একজন মাত্র ইলেকশন রেজিস্ট্রেশন অফিসারের দায়িত্বে তিন লক্ষ ভোটার। তাঁদের থেকে তথ্য সংগ্রহ করে ফর্ম পূরণ করতে হবে। আর এই কাজ শেষ করতে হবে একমাসের মধ্যেই। বিহারের স্পেশাল ইন্টেনসিভ রিভিশন প্রক্রিয়ায় ভোটারদের কাছে না গিয়ে, তাদের সঙ্গে দেখা না করেই অসংখ্য ফর্ম আপলোড করা হয়েছে। তাঁদের আবেদন করা ফর্ম নির্বাচন কমিশনের পোর্টালে জমা পড়েছে বলে যখন ভোটররা মোবাইলে মেসেজ পাচ্ছেন, তখন ভাবছেন, আমরা তো আবেদনই করিনি। নির্বাচন কমিশনের কোনও কর্মী তো দেখাই করতে আসেননি। তাহলে কীভাবে ফর্ম পূরণ হয়ে জমা পড়ে গেল? অ্যাসোসিয়েশন অফ ডেমোক্রেটিক রিফর্মস (এপিডিআর) এই রিভিশন প্রক্রিয়া নিয়ে রিট পিটিশন আগেই করেছে সুপ্রিম কোর্টে। নির্বাচন কমিশনের জমা দেওয়া জবাবের বিরুদ্ধে রিজয়েন্ডার পেশ করেছে এপিডিআর। তারা জানিয়েছে, বিহারে নাগরিকত্ব যাচাইয়ের ক্ষেত্রে ভোটারদের সঙ্গে গুরুতর জালিয়াতি হয়েছে। তালিকা সংশোধনের কাজ করতে গিয়ে শীর্ষ আদালতের অতীতের রায়কেও অগ্রাহ্য করা হয়েছে।
এপিডিআর আরও জানিয়েছে, এখনও পর্যন্ত নির্বাচন কমিশন যুক্তি ও প্রামাণ দেখাতে পারেনি যে, কেন আধার কার্ড, রেশন কার্ড গ্রাহ্য হবে না। এই রিজয়েন্ডারে এপিডিআর জানিয়েছে, ভোটারদের অনুমোদন ও স্বাক্ষর ছাড়া কমিশনের নিযুক্ত কর্মীরা কীভাবে ফর্ম পূরণ করে আপলোড করে দিচ্ছে, তার জবাব কমিশনের কাছে চাওয়া হোক। নির্বাচন কমিশন যেহেতু এক মাসের মধ্যে সব নথিপত্র সহ ভোটারদের স্বাক্ষরিত ফর্ম পূরণ করে আপলোড করার অবাস্তব টার্গেট দিয়েছে, তাই রেজিস্ট্রেশন অফিসাররা ভোটরদের ফর্ম নিজেরাই আপলোড করে দিয়েছেন। অথচ কোনও বুথ লেভেল অফিসার এই ভোটারদের সঙ্গে দেখাই করেননি।
এইসব ফর্ম গণহারে আপলোড করে দেওয়া হয়েছে। সুপ্রিম কোর্টের কাছে জমা দেওয়া বক্তব্যে এপিডিআর জানিয়েছে, বহু মৃত ভোটারের ফর্ম ও স্বাক্ষর সহ অপলোড করে দেওয়া হয়েছে। আর সেই কারণে যে আশঙ্কা বারংবার করা হয়েছে, সেটাই হচ্ছে। অর্থাৎ, এই গোটা প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। আরও বলা হয়েছে, আধার কার্ড কেন একটি বৈধ নাগরিকত্বের নথি হিসাবে গ্রহণ করা হবে না, তার যথার্থ কারণ দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে নির্বাচন কমিশন। আধার কার্ড গ্রাহ্য করা হয়, পার্মানেন্ট রেসিডেন্স সার্টিফিকেট ইস্যু থেকে শুরু করে ওবিসি, এসসি, এসটি সার্টিফিকেট, এমনকী পাসপোর্ট ইস্যু করার ক্ষেত্রে। তাহলে এক্ষেত্রে কেন সেটি বৈধ হবে না, এর উত্তর মেলেনি নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে।
বিহার ভোটার তালিকার বিশেষ নিবিড় সংশোধন (এসআইআর) স্রেফ ভোটার তালিকা সংশোধনের মতো সাধারণ নির্বাচনী কাজ নয়, বরং জনগণের বিশেষ করে দরিদ্র শ্রমিক কৃষক খেতমজুর, সংখ্যালঘু এবং অন্যান্য প্রান্তিক সম্প্রদায়ের গণতান্ত্রিক অধিকারের উপর তীব্র রাজনৈতিক আক্রমণ। ভোটার তালিকা সংশোধনের জন্য আপাতদৃষ্টিতে গৃহীত এসআইআর প্রক্রিয়াটি বিজেপি পরিচালিত সরকারের নির্দেশে চলা নির্বাচন কমিশনের আমরাতান্ত্রিক স্বেচ্ছাচারিতা, আইনগতভাবে অসঙ্গতিপূর্ণ এবং নাগরিকত্বের বিষয়ে স্বৈরাচারী বোঝাপড়ার ইচ্ছাকৃত প্রক্রিয়া।
নাগরিত্বের প্রমাণ চাওয়ার নির্বাচন কমিশনের এই নতুন উদ্যোগে, বিশেষ করে ২০০৩ সালের ভোটার তালিকায় যাদের নাম ছিল না, তাদের নাগরিকত্বের প্রমাণ দাখিল করতে বলা হচ্ছে। ভারতের বহু সাধারণ, দরিদ্র, নিরক্ষর এবং প্রান্তিক মানুষের কাছে প্রয়োজনীয় জন্ম সার্টিফিকেট বা অন্যান্য পুরানো নাগরিকত্বের প্রমাণপত্র নেই। নিয়মিত বন্যা বা অন্যান্য নানা কারণে দরিদ্র মানুষের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নষ্ট হয়ে যায় বা হারিয়ে যায়। আবার নতুন করে এইসব নথিপত্র জোগাড় করা তাদের পক্ষে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সম্ভব হয় না সরকারি লালফিতার দৌলতে। এর ফলে তারা যোগ্য হওয়া সত্বেও ভোটর তালিকা থেকে বাদ পড়তে পারেন।
এসআইআর ইতিমধ্যেই প্রায় ৩৫.৭ লক্ষ ভোটারকে ‘অনাবিষ্কৃত’ বলে চিহ্নিত করেছে। এর মধ্যে রয়েছে ২২ লক্ষ মৃত, ৩৫ নিখোঁজ বা স্থায়ীভাবে স্থানান্তরিত, ৭ লক্ষ একাধিক ক্ষেত্রে নাম এবং ১.২ লক্ষ ফর্ম খতিয়ে দেখা হচ্ছে। এই ভোটারদের বেশিরভাগই গ্রামও শহরের দরিদ্র মানুষ, অভিবাসী বা পরিযায়ী শ্রমিক, মুসলিম, দলিত এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের। অর্থনৈতিক সঙ্কটের ফলেই এদের স্থায়ী ঠিকানা থাকে না। এদের মধ্যে বিদেশি অনুপ্রবেশকারী রয়েছে কিনা, তা কমিশন এখনও জানাতে পারেনি।