ফের সুপ্রিম কোর্টে মুখ পুড়ল কেন্দ্রের মোদী সরকারের। বাংলায় ১০০ দিনের কাজ সংক্রান্ত বিষয়ে কলকাতা হাইকোর্টের রায় বহাল রাখল শীর্ষ আদালত। কয়েক সেকেন্ডের শুনানিতে মোদী সরকারের আইনজীবীর কাছে আদালতের প্রশ্ন ছিল, ‘আপনারা মামলা ফেরত নেবেন, নাকি আমরা খারিজ করে দেব?’ এরপরই কেন্দ্রের আবেদন খারিজ করে দেন বিচারপতি বিক্রম নাথ ও বিচারপতি সন্দীপ মেহতার নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ। যার ফলে পশ্চিমবঙ্গকে ১০০ দিনের বকেয়া কাজের টাকা মেটাতে হবে কেন্দ্রীয় সরকারকে। সুপ্রিম কোর্টের এই নির্দেশের পর তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় হুমকি দিয়ে বলেছেন, কেন্দ্র বকেয়া না মেটালে দিল্লিতে মেগা ধরনা হবে।
বাংলায় ১০০ দিনের কাজে ‘ব্যাপক দুর্নীতি’ হয়েছে বলে অভিযোগ তুলে ২০২২ সালের মার্চ থেকে এই প্রকল্পের টাকা বন্ধ রেখেছে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রক। রাজ্যে বারবার এসেছে কেন্দ্রের বিভিন্ন তদন্তকারী দল। রাজ্যের প্রতি বঞ্চনার অভিযোগে পথে নেমে আন্দোলন করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সাংসদদের প্রতিনিধি দল নিয়ে দিল্লিতে কৃষিভবনে তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী গিরিরাজ সিংয়ের সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে আটক হতে হয় সাংসদ তথা তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। রাস্তার আন্দোলন গড়ায় আদালতে। কেন্দ্র-রাজ্য দ্বন্দ্বে সমস্যায় পড়তে হয় গরিব প্রান্তিক মানুষকে। এই সমস্যার সমাধানের আর্জি জানিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের দ্বারস্থ হয় পশ্চিমবঙ্গ খেত মজদুর সমিতি। গত ১৮ জুন কলকাতা হাইকোর্ট নির্দেশ দেয়, ১ আগস্ট থেকে চালু করতে হবে একশো দিনের কাজ। সেই নির্দেশ মানার পরিবর্তে ৩১ জুলাই হাইকোর্টের রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে শীর্ষ আদালতে যায় কেন্দ্র।
২২ সেপ্টেম্বর ও ১৩ অক্টোবর— দু’দিনই আদালতের কাছে অতিরিক্ত সময় চান সলিসিটার জেনারেল তুষার মেহতা। শেষ শুনানিতে খেত মজদুর সমিতির আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য আদালতে বলেন, বারবার শুনানি পিছিয়ে যাওয়ায় বঞ্চিত হচ্ছেন রাজ্যের গরিব মানুষ। পরের শুনানিতে যেন কেন্দ্রের আইনজীবী তৈরি হয়ে আসেন, এই আর্জিও জানান বিকাশবাবু। মাত্র কয়েক সেকেন্ডের শুনানিতে কেন্দ্রের আবেদন খারিজ করে দেয় আদালত। আদালতকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিকাশবাবু বলেন, এই রায়ে রাজ্যের গরিব মানুষেরা আবার কাজ পাবেন। রাজ্যের আইনজীবী কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, অল্প কথায় অনেক কিছু বলে দিয়েছে আদালত। এই রায়ের ফলে বকেয়া টাকা দিতে ও ১ আগস্ট থেকে কাজ দিতে বাধ্য হবে কেন্দ্র।
সর্বোচ্চ আদালতের রায়কে স্বাগত জানিয়েছে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস। লোকসভায় তৃণমূলের দলনেতা অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ‘বহিরাগত বাংলা-বিরোধী জমিদারদের আরেকটি শোচনীয় পরাজয়। বাংলায় একশো দিনের কাজ পুনরায় চালু করার বিষয়ে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে কেন্দ্রের দাখিল করা আবেদন খারিজ করে দিয়েছে মহামান্য সুপ্রিম কোর্ট। এই ঘটনা বাংলার জনগণ, যাঁরা দিল্লির অহংকার ও অন্যায়ের সামনে মাথা নত করতে অস্বীকার করেছিল, তাঁদের জন্য এক ঐতিহাসিক জয়। বিজেপি যখনই রাজনৈতিকভাবে আমাদের হারাতে ব্যর্থ হয়েছে, তখনই ওরা আমাদের বঞ্চিত করেছে ন্যায্য পাওনা থেকে। বাংলার উপর অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করেছিল ওরা। গরিব খেটে খাওয়া মানুষের মজুরি কেড়ে নিয়েছিল। তৃণমূলের পাশে দাঁড়ানোর জন্য জনগণকে শাস্তি দিতে চেয়েছিল। কিন্তু বাংলা হার মানেনি। আমরা প্রতিটি প্রাপ্য টাকা, প্রতিটি খেটে খাওয়া সৎ মানুষ, প্রত্যেকের কণ্ঠরোধের জন্য লড়াই করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। আদালতের এই রায় তাদের মুখে গণতান্ত্রিক চপেটাঘাত। যাঁরা ভেবেছিল বাংলাকে নির্যাতন করা যেতে পারে, দমিয়ে রাখা যেতে পারে বা জোর করা যেতে পারে। নিজের অহংকারের দাম চুকিয়েছে বিজেপি। ওরা জবাবদিহি ছাড়াই ক্ষমতা চায়। ওরা বাংলা থেকে নেয়, কিন্তু তার প্রাপ্য ফেরত দিতে অস্বীকার করে। ওরা জনগণের ভোটের হেরেছে, এবার সুপ্রিম কোর্টেও হারল।’
বিজেপির জমিদাররা আদালতে হারল, আগামী দিনে বাংলার ভোটেও হারবে। এদের ঔদ্ধত্য, অহংকারই পতনের কারণ হবে। বাংলার মানুষের প্রাপ্য টাকা বন্ধ রেখে আদালতের নির্দেশ অমান্য করে বিজেপি প্রমাণ করেছে যে তারা বাংলা-বিরোধী, গরিব-বিরোধী এবং মানুষ-বিরোধী একটি দল।
মনরেগা নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশের পর সুপ্রিম কোর্ট তা বহাল রাখলেও বকেয়া অর্থ মেটানো নিয়ে ধোঁয়াশা এখনও অব্যাহত। আগামী দিনে শীর্ষ আদালত কী নির্দেশ দেয় সেদিকে নজর এখন সকলের। কিন্তু এসবের মধ্যেই বাংলার বকেয়া প্রাপ্য নিয়ে ‘গরমিলের’ অভিযোগ উঠল কেন্দ্রের বিরুদ্ধে। আর সেই গরমিলের অঙ্কটা কম নয়, প্রাপ্য প্রায় হাজার কোটি টাকা। ২০২২ সালের ডিসেম্বর থেকে নতুন করে শ্রমদিবস অনুমোদন পর্যন্ত আটকে রাখা হয়্ছে। রাজ্যের তরফে আগাগোড়াই কাগজে-কলমে হিসেব পেশ করে জানানো হয়েছে, কেন্দ্রের অনুমোদিত কাজ বাবদ এখনও বকেয়া ৬ হাজার ৯১৯ কোটি টাকা। কিন্তু বর্তমানে কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রকের এনআরইজিএ সফট্ পোর্টালে চক্ষু চড়কগাছ নবান্নের। কারণ, কেন্দ্রের হিসাবে বাংলার বকেয়া মাত্র ৬৩ হাজার ২ কোটি টাকা। উধাও ৯১৭ কোটি টাকা। ইতিমধ্যে বিষয়টি নিয়ে অবশ্য সরব হয়েছে রাজ্য প্রশাসন।
দুরাত্মার ছলের অভাব হয় না। শ্রমদিবস সৃষ্টি বা এই সংক্রান্ত ইস্যু নিয়ে কেন্দ্র-রাজ্যের মধ্যে কোনও মতপার্থক্য তৈরি হলে দু’পক্ষের আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টির নিষ্পত্তি হওয়াটাই ছিল রীতি। একাধিক চিঠি, পোর্টাল থেকে শুরু করে বিভিন্ন বৈঠকে রাজ্যের বকেয়া ৬ হাজার ৯১৯ কোটি টাকা বলেই জানানো হয়েছে কেন্দ্রকে। তা সত্ত্বেও প্রায় এক হাজার কোটি টাকা কম দেখানোর বিষয়টি অনেকেই মানতে পারছেন না। এটা কেন্দ্রের নয়া চক্রান্ত বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা।