বিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে, চিরকালই নানা মত এবং নানা সমস্য। মতামতনিয়ে তর্ক-বিতর্ক আছেই এবং তা স্বাস্থ্যেরই লক্ষণ। কিন্তু জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০২০ নিয়ে তর্কবিতর্ক বেশিদূর এগোয়নি। বরং জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ নিয়ে নীরবতা প্রকট। সরকার বিতর্ক আহ্বান করেনি। সারাদেশের শিক্ষক সমিতির অভাব নেই। তাঁদের কাছে মতামত চাইলে দশটা মতামতের প্রস্তাব আসবে। কিন্তু সেদিকে কেন্দ্রীয় সরকার ‘নট’ আগুরান। নিজের গরজে যারা সেই শিক্ষানীতি নিয়ে গেছেন, তাঁদের সে ভাবনা কালো অক্ষর দেখেছে এই মাত্র। কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন পত্র পত্রিকা প্রকাশিত জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ নিয়ে ভেবেছেন-তেমন খবর জানা যায়নি। নীরবে-নিভৃতে কেন্দ্রীয় সরকার জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ বাস্তবায়িত করে চলেছেন। এ বিষয়ে মনে হয় কর্তা ভজা সংখ্যাই বেশি। কেবল সমালোচকের দৃষ্টি ভঙ্গি নিয়ে আলোচনায় সাহসী তামিলনাড়ুর মি. স্ট্যালিন, তামিলনাড়ুর মাননীয় মুখ্যমন্ত্রী এসব বিষয়ে উচ্চকণ্ঠ হওয়া বাঞ্ছনীয়। দৈনিক পত্রিকাগুলোর এ বিষয়ে ক্রমাগত সমালোচনায় মুখর থাকার কথা। কিন্তু তেমনটা ২০২০ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত দেখা গেল কৈ? রাজ্যে রাজ্যে পরামর্শ ও কেন্দ্রের বিরুদ্ধে দাবি উত্থাপন, সে কোথায়?
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে শিক্ষা নিয়ে ক্লাসঘরের কথা যতটা তার চেয়ে বেশি কথা কোর্ট-হাইকোর্টের। রাজ্যে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে সেই ২০১০-১১ সাল থেকেই ‘মেঘলা আকাশ’। ২০১৬ যাঁরা শিক্ষক হবার জন্য পরীক্ষা দিয়েছে তাঁদের ফল নিয়ে দুর্নীতি শোনা যায় বস্তা বস্তা টাকার লেনদেনের কথা। শিক্ষার বিভিন্ন ক্ষেত্রে যারা কর্তা ব্যাক্তি ছিলেন তাঁদের অনেকেই কারাগারের অন্তরালে। এই নিয়ে শিক্ষক সমিতিগুলোর আরও বেশি সক্রিয় হবার কথা। কিন্তু তেমনটা তো দেখা যায়নি এবং দেখা যাচ্ছেও না। টাকা যেন তেন প্রকারেণ চুরি করতে হবে, তা এইসব উচ্চশিক্ষিত শিক্ষা ক্ষেত্রে আসীন কর্তাব্যক্তিদের দেখলে বোঝা যায়। শিক্ষায় সততার স্থান কোথায়? অসততা জিহ্বা থেকে কেবল লালা ঝরে পড়ছে। এই পরিস্থিতি পশ্চিমবঙ্গ এখন দুর্যোগময়-ঘনঘটায় নিমজ্জিত। চারিদিকে কেবল একটাই আওয়াজ, ‘বাঁচাও, বাঁচাও’। কাকে বাঁচাও? ছাত্রদের বাঁচাও, শিক্ষকদের বাঁচাও। ব্যাপারটা একেবারেই সহজ নয়। তার প্রথম সমস্যা হচ্ছে শিক্ষক নিয়োগের সমস্যা। চাকুরীপ্রার্থী শিক্ষকদের প্রধাণত, দুইভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগে সৎ শিক্ষক। তারা সৎভাবে নিয়োগ পরীক্ষায় পাশ করেছে। দ্বিতীয় ভাগে হচ্ছে টাকা দিয়ে বা অন্য কোনও ভাবে সৎ শিক্ষকের তালিকায় ঢুকে পড়েছে। কিন্তু এখন ধরা পড়ে গেছে। এর মধ্যে আরও অনেক কেচ্ছা রয়েছে। সব বিষয়টিই আদালত গ্রাহ্য এবং আদালত বিচার্য। হাজার হাজার চাকুরি পরীক্ষার্থীর ভাগ্য নির্ধারণ করাও আদালতের পক্ষে সহজ নয়। শিক্ষক সমিতিগুলো যদি সক্রিয় ভূমিকা নিতে পারে তবেই সমস্যার জট খুলতে পারে। প্রশাসনের প্যাঁচ এবং আইনের প্যাঁচ এতো সহজে খোলার নয়। সব সমিতির নেতৃবৃন্দ বিষয়টি ভেবে দেখতে পারেন।
বিদ্যালয় ও কলেজ স্তরে এতো সহজে খোলার নয়। সব সমিতির নেতৃবৃন্দ বিষয়টি ভেবে দেখতে পারেন। বিদ্যালয় ও কলেজ স্তরে পড়াশুনো সেটা রাজ্যের বিষয়। এই বিষয়টি কেমন চলছে? এক, বাংলা-মাধ্যম বিদ্যালয়গুলো ছাত্র-সমস্যায় ভুগে ভুগে কৃশ। তার কারণ ইংরেজি মাধ্যম বিদ্যালয়গুলোর দাপট। রাজ্য সরকারের এ বিষয়ে কঠিন দৃষ্টিভঙ্গি নেই। রাজ্য সরকার একথাজোর দিয়ে বলতে পারছেন না যে-যে মাধ্যমেই পড়ানো হোক না কেন, বাংলাভাষা কিন্তু পড়তে হবে। পশ্চিমবঙ্গে যে কোনও স্কুলে পড় না কেন ন্যূনপক্ষে তোমাকে বাংলা পড়তে হবে। বাংলা জানতে হবে কিন্তু এ বিষয়ে পশ্চিম বঙ্গসরকার মুখে ‘রা’ টি কাড়েন না। পক্ষান্তরে সর্বভারতীয় যে মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ড আছে, তারা খুব সহজেই অনুমোদন পেয়ে যায়। ভাবটা এমন যে সর্বভারতীয় বোর্ডগুলোর অনুমোদন দিয়ে যেন পশ্চিমবঙ্গ কৃতার্থ হচ্ছে। এই ধরনের বাংলা মাধ্যমের স্কুলগুলো এক ধরনের বিরোধীতা, ক্রমগত করে চলেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এতে করে বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলো হীনবল হয়ে পড়ছে। বাংলা ভাষাও নিগৃহীত হচ্ছে। কারা করছে বাঙালিরাই। পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষক সমিতিগুলো বাংলা মাধ্যমের স্বপক্ষে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের উপর চাপ দিন। এই চাপ না দিতে দিতে পশ্চিমবঙ্গ ক্রমে ক্রমে, সর্বভারতীয় মাধ্যমিক বোর্ডগুলোর স্বর্গরাজ্যে পরিণত হচ্ছে। অবনমন হবে বাংলা ভাষার। শিক্ষক সমিতির কখনোই তা কাম্য হতে পারে না।
পশ্চিমবঙ্গে মাধ্যমিক বোর্ড এূবং পশ্চিমবঙ্গ উচ্চ মাধ্যমিক সংসদ কোনও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে গঠিত হয়নি। এই দুইটি সংগঠনে কোনও শিক্ষক প্রতিনিধি নেই। অথচ বোর্ড সংসদে গঠনতন্ত্রে বলা হয়্ছে যে এই দুটি প্রতিষ্ঠানে নির্বাচিত শিক্ষক প্রতিনিধি থাকবে। কিন্তু এই বিষয়ে বোর্ড এবং সংসদ দুইই নীরব। এর ফল পদে পদে দেখা যাচ্ছে। বোর্ড এবং সংসদ যে অগণতান্ত্রিক উপায়ে চলছে, একথা উচ্চ কণ্ঠে সব সমিতিকেই বলতে হবে।
উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্রছাত্রীদের সেমিস্টার পদ্ধতিতে পরীক্ষা দিতে হবে সে কথা বহু পূর্বেই জানানো হয়েছিল। কেউ আপত্তি করেনি। কিন্তু এই আগস্ট মাসেই সেমিস্টার পদ্ধতির ভরাডুবি হলো। সেমিস্টার প্রথায় একটা পরীক্ষা হবেই হবে। আর এই আগস্ট মাসেই ভরা বাদল, ঝড়-বৃষ্টি ও বন্যা একথা সবাই জানে। প্ল্যান করার সময় সেই সব বাস্তব অবস্থার কথা ভাবা হয়নি। কিন্তু বাস্তব তো বাস্তবই। এই আগস্টের ভরা বর্ষায় কি করে হবে সেমিস্টার পরীক্ষা? এই তৃতীয় সেমিস্টার বন্যা কবলিত, পশ্চিমবঙ্গে বেশ কয়েকটি মহকুমা বন্যা কবলিত। এই বন্যার মধ্যে ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষার হলে যাবে কি করে? সংসদ বলছে নৌকোয় করে ছাত্রছাত্রীরা পরীক্ষা দিতে যাবে। পর্যদ ইতিমধ্যেই জেলা প্রশাসনকে এই বিষয়ে অবহিত করে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে। প্রয়োজনে বিপর্যয় মোকাবিলা বাহিনীকে প্রস্তুত রাখতে হবে। এই বিপর্যয়ক পরিস্থিতি সহজেই এড়িয়ে যাওয়া যেতো তৃতীয় সেমিস্টারের তারিখের কিছু হেরফের করে বর্ষণ এড়িয়ে যেতে পারলেই। পর্ষদে যদি শিক্ষক প্রতিনিধি থাকতেন তবে তারাই এই পরামর্শ দিতেন। কারণ প্রতি বছরই তো তাদের বন্যার মোকাবিলা করতে হয়।
গণতান্ত্রিক পদ্ধতি এড়িয়ে যাবার ফলে সমস্যার সম্মুখীন সংসদ। এখন সংসদ বলছে যে যেহেতু বর্ষার মধ্যে সেমিস্টার পরীক্ষা চলবে, তাই তৈরি করে রাখতে বলা হয়েছে বিকল্প সেমিস্টার পরীক্ষা কেন্দ্র। ঘাটাল, আরামবাগ, উদয়নারায়ণপুরের মতন বন্যাপ্রবণ এলাকাগুলিতে এমন পরীক্ষা কেন্দ্র নির্বাচন করার কথা বলা হয়েছে, যেগুলি অপেক্ষাকৃত উঁচু এলাকায় অবস্থিত এবং যেখানে বন্যায় জল ঢুকবে না। আর টানা বৃষ্টি হলে বা টানা বৃষ্টি চললে পরীক্ষা শুরুর কয়েক দিন আগে পরীক্ষার্থীদের এমন কোনও জায়গায় এনে রাখার ব্যবস্থা করতে হবে যেখান থেকে পরীক্ষা কেন্দ্র যেতে তাদের অসুবিধা না হয়। সেমিস্টার পরীক্ষা সম্বন্ধে পূর্বে ভেবে প্ল্যান ঠিক করলে, এইসব সমস্যা এড়ানো সম্ভব হতো।
সমস্যা এড়ানোর কথা যখন উঠলো জয়েন্ট এন্ট্রান্সের ফল প্রকাশে পশ্চিমবঙ্গে বিলম্বের কথা এসে পড়তে বাধ্য। ৭ আগস্ট জয়েন্ট এন্ট্রান্সের পরীক্ষার ফল প্রকাশের কথা ছিল কিন্তু ওবিসি সংক্রান্ত জটিলতার কারণে ওইদিন ফল প্রকাশ করা যায়নি। নতুন ওবিসি নীতি নিয়ে এখন হাইকোর্ট ও রাজ্য সরকারের মধ্যে দৌড়াদৌড়ির পূর্ব থেকে সচেতন হয়ে রাজ্য সরকার যদি পদক্ষেপ করতো তাহলে সম্ভবত এবারের জয়েন্ট এন্ট্রান্সের পরীক্ষার্থীরা রেহাই পেত। এখন ছাত্রছাত্রীরা মহা সমস্যায় দিন কাটাচ্ছে বিষয়টি সোজা নয়। রাজ্য জয়েন্ট এন্ট্রান্সের পরীক্ষা হয়েছিল গত ২৭ এপ্রিল। পরীক্ষার পর কেটে গিয়েছে টানা ৩ মাস। এই দীর্ঘ তিন মাসের মধ্যে রাজ্য সরকার কোনও ব্যবস্থা করতে পারেনি পরীক্ষার্থী ছাত্রছাত্রীদের মুখ চেয়ে—এটা একটা দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা। দায় কার? কিন্তু ফল ভুগছে জয়েন্ট এন্ট্রান্সের পরীক্ষার্থীরা। পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা বিভাগ আগে থেকে সতর্ক থাকলে অনেক সমস্যারই সহজ সমাধান হতো। কিন্তু তা হয়নি। শিক্ষক সমিতিগুলো আর একটু শক্তপোক্ত বাদ-প্রতিবাদ করলে পশ্চিমবঙ্গের শিক্ষা বিভাগকে আরো বেশি সতর্ক পরিচালনা করতে হতো।
এসব কিছু রাজনৈতিক বিষয় নয়। প্রশাসনিক দক্ষতার বিষয়। পশ্চিমবঙ্গে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর বিষয়। বিদ্যালয়ের প্রদান শিক্ষক মহাশয়দের কাছে কি প্রত্যাশা? সরকার কি সে বিষয়ে সচেতন? তা বলা যায় না। একজন প্রধান শিক্ষকের মূল দায়িত্ব হচ্ছে বিদ্যালয়ের পঠন পাঠন। তার চোখের মণি প্রতিটি ছাত্র বা ছাত্রী। নানা বিষয়ে পঠন পাঠন বাদে, একজন প্রধান শিক্ষককে দেখতে হয় প্রতিটি ছাত্রের বা ছাত্রীর যথার্থ বিকাশ হচ্ছে কিনা। সেই বিকাশ না হলে কোথায় বাধা, তার নিরসন করা, শিক্ষকমণ্ডলীকে নিয়ে, একজন বিদ্যালয় প্রধানের কাছে জাতির প্রধান কাম্য। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে আমরা কি দেখছি? আমরা দেখছি প্রধান শিক্ষক মশাই ব্যস্ত কিন্তু শিক্ষা দপ্তর নিয়ে। শিক্ষার সংখ্যা কম, সেই সংখ্যাকে কিভাবে বাড়িয়ে ছাত্র/ছাত্রীদের প্রয়োজন মিটানো যায়। ব্যাপারটা খুব সোজা নয়, বরং বেশ কঠিন। এর জন্য প্রধান শিক্ষককে অনেক সময় ব্যয় করতে হয়। তাছাড়াও অনেক সমস্যা জড়িয়ে আছে শিক্ষার বিবিধ প্রকল্প নিয়ে। তেমন একটি প্রকল্প হচ্ছে কন্যাশ্রী এর উপরেও আরও কয়েকটি প্রকল্প। মিড-ডে মিল তা আছেই। মোবাইলি কেনার টাকা। সবুজ সাথীর মতো আরও আরও আরো প্রকল্প। প্রধান শিক্ষক যদি এইসব প্রকল্প এবং তার সঙ্গে যুক্ত সমস্যা নিয়ে সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকেন তবে বিদ্যালয়ের পঠন-পাঠন নিয়ে ভাববেন কখন। এই বিষয়টি, রাজ্যনীতি নয়। শিক্ষা বিভাগকে অবশ্যই এক প্রধান শিক্ষকের উপরে কতটা ‘লোড’ দেওয়া যায় সেই বিষয়ে বাস্তবোচিত পদক্ষেপ নিতে হবে। নইলে হিতে হবে বিপরীত। প্রকল্পগুলোর সুফল যতটুকু পাবার কথা তা পাওয়া যাবে না। যারা প্রকল্পগুলো রচনা করেছেন তাদের মাথায় পরবে হাত। অন্যদিকে পঠন পাঠনে ন্যায্য মান এবং কাম্য মান যতটুকু পাবার কথা ততটুকু পাওয়া যাবে না। ফলে শিক্ষােক্ষত্রে প্রার্থীও উন্নয়ন পাওয়া কঠিন হবে।