের মূল্য নোট করে নবান্নে গিয়ে আলোচনায় বসে। কিন্তু টাস্ক ফোর্সের সদস্যরা অধিকতর কম মূল্যে সবজি বিক্রির নিদান দিলেও, বিক্রেতারা হেলায় তা উড়িয়ে দেয় এবং বেশি মূল্যেই সবজি বিক্রি করতে থাকে। সুতরাং টাস্ক ফোর্সের ভূমিকা নিয়ে সন্তুষ্ট নন সাধারণ মানুষ। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী একটি সৎ উদ্দেশ্য নিয়েই এই টাস্ক ফোর্স গঠন করেছিলেন, যাতে এই ফোর্সের সদস্যদের নির্দেশ মতো সব পণ্যের মূল্য কমিয়ে আনে এবং সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়। কিন্তু টাস্ক ফোর্স সেভাবে কাজ করতে পারল না। সেই মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুর আমলে কাঁচালঙ্কার মূল্য বেড়ে ১০০ টাকা প্রতি কেজি হয়েছিল। এখনও সেই মূল্যই আছে।
কেন এই শীতে শাতকালীন সবজির মূল্য এত বেশি? তার একটি উত্তর পাওয়া গেল চাষিদের মুখ থেকে। তারা বলল, এবার বর্ষায় প্রবল বৃষ্টির ফলে মাঠে বোনা সব সবজি নষ্ট হয়ে যায়। বৃষ্টির প্রাবল্য ফসলে আবার নতুন করে সবজির চাষ করতে হয়। ফলে তাদের খরচ যেমন বেশি হয়েছে, তেমনই এবার শীতের বাজারে সবজি আনতেও বিলম্ব ঘটেছে। অন্যান্য বার তাদের এই সমস্যার সম্মুখীন হতে হয় না। কিন্তু সময়মতো সবজি খেতে উৎপাদন করলেও তার জন্য ন্যায্য মূল্য থেকে তারা বঞ্চিত। ফড়েরা একরকম জোর করেই কম দামে সবজি কিনে নেয়।