প্যালেস্তাইনের গাজায় একদিকে ইজরায়েলের সেনারা নির্বিচারে হত্যালীলা চালাচ্ছে, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মদতে পুরো ভূখণ্ড দখল করতে চাইছে। শান্তিকামী বিশ্ববাসীর সব আহ্বানকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে তথাকথিত ‘সন্ত্রাসবাদ’ দমনের নাম করে রাষ্ট্রসঙ্ঘের উদ্যোগে সংঘটিত ত্রাণ বিলির লাইনেও নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করছে নিরপরাধ শিশুদের। সম্প্রতি ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম ‘স্কাই নিউজ’ একটি সাক্ষাৎকার প্রচার করে। ওই সাক্ষাৎকারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ইসরায়েল সেনার আরক্ষা বাহিনীর এক কর্মী তাঁর অভিজ্ঞতার কথা শোনালেন। গাজায় ‘আত্মরক্ষা’-র নামে ঠান্ডা মাথায় গণহত্যার অভিযানের কথা তিনি তুলে ধরেন। এই অভিযানের প্রত্যক্ষ শরিক হিসাবে নানা হাড় হিম করা দৃশ্যের কথা তিনি তুলে ধরেছেন।
গাজায় যে কোনও মানুষকে গুলি করে খুন করার পর ইজরায়েলের সাধারণ সেনা কর্মীরা আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে ওঠেন। নিমেষের মধ্যে কারোর আপনজনের প্রাণ নিয়ে নেওয়া যে ভয়ঙ্কর গর্হিত কাজ, তা তাঁদের মাথাতেই আসে না। প্লাটুন সদস্যদের মধ্যে কে কতদিনে কতজন প্যালেস্তিনীয় মানুষ মারছেন তার প্রতিযোগিতা চলে। স্কাইপাররা বালির ছাদে উঠে গাজার নিরীহ মানুষের উপর ‘টার্গেট’ প্রতিযোগিতা করেন। মাথায় গুলি, ধড়ে গুলি আর হাতে পায়ে গুলি করার আলাদা পায়েন্ট থাকে। তাঁদের সহকর্মীরা আবার তাই নিয়ে বাজিও ধরেন। এভাবেই ইজরায়েলের সেনাদের অভ্যন্তরে গণহত্যাকে খেলার পর্যায়ে নামিয়ে আনা হয়েছে।
গাজায় কার্যত ‘শুট অ্যাট সাইট’-এর নির্দেশ রয়েছে। সামনে যে কোনও মানুষের উপর নির্বিচারে গুলি চালাতে কোনও বাধা নেই। অনেক সময় কোনও প্লাটুন কমান্ডারের মেজাজ খারাপ থাকলে তিনি জনা পাঁচেক মানুষ মেরে মাথা ঠান্ডা করেন। এই সমস্ত অপকমের্র জন্য কাউকে কোনও প্রশ্ন করা হয় না। শাস্তি দূরের কথা, সামান্য জবাবদিহিও করতে হয় না। অনেক সময় গাজার রাস্তাঘাটে কোনও প্যালেস্তিনীয় মানুষকে খুন করে উপরতলার অফিসারদের জানানো পর্যন্ত হয় না। ইজরায়েলি সেনাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে যে, নারী, পুরুষ, শিশু বৃদ্ধ নির্বিশেষে গাজার প্রতিটি মানুষই সন্ত্রাসবাদী। তাই তাদের মারতে কোনও বাধা নেই। যে কোনও হত্যাই ‘গুলির লড়াই’ বলে চালিয়ে দেওয়া যায়।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ‘স্কাই নিউজ’-এ প্রচারিত সাক্ষাৎকারে ইজরায়েলের সেনাকর্মীর বক্তব্য হলো, ইজরায়েলে যেহেতু জরুরি পরিস্থিতিতে সমস্ত মানুষের সেনায় কাজ করা বাধ্যতামূলক, তাই তাঁকে এই অভিযানে যেতে হয়েছিল। প্রথমে অন্যান্যদের মতো তিনিও ভাবতেন, এটি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান। তাঁদের উচ্চপদস্থ কর্তারা বলেছিলেন, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইজরায়েলে হামলা চালিয়ে হামাস যে পণবন্দিদের আটক করেছিল, তাঁদের রক্ষা করতেই এই অভিযান। তবে অচিরেই পণবন্দিদের কথা ভুলে গিয়ে মানুষ মারার প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে একেক জন সেনা কর্মীদের মধ্যে। অনেকেই আবার এখন নৈতিকতার প্রশ্নে সেনা থেকে ‘স্বেচ্ছা অব্যাহতি’ নিচ্ছেন। বেশির ভাগই ‘পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডার’ (পিটিএসডি)-তে আক্রান্ত হচ্ছেন। কেউ কেউ আবার সাংবাদিকদের সামনে মুখ খুলছেন।
তাঁরা বলছেন, ‘যুদ্ধে কারোর মাথা ঠিক থাকে না। মানুষ খুন করা খুব স্বাভাবিক বিষয় হয়ে ওঠে। এখন তো গাজায় খুন করা রোজকার বিনোদন হয়ে উঠেছে। আমি নিজেও গড্ডালিকা প্রবাহে ওদের মতোই ভাবতাম। তারপর বিষাদে ভোগা শুরু করলাম। বাধ্য হয়ে সরে আসতে হল। নিজের সহকর্মীদের সম্পর্কে মনে হতো যে ওরা কী করে মানুষ হতে পারে। উপলব্ধি করলাম, দোষটা আসলে ওদের নয়।ওদের প্রথম থেকেই শেখানো হয়েছে, প্যালেস্তিনীয়দের খুন করা কোনও অপরাধ নয়। গাজায় যাঁরা থাকে তাঁরা মানুষের পর্যায়ে পড়ে না। তাঁদের খুন করলে কোথাও কোনও জবাবদিহি করতে হবে না। সেনার সাধারণ কর্মীদের সকলেই খুনী বলে মনে করছেন। অবশ্যই তার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তবে যাঁরা প্রথম থেকে সেনাদের মনে বিষ ঢুকিয়ে গেছে তাঁদের শাস্তি কে দেবে?