আর্থিক বৃদ্ধির মিথ্যা দাবি

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

ডলারের তুলনায় টাকার দাম রেকর্ড হারে পড়ে গেল শুক্রবার অর্থাৎ ২৮ নভেম্বর। তবে দেশের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর কোনও হেলদোল নেই। দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উৎপাদন (জিডিপি) বৃদ্ধির হার দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে সামান্য বাড়তেই তা নিয়ে সোচ্চারে প্রচার করতে লেগে পড়েছে বিজেপি।

অর্থবর্ষের দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) দেশের জিডিপি বৃদ্ধির হার ৮.২ শতাংশ। গত ছয় ত্রৈমাসিকে তা সর্বাধিক বৃদ্ধি বলে কেন্দ্র জানিয়েছে। এর আগের ত্রৈমাসিকে (এপ্রিল-জুন) জিডিপি বৃদ্ধির হার ছিল ৭.৮ শতাংশ। ফলে এক ত্রৈমাসিকের ব্যবধানে এই বৃদ্ধির হার হলো ০.৪ শতাংশ। গত বছর দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে এই জিডিপি বৃদ্ধির হার ছিল ৫.৬ শতাংশ। এদিকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে সেভাবে অগ্রগতি না থাকলেও উৎপাদন শিল্পে বৃদ্ধির হার ৯ শতাংশে পৌঁছনোয় জিডিপি-র মোট বৃদ্ধি হার বেড়েছে।

প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এটাকেই অর্থনীতির বিপুল সাফল্য বলে দাবি করেছেন। শ্রম আইন তুলে দিয়ে শ্রমকোড চালু করার মতো আর্থিক সংস্কার এই জিডিপি-র হার বৃদ্ধির পথ খুলে দিয়েছে বলে বোঝাতে চেয়েছেন নরেন্দ্র মোদী। এক বিবৃতিতে তিনি বলেছেন, ‘২০২৫-২৬ দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে জিডিপি বৃদ্ধির হার ৮.২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা খুবই উৎসাহজনক। আমাদের সরকারের আর্থিক সংস্কার নীতির সাফল্য এটাই।’ শ্রম কোডের মতো সংস্কারের পথ ধরেই যে জিডিপি-র হার বেড়েছে, এটাই মোদী বোঝাতে চেয়েছেন ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অন্য পথে।


গতানুগতিকভাবে মোদী বলেছেন, ‘আমাদের সরকার এই আর্থিক সংস্কারের পথে আরও এগিয়ে যাবে। মানুষের জীবনযাত্রায় উন্নতি ঘটাতে সচেষ্ট থাকবে।’ মোদীর সঙ্গে সুর মিলিয়ে অর্থমন্ত্রী নির্মল সীতারামনও বলেছেন, দ্বিতীয় ত্রৈমাসিকে জিডিপি বৃদ্ধির হার প্রমাণ করে, দেশের অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন ঘটেছে। অর্থনীতির বৃদ্ধি গতি পেয়েছে।

মাত্র এক ত্রৈমাসিকে দেশে জিডিপি বৃদ্ধির হারে সামান্য অগ্রগতি নিয়ে মোদীর এভাবে প্রচারে নেমে পড়ায় প্রশ্ন উঠেছে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মহলে। জিডিপি নিয়ে গালভরা ভাষণ চললেও, বর্তমানে দেশে টাকার দাম তলানিতে চলে যাওয়া নিয়ে মোদী যে মুখে কুলুপ এঁটে রয়েছেন, তা নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন। তাঁরা জানান, মোদী সরকার যখন ক্ষমতায় আসে, সেই ২০১৪ সালে প্রতি মার্কিন ডলারের মূল্য ভারতীয় মুদ্রায় ছিল ৬৩.৯৯ টাকা। এদিকে টাকার দাম তলানিতে চলে যাওয়ায় সেই ডলারের দাম ভারতীয় মুদ্রায় হয়েছে ৮৯ টাকা। ভারতীয় মুদ্রায় ডলারের দাম ২০১৪ সালের তুলনায় মোদীর সময়ে ২৬ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে। যেভাবে টাকার দামে পতন হচ্ছে অবিলম্বে ডলারের দাম ভারতীয় মুদ্রায় সেঞ্চুরি করবে বলে মনে করেছন বিশেষজ্ঞরা।

এদিকে টাকার দাম পড়ে যাওয়ায় আমদানির খরচ উৎপাদনের খরচ বৃদ্ধির আশঙ্কা রয়েছে। তাতে ভারতের অর্থনীতির গতিহারা হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে। বিরোধীরা জানাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের আমলে টাকার দাম এভাবে পড়ে যাওয়ায় সমালোচনায় মুখর ছিলেন গুজরাতের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। মনমোহন সিং টাকার মূল্য পতন নিয়ে ‘মৌনী বাবা’ হয়ে রয়েছেন বলে তাঁকে কটাক্ষ করেছিলেন নরেন্দ্র মোদী। ইতিহাসের কী বিরল দৃষ্টান্ত। এখন নরেন্দ্র মোদীই ‘মৌনীবাবা’ হয়ে রয়েছেন। এখন ডলার পিছু টাকার দামে বিপুল পতনে মোদীর অর্থনীতি কেন দায়ী হবে না, এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

দেশের আর্থিক বৃদ্ধি নিয়ে কেন্দ্রর দাবির আগেই সামনে এসেছে আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডারের (আইএমএফ) বার্ষিক পর্যালোচনা রিপোর্ট। সেখানে দাবি, ভারতের জাতীয় অ্যাকাউন্টের পরিসংখ্যানের মূল্যায়ন ‘C’। একদম শেষের সারির এক ধাপ আগে। কারণ, হিসাবের জন্য দেওয়া তথ্যে খামতি আছে। এর মধ্যেই পড়ে জিডিপি। ফলে অর্থনীতির আসল ছবি ফুটে ওঠে না। মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রেও তথ্য সেকেলে, অবাস্তব। তার মূল্যায়ন ‘B’। বাজারে পণ্যের আকাশছোঁয়া দামে বিপাকে মানুষ। অথচ কেন্দ্রের খাতায় কমছে মূল্যবৃদ্ধি। আইএমএফের রিপোর্টে দেশ-বিদেশের মঞ্চে মোদী সরকারের মুখ পুড়ল। এই রিপোর্টের বিরূপ পড়তে পারে ভারতে বিদেশি লগ্নির ক্ষেত্রে।