ধৃতি বন্দ্যোপাধ্যায়
সেদিন, নিউজ চ্যানেল স্ক্রল করতে করতে হঠাৎ একটা খবরে চোখ আটকে ছিল । উত্তরাখণ্ডের প্রেমনগরের ঠাকুরপুরে রাতের দিকে নদীর ধারে শৌচকর্ম করতে গিয়েছিল স্থানীয় এক যুবক। হঠাৎই হরপা বান এসে যাওয়ার বাড়ি ফিরতে না পেরে নিকটবর্তী বৈদ্যুতিক খুঁটি আঁকড়ে ধরে সে, তারপর সারারাত সেই বৈদ্যুতিক খুঁটিতেই ঝুলে থাকতে হয় তাকে। সকালের দিকে বিপর্যয় মোকাবিলা দপ্তরের কর্মীরা খবর পেয়ে উদ্ধার করেন এই যুবককে।
সেই রাতেই কলকাতায় ৩০০ মিলি মিটার বৃষ্টি মাত্র কয়েক ঘন্টায়, ফলাফল— পরের দিন সকালে জমা জলে বিদ্যুৎপৃষ্ট হয়ে রাস্তায় ভাসতে থাকলো লাশ।
সত্যি, সেই সুপ্রাচীন কাল থেকে পৃথিবী সর্বদাই বিবর্তিত হয়েছে, কিন্তু এর আগে কখনও মানবজাতি তার ভবিষ্যৎ পরিচালনার ক্ষেত্রে এত গভীরভাবে সমস্যায় জড়িয়ে পড়েনি। বর্তমানে জলবায়ু পরিবর্তন এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যেখানে ক্ষুদ্রতম পরিবর্তনও বিশাল পরিণতি বয়ে আনছে, এবং এমন এক পরিবর্তনের সূচনা করছে যা বদল করা যায় না। এই গুরুত্বপূর্ণ সীমাগুলিকে জলবায়ু পরিবর্তনের বিন্দু বা টিপিং পয়েন্ট বলা হয় এবং এগুলি অতিক্রম করলে গ্রহটি এমনভাবে রূপান্তরিত হতে পারে যা বাস্তুতন্ত্র, অর্থনীতি এবং এমনকি সভ্যতাকেও নতুন করে রূপ দিতে পারে।
আজ হয়তো আমাদের চোখের উপর উপর সবকিছুই ঠিক আছে, কিন্তু আগামীকাল, ভারসাম্য ভেঙে গেলে! আমাদের পরিচিত পৃথিবী যদি অজ্ঞাতসারে পরিবর্তিত হয় তবে কী হবে?
তাই জেনে নেওয়া ভালো, টিপিং পয়েন্ট কী? সহজ ভাষায়, টিপিং পয়েন্ট হল এমন একটি থ্রেশহোল্ড যেখানে ধীরগতির পরিবর্তন হঠাৎ করেই এক নাটকীয় পরিবর্তনের সূত্রপাত করে। ব্যাপারটা এমনই, যেন একটি চেয়ারকে সামান্য ঠেলা দিতেই তা ভেঙে পড়ল, কিন্তু এমন জায়গায়, যে তাকে আবার না তুলে ফিরে যাওয়ার কোনও উপায়ও আমাদের সামনে নেই। জলবায়ু টিপিং পয়েন্ট এইভাবেই কাজ করে। একবার একটি গুরুত্বপূর্ণ থ্রেশহোল্ড অতিক্রম করলে, প্রাকৃতিক ব্যবস্থাগুলি তাদের আসল অবস্থায় ফিরে নাও আসতে পারে,তা আমরা যতই প্রচেষ্টা করি না কেন। আর এগুলি কিন্তু কোনো কল্প বিজ্ঞানের কাহিনী দৃশ্য নয়।
জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃসরকারি প্যানেল (IPCC)-এর বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে মানব-সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বেশ কয়েকটি টিপিং পয়েন্ট ইতিমধ্যেই চাপের মধ্যে রয়েছে, আমরা সেগুলো নিয়েই এখন আলোচনা করবো।
প্রথমেই আসবে দ্রুত হারে বরফের গলে যাওয়ার প্রসঙ্গ। বর্তমানে সমুদ্রের উত্থান আমরা থামাতে পারছি না। যার সবচেয়ে নাটকীয় উদাহরণ দেখা যায় সম্ভবত গ্রিনল্যান্ড এবং অ্যান্টার্কটিকায়। উভয় দেশেই যথেষ্ট পরিমাণে হিমায়িত জল রয়েছে যা সম্পূর্ণরূপে গলে গেলে বিশ্বব্যাপী সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা ৬০ মিটারেরও বেশি বৃদ্ধি পাবে। যদিও পূর্ণ মাত্রায় গলে যেতে কয়েক শতাব্দী সময় লাগবে, কিন্তু এটি নির্দিষ্ট সীমা অতিক্রম করলে বিশ্বে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা অপ্রতিরোধ্য বৃদ্ধির দিকে পরিচালিত হতে পারে, এমনকি কয়েক মিটার উঁচু হয়ে উপকূলীয় শহরগুলিকে ডুবিয়ে দেবে, লক্ষ লক্ষ লোককে বাস্তুচ্যুত করবে। ফলে বিশ্বব্যাপী মানচিত্র পুনরায় অঙ্কনের প্রয়োজন হবে।
গ্রিনল্যান্ডের বরফের স্তরে ইতিমধ্যেই অস্থিতিশীলতার লক্ষণ দেখাচ্ছে। যদি উষ্ণতা শিল্প বিপ্লব -পূর্ব স্তরের প্রায় ১.৫ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায়, তাহলে বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন যে বৃহৎ আকারে বরফ গলে যাওয়া থামানো যাবে না। পশ্চিম অ্যান্টার্কটিক বরফের স্তরও একই রকম ঝুঁকির সম্মুখীন, বিশেষ করে হিমবাহগুলিকে ধরে রাখার জন্য ব্যবহৃত বরফের তাক দুর্বল হয়ে পড়ার কারণে। এই তাক একবার চলে গেলে, ধস ত্বরান্বিত হয় এবং পশ্চাদপসরণ অপরিবর্তনীয় হয়ে ওঠে।
এরপর আসে আমাজন রেইনফরেস্টের চারিত্রিক পরিবর্তনের কথা। যা একদা ছিল কার্বন সিঙ্ক, আজ পরিবর্তিত হয়ে তা-ও হয়েছে কার্বন উৎপাদক।
আমাজনকে প্রায়শই ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ বলা হয়, যা একদা কোটি কোটি টন কার্বন ডাই অক্সাইড শোষণ করেছে। কিন্তু ক্রমাগত বন উজাড় এবং ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা এই গুরুত্বপূর্ণ বাস্তুতন্ত্রকে উল্টে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে। কার্বন সংরক্ষণের পরিবর্তে, আমাজন ও বর্তমানে কার্বণ উৎপাদন করছে, ফলস্বরূপ বিশ্ব উষ্ণায়ন ত্বরান্বিত হচ্ছে । গবেষণায় দেখা গেছে যে, যদি আর-ও ২০ থেকে ২৫ শতাংশ বন হারিয়ে যায়, তাহলে ফরেস্ট সিস্টেমটি সাভানার মতো অবস্থায় ভেঙে পড়বে। ইতিমধ্যেই বনভূমিতে অগ্নিসংযোগ এবং কাঠ কাটার কারণে আমাজনের কিছু অংশে কার্বন শোষণের থেকে নির্গমণ বেশি হচ্ছে। জলবায়ুর পরিবর্তনের বাইরে, এই পরিবর্তন জীববৈচিত্র্যকেও ধ্বংস করবে, আদিবাসীদের জীবিকা পরিবর্তন করবে এবং দক্ষিণ আমেরিকা জুড়ে বৃষ্টিপাতের ধরণকে অস্থিতিশীল করবে।
এরপরেই আসে পারমাফ্রস্ট গলনের কথা। প্রাচীন কার্বনের উন্মোচন পারমাফ্রস্ট আছে আর্কটিক মাটির নীচে, যা সহস্রাব্দ ধরে হিমায়িত অবস্থায় রয়েছে। এবং এটি আজকের বায়ুমণ্ডলের কার্বনের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ কার্বন সঞ্চয় করে রেখেছে। কিন্তু আর্কটিক অঞ্চল, বিশ্ব গড় হারের দ্বিগুণ হারে উষ্ণ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এখানের হিমায়িত পারমাফ্রস্ট গলে যাচ্ছে। এই গলনের ফলে প্রচুর পরিমাণে মিথেন নির্গত হতে পারে, যা কার্বন ডাই অক্সাইডের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী গ্রিনহাউস গ্যাস। বিজ্ঞানীরা আশঙ্কা করছেন যে একবার মুক্তি পেলে, এই প্রক্রিয়াটি একটি প্রতিক্রিয়া লুপ তৈরি করবে। উষ্ণায়নের ফলে গলন হয়, গলন থেকে নির্গমন হয় এবং নির্গমনের ফলে আরও উষ্ণতা বৃদ্ধি পায়। এটি একটি ধীরগতির কর্মকান্ড নয়, যা আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, বরং এটি এতটাই দ্রুত গতিতে হবে, যে প্রভাবের পরিণাম ভয়ংকর হতে পারে।
এছাড়াও আছে সমুদ্র সঞ্চালন। গ্রহের স্পন্দন আটলান্টিক মেরিডিয়োনাল ওভারটার্নিং সার্কুলেশন (AMOC), যার মধ্যে উপসাগরীয় প্রবাহ অন্তর্ভুক্ত। এটি গ্রহের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সমুদ্র স্রোতগুলির মধ্যে একটি। এই স্রোত তাপ বিতরণ নিয়ন্ত্রণ করে, মহাদেশগুলিতে আবহাওয়ার ধরনকে নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে যে, এটি ইতিমধ্যেই দুর্বল হয়ে পড়ছে, আংশিকভাবে বরফ গলে যাওয়ার কারণে।
AMOC ভেঙে পড়লে জলবায়ুতে নাটকীয় বিপর্যয় দেখা দেবে। ইউরোপে শীতকাল আরও তীব্র হবে, আফ্রিকা ও এশিয়ায় বর্ষার পরিবর্তন হবে এবং মার্কিন পূর্ব উপকূল বরাবর সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে। খাদ্য ব্যবস্থা, অর্থনীতি সহ বিপর্যয়ে মানব সম্প্রদায় ধাক্কা খাবে। এটি খুব বেশি দূরের কল্পনা নয়। বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে দিয়েছেন যে, এই ভাঙন প্রত্যাশার চেয়ে দ্রুত ঘটছে।
আছে প্রবাল প্রাচীর প্রসঙ্গ। সমুদ্রের স্বাস্থ্যের জন্য একটি জানালা এই প্রবাল প্রাচীরগুলি। প্রবাল প্রাচীর হল জীববৈচিত্র্যের শক্তিঘর, যেখানে এক-চতুর্থাংশ সামুদ্রিক প্রজাতির আবাসস্থল। তাই, জলবায়ু পরিবর্তনের মুখোমুখি হওয়া প্রথম বাস্তুতন্ত্রগুলির মধ্যে এগুলি অন্যতম। সমুদ্রের তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে ব্যাপকভাবে প্রবাল ব্লিচিং হচ্ছে। ফলে প্রবালগুলি বেঁচে থাকার জন্য যে শৈবালের উপর নির্ভর করে তা বের করে দিচ্ছে এই ব্লিচিং । পদক্ষেপ না নিলে, ৯০ শতাংশ প্রবাল প্রাচীর শতাব্দীর মাঝামাঝি নাগাদ অদৃশ্য হয়ে যাবে, যার পরিণতি, মৎস্য, উপকূলীয় সুরক্ষা এবং পর্যটনের উপর মারাত্মক ঋণ্যাত্মক প্রভাব। প্রবাল প্রাচীর হারানো কেবল সমুদ্রের সৌন্দর্য নষ্ট মাত্র নয়, এটি সমগ্র সামুদ্রিক খাদ্যজাল এবং লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবিকাকে ব্যাহত করবে।
এই টিপিং পয়েন্টগুলি কেন গুরুত্বপূর্ণ এবং আলোচনার আলোয়? কারণ ব্যক্তিগতভাবে, প্রতিটি টিপিং পয়েন্ট উদ্বেগজনক অবস্থায়। আর একসাথে, তারা আন্তঃসংযুক্ত ঝুঁকির একটি জাল তৈরি করে ফেলছে। একটি বরফের চাদর সমুদ্রকে উত্থাপন করতে পারে যা প্রবাল প্রাচীরকে প্রভাবিত করে; মরে যাওয়া বন উষ্ণতা বৃদ্ধি করতে পারে যা পারমাফ্রস্ট গলনের গতি বাড়ায়। এই সিস্টেমগুলি বিচ্ছিন্নভাবে বিদ্যমান নয়, তারা একটি গ্রহীয় ডমিনো প্রভাব তৈরি করে ফেলেছে। একাধিক টিপিং পয়েন্ট অতিক্রম করা মানে বর্তমান পৃথিবীকে, বিজ্ঞানীরা যাকে ‘গ্রিনহাউস পৃথিবী’ বলে অভিহিত করেন তার দিকে ঠেলে দেওয়া, যেখানে প্রতিক্রিয়া লুপগুলি মানুষের কর্মকাণ্ড নির্বিশেষে অপ্রতিরোধ্য উষ্ণতা বৃদ্ধি করে চলবে।
আমরা কি এখনও চোখ বুজে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শুধু তাল মিলিয়ে চলতে পারি? ভয়াবহ সত্য হলো, আমরা বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তের কাছাকাছি চলে এসেছি ঠিকই, কিন্তু ‘আসলি পিকচার অভি বাকি হ্যায়’। তাই এখন প্রতিটি ভগ্নাংশই গুরুত্বপূর্ণ। দ্রুত নির্গমণ হ্রাস, বন সংরক্ষণ, পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি এবং বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার এখনও সেই সবচেয়ে খারাপ পরিণতি রোধ করতে পারে। প্যারিস চুক্তির, উষ্ণায়ন ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ রাখার লক্ষ্য কেবল প্রতীকি নয়, এটি অপরিবর্তনীয় পরিবর্তনের বিরুদ্ধে একটি বাফার। প্রযুক্তি, নীতি এবং সম্প্রদায়ের সঠিক পদক্ষেপে যার বাস্তবায়ন সম্ভব। তাই সকলকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। অবক্ষয়িত ভূমিতে পুনর্বনায়ন প্রকল্প থেকে শুরু করে উদ্ভাবনী কার্বন ক্যাপচার প্রযুক্তি পর্যন্ত, মানুষের হাতেই রয়েছে হাতিয়ার। তবে পদক্ষেপ অবশ্যই হবে সম্মিলিত, জরুরিভিত্তিক। এবং বিজ্ঞানের উপর ভিত্তি করে হতে হবে তার প্রসার।
তবু একথাও ঠিক যে, জলবায়ু পরিবর্তনের ধারণাটি অপ্রতিরোধ্য, যা সবকিছুই অচল করে দিতে পারে। কিন্তু, সচেতনতা গল্পের তো এখানেই শেষ নয়, বরং এটি একটি পছন্দের শুরু। আজ আমরা ইতিহাসের এমন এক দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে, যেখানে আমাদের বর্তমান সিদ্ধান্তগুলি আগামী শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে গ্রহকে সৃষ্টির রূপ দিতে পারে।
তাই সবশেষে এই প্রশ্নটা থেকেই যায়, আমরা কি আজই যথেষ্ট সাহসের সাথে কাজ শুরু করব যাতে আগামীকাল এই ধ্বংসলীলা, এই দুর্ভোগ রোধ করা যায়? নাকি আমরা আবারও দুয়ারে ভেনিসের অপেক্ষায়?