বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে মুসলিমদের অবদান

প্রতীকী চিত্র

সুকান্ত পাল

যেকোনো ইতিহাসের ছাত্রই জানেন যে শিক্ষা- সাহিত্য-সংস্কৃতির বোধে বাঙালির মুসলমান সমাজ নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে বেশ সময় নিয়েছে। ধর্মীয় অনুশাসন এর ক্ষেত্র থেকে তাদের বেরিয়ে আসতে সময় লেগেছে অনেক। নতুন শিক্ষার আলোর প্রভায় নিজেদের আলোকিত না করে ব্রিটিশ ভারতের বাঙালি মুসলমান সমাজ সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ না করে নিজেদেরকে বঞ্চিত করে রেখেছিল। এই অবস্থা কাটি ওঠার জন্য অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন সমাজের অগ্রগণ্য ব্যক্তিরা। মীর মোশারফ হোসেন তাঁর আত্মজীবনীতে ( আমার জীবনী) লিখেছিলেন,”চার বৎসর চার মাস চারদিন পর আমার হাতে তাক্তি (হাতেখড়ি) হইয়াছিল। গ্রাম্য শিক্ষক মুন্সি ভিন্ন পাস করা মৌলবী আমাদের দেশে কেহ ছিল না।

বাঙ্গালা বিদ্যা গুরু মহাশয়ের পাঠশালায় সীমাবদ্ধ ছিল । পুণ্যের জন্য আরবি শিক্ষা। কোরআন শরীফ পড়ার নিয়ম। সে পাঠ বড়ই আশ্চর্য। অক্ষর পরিচয় হলেই কোরাণ শরীফ পড়ার নিয়ম। সে পড়া পড়িয়ে যাওয়া মাত্র, আরবি কোরআন শরীফের অর্থ কেহই আমাদের দেশে জানিতেন না। মুন্সি সাহেব বাঙ্গালার অক্ষর জানিতেন না। বাঙ্গালা বিদ্যাকেও নিতান্ত ঘৃণার চক্ষে দেখিতেন। আমার পূজনীয় পিতা একটি অক্ষরও লিখিতে পারিতে না।” এই পরিস্থিতি থেকে সমাজের অগ্রগামী চিন্তক মানুষরা এক নতুন দীপশিখা নিয়ে পথ হাঁটা শুরু করলেন। নিজেদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ বাংলায় অনুবাদ করার দাবি উঠলো । তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বাংলা ভাষার কবি আব্দুল হাকিম। সেলিনা হোসেন তাঁর প্রবন্ধ, বাঙালি মুসলমানের বাংলাভাষা চর্চা: অগ্রযাত্রার দীপশিখা তে লেখেন, ” কবি আব্দুল হাকিম এর রচিত গ্রন্থের নাম ‘নূরনামা’। এই বইয়ের শুরুতে একটি অধ্যায় আছে যার শিরোনাম ‘বাংলা ভাষার বিতর্ক’। এখানে লেখা হয়েছে,’ মধ্যযুগীয় মুসলিম কবিদের মধ্যে কয়েকজনের গ্রন্থ পাঠে জানা যায় যে, ধর্মীয় গ্রন্থ বঙ্গভাষা লিখিত হইবে কি না এই বিষয়ে একটি বিতর্কের উদ্ভব হয়েছিল। কবি সৈয়দ সুলতানের লেখায় প্রকাশ পায় যে, এক শ্রেণীর লোক ধর্মীয় গ্রন্থ বঙ্গভাষায় লেখার পক্ষপাতী ছিলেন না। কবি সৈয়দ সুলতান বঙ্গভাষার গ্রন্থ প্রণয়নের পক্ষে থাকিয়া যুক্তি দ্বারা বিরুদ্ধবাদীদের মত খন্ডন করিতে প্রয়াস পান। তিনি তাহার বিরুদ্ধবাদী দিগকে মুনাফিক আখ্যায় আখ্যায়িত করেছিলেন। ”
গোঁড়া হিন্দুত্ববাদীদের মতোই কিছু মুসলিম ব্যক্তিও ছিলেন — এটা সহজেই অনুমান করা যায় এবং এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সময় এবং সাধারণ মানুষের মানসিক চাহিদা,আবেগ ও আকাঙ্ক্ষার কাছে এই গোঁড়ামি চিরকালই পর্যুদস্ত হয়ে এসেছে। ইতিহাস তাই বলে। এই নিবন্ধের শেষ পর্যায়ে গিয়ে এই বক্তব্যই আমাদের কাছে আরো স্পষ্ট হয়ে উঠবে।


বাংলা ভূমি ও বাংলা ভাষার ইতিহাসে যদি একটু সামান্য দৃষ্টি নিক্ষেপ করা যায় তবে দেখা যায় যে একেবারে মধ্যযুগ থেকে ভারত বর্ষ বৃটিশের অধীনতা থেকে মুক্তিকাল (১৯৪৭) পর্যন্ত যে অঞ্চলটিকে বাংলা বা বাংলাদেশ নামে উল্লেখ করা হতো, এরকম কোনো রাজনৈতিক একত্ব বিশিষ্ট অঞ্চলের অস্তিত্ব প্রাচীনকালে ছিল না। সেই সময় থেকে এই অঞ্চলটি বিভিন্ন নামে পরিচিতি পরিচিত ছিল। যেমন পুন্ড্র, গৌড়, সুম্ম, রায়, তাম্রলিপ্তি,সমতট, হরিকেল, বঙ্গ প্রভৃতি নামের কিছু আলাদা আলাদা স্বতন্ত্র জনপদ। তখনো কিন্তু বাংলা ভাষা প্রাকৃত, মগধীপ্রাকৃত, অপভ্রংশ প্রভৃতির নানান রূপ পরিহার করে আমাদের বর্তমানের পরিচিত ভাষার রূপটি ধারণ করে উঠতে পারেনি।। এই ক্ষেত্রে আমরা নিহার রঞ্জন রায়ের “বাঙালির ইতিহাস “(আদিপর্ব )এর শরণাপন্ন হয়ে দেখি যে তিনি খুব স্পষ্ট ভাষায় লেখেন যে, এইসব পৃথক পৃথক প্রাচীন জনপদ গুলির ঐক্যবদ্ধ হওয়া হিন্দু আমলে ঘটে নি, তা ঘটল তথাকথিত পাঠান আমলে এবং পূর্ণ পরিণতি পেল আকবরের আমলে, যখন সমস্ত বাংলাদেশ সুবা বাংলা নামে পরিচিত হল যদিও প্রাচীন আরণ্যক রামায়ণ মহাভারত এবং পাল ও সেন যুগের বিভিন্ন লিপিতে ‘বঙ্গ’ শব্দের উল্লেখ পাওয়া যায়। সুকুমার সেনের মতে, “বাঙ্গালা নামটি মুসলমান অধিকার কালের গোড়ার দিকে চালিত হইয়াছিল। ফরাসী ” বাঙ্গালাহ্” হইতে পোর্তুগীজ Bengala ও ইংরেজী Bengal আসিয়াছে।”(বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস,৫ম খন্ড)। প্রকৃতপক্ষেই বাংলা ভাষা, ভাষা ও সাহিত্যের মর্যাদা অর্জন করে বাংলার মুসলিম শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায়। আমরা জানি যে রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া কোনো ভাষার ও সেই ভাষায় রচিত সাহিত্যের অগ্রগতি ঘটে না। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের নবপ্রভাত শুরু হয় বাংলায় মুসলিম শাসকদের আমলেই। তখনই রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রত্যক্ষ উৎসাহ দানে বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনা শুরু হয়।” তেরো ইসলাম শতকের শুরুতে বাংলায় মুসলিম অধিকারের আকস্মিক বিপর্যয় ও অনিশ্চয়তা কাটিয়ে উঠে চোদ্দো শতকের মাঝামাঝি বাংলার স্বাধীন সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহের সময় থেকে এদেশে শান্তি, সুস্থিতি ও সমৃদ্ধি বাড়তে থাকে। ইসলাম ধর্মের অভিঘাতে হিন্দু সমাজের উচ্চবর্ণ স্তর ও নিম্নবর্ন স্তর গুলির আচার-ব্যবহার গত দূরত্বও অনেক কমে। সুলতান রাও উপলব্ধি করেন যে দেশে সুশাসন রক্ষার জন্য দেশের মানুষের ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়া এবং তাদের সহযোগিতা লাভ করা বিশেষ প্রয়োজন। এই জন্য তারা দেশীয় সাহিত্যের উৎসাহদাতা ও পৃষ্ঠপোষক হন”।

এরফলে মুসলিম শাসনকালে রাষ্ট্রের উৎসাহ ও পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করে হিন্দুরা ব্রাহ্মণ্যবাদীদের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সংস্কৃতের বদলে বাংলা ভাষায় লিখিত সাহিত্য রচনার সাহস দেখাতে পারলেন। এদের মধ্যে মালাধর বসু ,কবীন্দ্র পরমেশ্বর, শ্রীকর নন্দী এমনকি ব্রাহ্মণ কৃত্তিবাসও ছিলেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য তার প্রথম থেকেই এই বঙ্গে হিন্দু-মুসলিমের এক যৌথ সাধনায় পরিপুষ্টি লাভের দিকে অগ্রসর হয়। বাংলা সাহিত্যের সূচনাকাল থেকে চন্ডীদাস কৃত্তিবাস কাশীরাম দাস এবং মঙ্গলকাব্যের কবিদের সমসাময়িক কালে কবি শাহ মুহাম্মদ সগীর, জৈনুদ্দিন থেকে শুরু করে আব্দুল হাকিম এবং আরাকান রাজসভার দৌলত কাজী সবাই ছিলেন।

হিন্দু মুসলিমের এক যৌথ সাধনার ফল বর্তমানের বাংলা ভাষা ও সাহিত্য। বর্তমানে বাংলা সাহিত্যের যে বিপুল ভান্ডারটি আমাদের চমৎকৃত করে তা যে হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের সাহিত্যিকদের এক ধর্মনিরপেক্ষ সাংস্কৃতিক চর্চার অবদান তা আমরা ভুলে যাই। উভয় সম্প্রদায়ের এক যৌথ সাধনার মধ্য দিয়েই সমগ্র পৃথিবীতে বাংলা সাহিত্য এক গৌরবোজ্জ্বল স্থান করে নিয়েছে।

কিন্তু অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়,” সমগ্র বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাস” নামক পুস্তকগুলিতে মুসলিম সাহিত্যিক ও ভাষার কারিগরদের নাম প্রায় উল্লেখ করাই হয় না। করলেও তা নামমাত্র। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ইতিহাসের রচয়িতাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের চেতনার দীনতা ও সংকীর্ণতাকেই যেমন প্রকাশ করে তেমনি বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সঠিক ইতিহাসটা থেকে যায় আড়ালে।