‘বাহবা, বাহবা, কেয়া মজার ভীম !
তানা-নানা, তানা-নানা, তানা-নানা ধিন ।
আচ্ছা কি ঠাণ্ডা বেলেল্লা গুণ্ডা,
প্রাণটা করে দিলে হিম,
আসল পাজি, কড়া মেজাজী
বদ- আওয়াজি ভীম,
তানা-নানা, তানা-নানা, তানা-নানা ধিন!’
সেকালে নীরদচন্দ্র চৌধুরীর (১৮৯৭-১৯৯৯) বিক্রমপুর জেলার নারায়ণগঞ্জের বাড়ির (অধুনা বাংলাদেশ) দুর্গাপুজায় যাত্রাপালায় ভীম গদা কাঁধে নিয়ে গোঁফে তা দিতে দিতে পদাচারণা করার সময় ভাঁড় তাকে দেখে এই গানটি গাইত । শ্রোতারা শুনে হেসে খুন হয়ে যেত । মহাভারতের সঙ্গে এই গানটির বিচিত্র অসঙ্গতির ধারনা নীরদচন্দ্র চৌধুরীর মনেও জাগত না । তাঁর ছেলেবেলায় তিনি গানটি মহাউৎসাহে গেয়েছেন, রসবোধ সূক্ষ না হওয়া পর্যন্ত । শুধু নীতিশিক্ষা দিয়ে লোকের মনোরঞ্জন করা যেত্ না । তাই প্রতিটি পালাতেই একভাবে না হয়ে এইভাবে ভাঁড়কে দিয়ে হাস্যরসের অবতারণা করা হত । সেকালে জমিদার বাড়ির দুর্গাপূজার এ রকম যাত্রাপালা অনুষ্ঠিত হত । তখন ভদ্র বাঙালী জীবিকার জন্য শহরবাসী হলেও পৈতৃক গ্রামকেই নিজেদের আসল বাসস্থান বলে মনে করত । তাঁদের সন্তানরা শহরে জন্মনিলেও পিতার গ্রামকেই নিজেদের প্রকৃত ভিটা বলে ধরত ।
নীরদচন্দ্রের কথায় “আমার পিতাই প্রথম পৈতৃক ভিটা ছাড়িয়া শহরবাসী হইয়াছিলেন । — অল্পদিনের মধ্যেই আমাদের বাড়ির সকলেই সম্পন্নতা ফিরিয়া আনিয়াছিলেন । আমার পিতাও নূতন ভূ-সম্পত্তি কিনিয়াছিলেন । আমার জ্ঞান হইবার পর যখনই বনগ্রাম গিয়াছি তখনই সম্পন্ন বাঙালীর জীবন যাত্রাই দেখিয়াছি । বারো মাসে তের পার্বন তো হইতই, দুর্গাপূজাও অতিশয় ধুমধাম করিয়া হইত”। তিনি আরও লিখেছেন,-“আমাদের পৈতৃক বাড়িতে বারো মাসে তেরো পার্বন হইত । — বাঙালীর ধর্মজীবনে দুর্গার স্থান এমনই ছিল যে, বাঙালী ‘পূজা’ বলিতে শুধু দুর্গাপূজাই বুঝিত । যে বাঙালীর দুর্গাপূজার সহিত পরিচয় নাই সে কখনও বাঙালী হইতে পারে না । তাই আজও বাঙালীরা অন্য সব বাঙালী ধারা ছাড়িলেও, দুর্গাপূজার সহিত সংশ্রব ত্যাগ করিতে পারে নাই । কলিকাতার বাঙালী পুরুষ প্যান্ট পরিয়াও দুর্গাপূজায় যোগ দেয়, কেহ তাহাতে আপত্তি করে নাই”। কন্যারও সালোয়ার কামিজ এমনকি ‘জীনস’ পরে দুর্গাকে প্রনাম করে ।
তখনকার দিনে কোনো বনিয়াদী বাঙালী ভদ্রলোক নিজের বাড়ি ভিন্ন জ্ঞাতির বাড়িতেও পূজায় যোগ দিত না । নীরোদচন্দ্রও পিতৃপুরুষের ভিটার বাইরে দুর্গাপূজা দেখেন নি । শেষ দেখা ১৯১৮ সালে হয়েছিল । অবশ্য তিনি পুরানো বাড়ির দুর্গা প্রতিমা দেখতে যেতেন, তবে তা শুধু তাঁদের প্রতিমার সঙ্গে অন্যান্যদের প্রতিমা তুলনা করবার জন্য। কোনো বনিয়াদী ভদ্রলোকের বারোয়ারী পূজায় যাওয়া অকল্পনীয় ছিল। কিশোরগঞ্জ শহরে বারোয়ারী পূজা হত, কিন্তু সেখানে যেত কেবল শহরের আমলা-মুহুরীরা, দোকানদাররা ও চাকরবাকর । শহরের সম্ভ্রান্ত ভদ্র লোকেরা অবশ্য পূজার সময়ে পৈতৃক ভিটায় যেতেন।
নীরদচন্দ্রের বাল্যকালে বিস্তর ঠাট, সত্যই বিস্তর ছিল । তাঁদের ভিটার বনগ্রামের ‘নূতন বাড়িতে’ প্রায় তিন মাস আগে হতেই প্রতিমাগুলি গড়া আরম্ভ হত । তাঁদের কুমোরটি নিজে ভক্ত ও সাধক ছিল । সে চাইতেন দেবদেবীর মূর্তি তাঁর মানস চক্ষুতে যেমন, ধ্যানে যেভাবে বর্ণিত, তার রূপ মাটির মূর্তিতে দিতে । তাই সামান্য খুঁত থাকলেও সে দোমেটের সময়ে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ তিন চার বার গড়ত তাঁর গড়া লক্ষী ও সরস্বতীর মুখ মহাযান বৌদ্ধ ধর্মের দেবদেবীর ও পালবংশের সময়কার ভাস্কর্যে হিন্দু দেবদেবীর মুখের মত । শত শত বৎসর ধরে মুখের গড়ন অপরিবর্তিত ছিল । বলাবাহুল্য, প্রতিমাতে দেবদেবীর মুখের রূপ পরিবর্তন ধর্ম বিরুদ্ধ বলে মনে করা হত । যখন এই বিকৃতি ঘটে, তখন ধর্মও নিষ্ঠার প্রকাশ না হয়ে তামাসায় পরিণত হয় ।
দুর্গাপূজার জন্য নীরদচন্দ্র কিশোরগঞ্জ হতে নৌকায় বনগ্রামে যেতেন ষষ্ঠীপূজার দিনে । তারপর কোজাগরী লক্ষীপূর্ণিমা পর্যন্ত থেকে আবার কিশোরগঞ্জে ফিরে আসতেন । এই কয়দিনেই শত শত বৎসরের বাঙালীত্বের সঙ্গে সাক্ষাৎকার হয়ে যেত । তাঁদের পৌঁছবার আগেই বোধন শেষ হয়ে যেত । দেখতেন মণ্ডপে প্রতিমাগুলি ও কাঠামো বসানো হয়ে গেছে, দেবদেবীর বস্ত্রালঙ্কার ও চালচিত্রের সজ্জা ঝকমক করত। উপরে বিলিতি ঝাড়-লণ্ঠন, দেয়ালে দেয়ালগিরি সবই উজ্জ্বল কাঁচের, নীচে পূজার সামগ্রী, প্রদীপ, কোষাকুষী, ঘণ্টা, ঘটে ফুল বেলপাতা ইত্যাদি । উঠানে মণ্ডপের ধাপের কাছে ছোট বড় বড় দুটি হাড়িকাঠ পোঁতা-পাঁঠা ও মহিষ বলির জন্য । মণ্ডপের পূর্ব দিকে সাত আটটি পাঁঠা ও পুকুরপড়ে একটি খোঁটায় বলির মহিষ বাঁধা থাকত ।
মণ্ডপের উঠানে হাড়িকাঠের পিছনেই বড় চাঁদোয়া, নীচে শতরঞ্জ পাতা ও একদিকে চেয়ার-বেঞ্চ ইত্যাদি বসানো । এই চাঁদোয়ার নীচে পূজার সময়ে দর্শকেরা বসত ও পরে যাত্রা হত । উঠানের পশ্চিমদিকে ভিতরের বাড়িতে আড়াল করে লম্বা রঙ্গ দেখার ঘর, তাঁর সামনে বেড়ার বদলে চিক খাটানো, পিছনে বসে বাড়ির মেয়েরা পূজা, বলি, তামাসা, যাত্রা ইত্যাদি দেখতেন । উঠানের পাশে বাদকেরা দাঁড়িয়ে থাকত সকলেই মুসলমান । পূজার বাজনাদারেরা মুসলমান হত । হিন্দু বাদক ও যুবকেরা শুধু মণ্ডপের ভেতরে ঘণ্টা-কাঁসর বাজাত ও মেয়েরা শাঁখে ফুঁ দিত ।
মণ্ডপের সামনে আটচালাতে থিয়েটারের স্টেজ বাঁধা থাকত । তখনকার দিনে গ্রামে গ্রামে প্রত্যেক বনেদী ও সম্পন্ন ঘরে বিলাতী থিয়েটারের সরঞ্জাম থাকত । নীরদচন্দ্র চৌধুরীদের ড্রপসিন, সিন, উইঙ্গ ইত্যাদি সবই ছিল । ড্রপসিনে সমুদ্রের ছবি ও দুই কোনের আকাশে দুটি পরী যবনিকা ধরে রয়েছে । তাঁদের ‘ঐক্যতান’ বাদনের দলও ছিল- তাতে দেশি বিলাতী দু-রকমের বাজনাই ছিল- দেশি- এস্রাজ, সেতার, বাঁশী, বিলাতী ফ্লুট, ক্ল্যারিওনেট ইত্যাদি । নাটক আরম্ভ হবার আগে প্রচণ্ড উদ্যমে এই ঐক্যতান বাজতে থাকত, আরতির শঙ্খ ঘণ্টা ঢোলকে টেক্কা দিয়ে । এই পারিবারিক স্টেজে ‘বিল্বমঙ্গল’ ও ‘প্রতাবাদিত্য’ অভিনিত হত ।
পূজার সময় যাত্রা দল আনা হত । কর্ণবধ, সীতার বনবাস, অম্বরিশের ব্রহ্মশাপ ইত্যাদি অভিনীত হত । অভিমন্যুবধ হোক বা সীতার বনবাস উভয় যাত্রাপালায় করুণরসের অবতারণাই যাত্রার একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল না, তাতে যথেষ্ট নীতি শিক্ষা ও ধর্ম শিক্ষা থাকত । বস্তুত হিন্দুর পুরাতন ইতিহাসের কথা অবিস্মৃত রাখা ছাড়া হিন্দুর ধর্মবোধ লোকসমাজে প্রচলিত রাখাও যাত্রার অন্যতম মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল । যাত্রা শুনে শ্রোতাদের ন্যায় অন্যায়, ধর্মাধর্ম বোধ উদ্বেলিত হয়ে উঠত ।
সপ্তমীর দিনে এক প্রস্থ পূজা শেষ হলে বলি আরম্ভ হত । চাকরেরা পাঁঠাগুলিকে স্নান করিয়ে গলায় ফুলের মালা দিয়ে হাড়িকাঠে আবদ্ধ করত । পাঁঠা আর্তস্বরে ডাকতে থাকত । সেই ডাককে চাপা দেওয়ার জন্য মুসলমান বাদকেরা তুমুল উৎসাহে ঢোল ও কাঁসি বাজাত । ঈশ্বর গুপ্ত কিন্তু পাঁঠার এই আর্তনাদের অন্য বাখ্যা দিয়েছেন- পাঁঠা সম্বন্ধে লিখেছেন –
সাধ্যকার একমুখে, মহিমা প্রকাশে,
আপনি করেন বাদ্য আপনার নাশে ।
হাড়কাঠে ফেলে দেই ধরে দুটি ঠ্যাঙ্গ,
এ সময়ে বাদ্য করে ছ্যাড্যাঙ্গ ছ্যাড্যাঙ্গ’।।
হঠাৎ দেখা যেত খড়গ দিয়ে পাঁঠার মুণ্ড ছিন্ন করতে । মাটিতে গড়িয়ে পড়ত মুণ্ডটি । পুরোহিত হাঁটু গেড়ে বসে একটা থালাতে খানিকটা রক্ত নিয়ে, মাথাটি থালায় তূলে দৌড়ে গিয়ে দেবীর পায়ের কাছে রাখত । এভাবে একটার পর একটা পাঁঠার মুণ্ডচ্ছেদ করা হত । বিজয়া দশমীর দিন নীরদচন্দ্র চৌধুরীর বাড়ির মেয়েরা দেবীকে শেষ প্রণাম করে আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে অন্তঃপুরে ফিরতেন । তিনি বালক হলেও তখন একটা গভীর বিষাদ তাঁদের মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলত ।
সেকালে প্রত্যেকটি সম্পন্ন বাঙালি পরিবার যে আড়ম্বর করে দুর্গাপূজা করত তা আমোদ প্রমোদের দিকেই হোক, কিংবা ধর্মাচরণের দিকেই হোক, শুধু পারিবারিক মঙ্গল বা বংশোচিত মর্যদার জন্যই করত না, সামাজিক কর্তব্য হিসাবেও করত । তাঁদের অনুষ্ঠানে যে কেউ এসে বিনা ব্যয়ে যোগ দিতে পারত । তাঁরা নিজেদের বলি ও ভোগ নিয়ে আসত । সম্পন্ন ভদ্রলোক মনে রাখত যে হিন্দুর ধর্ম জীবনের ধারা অব্যাহত রাখবার ভার তাঁর উপর, কারণ দেশ বিধর্মীর শাসনে, হিন্দু রাজা নেই, সুতরাং ধর্মকে রক্ষারভার হিন্দু ভদ্র সমাজের উপর ।