শোভনলাল চক্রবর্তী
বিতর্কিত’ কাশির সিরাপ নিয়ে এ বার সতর্ক করল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (হু)। চিহ্নিত তিনটি কাশির ওষুধের ব্যবহার নিয়ে বিশ্বব্যাপী এই সতর্কতা জারি করা হয়েছে। সেই তিন কাশির সিরাপ হল— কোল্ডরিফ, রেসপিফ্রেস টিআর এবং রিলাইফ। বিভিন্ন দেশের জাতীয় ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে মূলত এই তিন কাশির সিরাপের বিষয়ে সতর্ক করার হয়েছে। যদি কোনও দেশে ওই ‘বিতর্কিত’ সিরাপগুলির ব্যবহারের খোঁজ মেলে, তবে অবিলম্বে তা নিয়ে পদক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছে হু। হু-র জারি করা সতর্কবার্তায়, দেশের অনিয়ন্ত্রিত বাজারগুলির উপর নজরদারি বৃদ্ধির পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আরও বলা হয়েছে, ওই কাশির সিরাপগুলির নির্দিষ্ট কিছু ব্যাচে দূষিত পদার্থের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে। সেই সব ব্যাচের ওষুধগুলির ব্যবহার বন্ধের পরামর্শও দেওয়া হয়েছে।
সম্প্রতি মধ্যপ্রদেশের ছিন্দওয়াড়ায় বেশ কয়েক জন শিশুর মৃত্যু ঘিরে প্রশ্ন উঠেছে। কাশির ‘বিষাক্ত’ সিরাপ খাওয়ার ফলেই তাদের কিডনি বিকল হয়ে মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ। শুধু মধ্যপ্রদেশ নয়, রাজস্থানেও একই কারণে কয়েকটি শিশুর মৃত্যু ঘটে বলে অভিযোগ। তার পরেই একে একে দেশের বেশ কয়েকটি রাজ্য ‘বিতর্কিত’ কাশির সিরাপ নিষিদ্ধ করেছে। এই নিয়ে বিতর্ক দানা বাঁধতেই নড়েচড়ে বসে হু। শিশুমৃত্যুর সঙ্গে নাম জড়ানো কোনও কাশির সিরাপ বিদেশে রফতানি হয়েছে কি না, তা দিল্লির থেকে জানতে চেয়েছিল তারা। তার জবাবে কেন্দ্রীয় ওষুধ নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘ড্রাগস কন্ট্রোলার জেনারেল অফ ইন্ডিয়া’ (ডিসিজিআই) হু-কে জানিয়েছে, ভারত থেকে কোনও দূষিত কাশির সিরাপ রফতানি করা হয়নি। শুধু তা-ই নয়, অবৈধ ভাবে কোনও রফতানিরও প্রমাণ নেই। হু তার সতর্কবার্তায় সেই কথাও উল্লেখ করেছে।ডিসিজিআই রফতানি নিয়ে তথ্য দেওয়ার পরেও হু সকলকে সতর্ক থাকতে বলেছে। দেশের ওষুধ সরবরাহ বাজারগুলি এবং বিপণী শৃঙ্খলের উপর নজরদারি চালানোর পক্ষেই সওয়াল করেছে হু। অসুস্থদের সুরক্ষার কথা মাথায় রেখে দূষিত কাশির সিরাপ শনাক্ত করা এবং তার বিপণন বন্ধের উপর জোর দেওয়া উচিত।কাশির ‘বিষাক্ত’ সিরাপের বিষয়ে নিরপেক্ষ তদন্তের দাবিতে ইতিমধ্যে কেন্দ্রকে চিঠি পাঠিয়েছে চিকিৎসক সংগঠন ‘ফেডারেশন অফ অল ইন্ডিয়া মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন’। বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করে তদন্তের দাবিতে কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জেপি নড্ডাকে চিঠি লিখেছেন তাঁরা। কাশির সিরাপ বিতর্কে সিবিআই তদন্তের আর্জিতে ইতিমধ্যে সুপ্রিম কোর্টে একটি মামলাও দায়ের হয়েছে।
পাশাপাশি, বিতর্কিত কাশির সিরাপ ‘কোল্ডরিফ’ প্রস্তুতকারক সংস্থা স্রেসান ফার্মাসিউটিক্যাল্স-এর যোগসূত্র ধরে তামিলনাড়ুর একাধিক জায়গায় অভিযানও করে কেন্দ্রীয় সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। স্রেসান ফার্মার মালিক জি রঙ্গনাথনকে গ্রেফতারও করেছে পুলিশ। ওই সংস্থার কাশির সিরাপটির নমুনা পরীক্ষা করে দেখা গিয়েছে, কোল্ডরিফে ৪৮.৬ শতাংশ ডাই-ইথাইল গ্লাইকল (ডিইজি) ছিল, যেখানে অনুমোদিত সীমা মাত্র ০.১ শতাংশ। ডিইজি একটি ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ, যা কিডনি বিকল করে দিতে পারে। লিভার এবং স্নায়ুতন্ত্রেরও মারাত্মক ক্ষতি করতে পারে।বহু সিরাপেই প্রোপিলিন গ্লাইকল দ্রাবক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যৌগটিকে আবার শিল্পক্ষেত্রেও বিভিন্ন কাজে লাগানো হয়, যাতে উচ্চমাত্রার ডাইইথিলিন গ্লাইকল থাকতে পারে। অন্য দিকে, ওষুধে ব্যবহৃত প্রোপিলিন গ্লাইকলে দূষণকারী পদার্থের মাত্রা অনুমোদিত সীমার নীচে থাকে। যখন শিল্প স্তরের প্রোপিলিন গ্লাইকল ওষুধ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়, অথবা সংশ্লিষ্ট ওষুধ সংস্থা ব্যবহারের আগে দূষণকারী পদার্থের জন্য কাঁচামাল সঠিক ভাবে পরীক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, তখন ডিইজি সিরাপ দূষিত করে ফেলে। সে ক্ষেত্রে এটি মানুষের জন্য বিষাক্ত হয়ে ওঠে। দূষিত কাশির সিরাপ ভারত তো বটেই, দেশের বাইরেও প্রাণ কেড়েছে। ২০২০ সালে জম্মু ও কাশ্মীরের রামনগরে হিমাচল প্রদেশের একটি কোম্পানির তৈরি কাশির সিরাপ খেয়ে কমপক্ষে ১৭ জন শিশুর মৃত্যু হয়েছিল। শুধু তা-ই নয়, ২০২২ এবং ২০২৩ সালে ভারতে তৈরি দূষিত কাশির সিরাপে শতাধিক শিশুর প্রাণহানি হয় গাম্বিয়া, উজ়বেকিস্তান এবং ক্যামেরুনে; সে সময় বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ভারতে তৈরি কাফ সিরাপ সম্পর্কে বিশ্ব জুড়ে একাধিক সতর্কতা জারি করেছিল। তাতে যে পরিস্থিতি পাল্টায়নি, তার প্রমাণ মিলল।সাম্প্রতিক কালে ভারতের ওষুধ শিল্প নিজেকে ‘বিশ্বের ফার্মেসি’ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। তার নিয়ন্ত্রক ব্যবস্থাপনা কিন্তু সে কথা বলে না। জানা গিয়েছে যে, ভারতের অনেক ছোট ওষুধ উৎপাদন সংস্থাই সংশোধিত গুড ম্যানুফ্যাকচারিং প্র্যাকটিস (জিএমপি)-এর অধীনে নিজেদের নিবন্ধিত করেনি। সেই সঙ্গে বহু ক্ষেত্রে বিদ্যমান পরীক্ষা ব্যবস্থাগুলিও অনিয়মিত এবং ভরসাজনক নয় বলে প্রমাণিত হয়েছে। এতে শুধু নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার দুর্বলতাই নয়, নিরাপদ প্রক্রিয়ায় বিনিয়োগে সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলির অনীহার বিষয়টিও প্রকট হয়ে ওঠে। সরকারের ভুলে যাওয়া উচিত নয়, দেশের ওষুধ শিল্পের সাফল্য শুধু সস্তা জেনেরিক ওষুধ উৎপাদনের উপরে নির্ভর করে না, তা দেশে উৎপাদিত ওষুধের বিশ্বাসযোগ্যতার দ্বারাও সমর্থিত হওয়া প্রয়োজন। নচেৎ, এই ধরনের দুর্ঘটনা জনসাধারণের আস্থা নষ্ট করে— যা যে কোনও ওষুধের সাফল্যের অন্যতম উপাদান। মানুষের জীবন-মরণের বিষয় যেখানে জড়িয়ে, সেখানে ন্যূনতম গাফিলতিটুকুও চলে কি?মধ্যপ্রদেশ এবং রাজস্থানে দূষিত কাশির সিরাপের কারণে ২০ জনেরও বেশি শিশুর মৃত্যু আরও এক বার দেখিয়ে দিল যে, ওষুধের গুণমানে ত্রুটি কী ভাবে অতি সাধারণ চিকিৎসাকেও মারাত্মক ঝুঁকিতে পরিণত করতে পারে। জানা যায়, তামিলনাড়ুর একটি সংস্থার উৎপাদিত ওই কাশির সিরাপে ৪৮.৬% ডাইইথিলিন গ্লাইকল (ডিইজি) ছিল, যেখানে সেটির অনুমোদিত সীমা ০.১ শতাংশেরও কম। এর পরই রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ-সহ আরও বেশ কয়েকটি রাজ্যে এই ওষুধ নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। বাজারে ওষুধ ছাড়ার আগে সেগুলির গুণমান পরীক্ষা করা হচ্ছে কি না, তার উপর নজর রাখার বিষয়ে সব রাজ্য এবং কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে জারি হয়েছে সতর্কতা। অন্য দিকে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও দিল্লির কাছে জানতে চেয়েছে যে, সাম্প্রতিক মৃত্যুর সঙ্গে যুক্ত কাশির সিরাপগুলি অন্য দেশে রফতানি করা হয়েছে কি না। উল্লেখ্য, চার বছরের নীচে শিশুদের ক্ষেত্রে কাশি ও ঠান্ডা লাগার ওষুধ দেওয়া অনুমোদিত না হওয়া সত্ত্বেও মধ্যপ্রদেশে মৃত শিশুদের মধ্যে একাধিকের বয়স তার কম।কাশির সিরাপ খেয়ে পর পর শিশুমৃত্যুর ঘটনার পর আতঙ্ক অনেকটাই বেড়েছে। চিকিৎসকেরা সতর্ক করে জানাচ্ছেন, ২ বছরের কমবয়সিদের কাফ সিরাপ খাওয়ানো একেবারেই উচিত নয়। কিছু সময়ে চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন ছাড়াই সোজা দোকানে গিয়ে কাফ সিরাপ বেছে নিয়ে চলে আসেন অনেকে। তার লেবেলও হয়তো তাঁরা দেখেন না। অনেকেই জানেন না, কেন্দ্রীয় ড্রাগ নিরাময় সংস্থা চার বছরের কমবয়সিদের জন্য বিশেষ অ্যান্টি-কোল্ড ড্রাগ কম্বিনেশন এ দেশে নিষিদ্ধ করেছে।
তবে যাঁদের বাড়িতে কাশির সিরাপ রয়েছে, তাঁরা ব্যবহারের আগে অবশ্যই দেখে নেবেন সেগুলি নিরাপদ কি না। কেনার আগেও যাচাই করে নিতে হবে যে সিরাপটি কিনছেন, তা শিশুদের খাওয়ানো যাবে কি না। কাশির সিরাপ কেনার আগে অবশ্যই দেখে নেবেন–
১) ব্র্যান্ডের নাম : কোন ব্র্যান্ডের ওষুধ কিনছেন, সেটি দেখে নিতে হবে। যে কোম্পানির নামই শোনেননি, তাদের তৈরি কাশির সিরাপ না কেনাই ভাল। কেবলমাত্র দাম কম দেখেই কিনে ফেলবেন না। শিশুদের খাওয়াতে হলে একমাত্র নামী ও প্রতিষ্ঠিত ওষুধ প্রস্তুতকারক সংস্থার কাশির সিরাপই কিনতে হবে।
২) তৈরির ও মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার সময় : যে কোনও ওষুধ কেনার সময়েই এটি যাচাই করে নিতে হবে। ওষুধটি কবে তৈরি হয়েছে, তার মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার সময় অবশ্যই দেখে নেবেন।
৩) উপাদান : কাশির সিরাপটিতে কোন কোন উপাদান রয়েছে, তা অবশ্যই লেবেল থেকে পড়ে নিতে হবে। খেয়াল করবেন, সিরাপে প্রপিলিন গ্লাইকল আছে কি না। এই উপাদানটি শরীরের জন্য নিরাপদ। যে সিরাপে ডাইইথিলিন গ্লাইকল (ডিইজি), ইথিলিন গ্লাইকল (ইজি) বা কোডেইনের মতো উপাদান থাকবে, সেটি ভুলেও কিনবেন না। এই ধরনের রাসায়নিক বিষাক্ত, শিল্প-কারখানায় ব্যবহার করা হয়। রক্তে মিশলে লিভার-কিডনি বিকল হয়ে যেতে পারে।সিরাপে অ্যান্টিহিস্টামিন উপাদান থাকলে সেটিও শিশুর জন্য নিরাপদ নয়।
অ্যালকোহল বা কৃত্রিম চিনি মেশানো থাকলেও তা ক্ষতিকর। এই সব উপাদান আছে কি না, তা কেনার আগে দেখে নিতে হবে।কাশির সিরাপের লেবেলে যদি কোনও রকম দ্রাবকের নাম বা উপাদানের নাম না থাকে, তা হলে সেটি কিনবেন না।কয়েক রকম ফিক্সড ড্রাগ কম্বিনেশনের সিরাপ শিশুর জন্য নিরাপদ নয়। তাই কেনার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
৪) শংসাপত্র: কাশির সিরাপের গায়ে ‘হু-জিএমপি সার্টিফায়েড’ লেখা আছে কি না দেখে নেবেন। অথবা আইএসও চিহ্ন থাকবে। যদি দেখেন এসব কিছুই নেই, অথচ লোগো বা স্ট্যাপ আছে, তা হলে বুঝতে হবে সেই ওষুধে ভেজাল রয়েছে।
৫) ওষুধের লাইসেন্স : প্রতিটি সিরাপের ডিএল বা এমএফজি লাইসেন্স নম্বর থাকবে, যা রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোল অথরিটি নির্ধারণ করবে। এই নম্বর দেখলে বুঝতে হবে, ওষুধটির গুণমান যাচাই করা হয়েছে। তাই কেনার আগে লাইসেন্স নম্বর দেখে নেবেন।
৬) সংরক্ষণ সম্পর্কিত তথ্য: কাশির সিরাপ ভাল মানের কি না, তা বুঝতে আরও একটি বিষয় খেয়াল করতে হবে। সিরাপটি কী ভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে, তার তথ্য অবশ্যই লেখা থাকবে। যদি উল্লেখ না থাকে, তা হলে সেই ওষুধ না কেনাই ভাল।
৭) কিউআর কোড বা বারকোড: এখন বেশির ভাগ নামী ব্র্যান্ডের ওষুধের লেবেলেই কিউআর কোড বা বারকোড দেওয়া থাকে। সেটি স্ক্যান করলেই অফিশিয়াল ওয়েবসাইট খুলে যায় ও ওষুধ সম্পর্কিত যাবতীয় তথ্য সেখানে উল্লেখ করা থাকে। কেনার আগে এক বার সেই কোড স্ক্যান করে দেখে নেবেন। যদি দেখেন, কোনও ওয়েবসাইট খুলছে না বা ‘পেজ নট ফাউন্ড’ দেখাচ্ছে, তা হলে সাবধান হতে হবে।
কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক জানিয়েছে, ২ বছরের কমবয়সি শিশুদের কাশির ওষুধ না খাওয়ানোই ভাল। নির্দিষ্ট ডোজ়ের চেয়ে বেশি ওষুধ রক্তে মিশলে তা থেকে নানা ক্ষতির আশঙ্কা থেকেই যাবে। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, কাশি সারাতে কোনও কাজই করে না সিরাপ। কাশির বেগ সাময়িক ভাবে কমাতে পারে মাত্র। অনেক সময়েই বাবা-মা চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই সন্তানকে এই ধরনের কাশির সিরাপ খাইয়ে দেন। না বুঝে ওষুধ খাওয়ালে হিতে বিপরীত হওয়ার আশঙ্কা থেকেই যাবে।