নতুন বিশ্বব্যবস্থার চালকের আসনে চিন

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ও জাপানের বিরুদ্ধে জয়ের ৮০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বুধবার ৩ সেপ্টেম্বর রাজধানী বেইজিংয়ে আয়োজিত এক কুচকাওয়াজে মহাসমারোহে নিজের সামরিক শক্তির প্রদর্শনী করেছে চিন। আকাশজুড়ে ৮০ হাজার সাদা পায়রা ও ৮০ হাজার রঙিন বেলুন। একমুহূর্তের জন্য হলেও পুরো আকাশই যেন বদলে দিল তারা। তিয়েনআনমেন স্কয়ারে সে সময় লম্বা রাস্তাজুড়ে ছিল সর্বাধুনিক মারণাস্ত্রের এক অভূতপূর্ব প্রদর্শনী। তার মধ্যে ছিল হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র, আন্তমহাদেশীয় পারমাণবিক বোমা, বিমান থেকে নিক্ষেপযোগ্য সাঁজোয়া গাড়ি, ডুবন্ত ড্রোন ও চালকবিহীন যুদ্ধবিমান।

এমন জাঁকজমকপূর্ণ সামরিক মহড়া দেখতে সমবেত হয়েছিলেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত রাষ্ট্রনায়কেরা। একবার তাঁদের দিকে, একবার ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে আত্মতৃপ্তি হাসি দিয়ে প্রেসিডেন্ট শি চিন পিং বললেন, ‘চিনা জাতি এক গর্বিত জাতি। কোনও স্বৈরশাসককেই সে ভয় করে না। আমরা নিজের দুই পায়ের ওপর শক্তভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে সক্ষম।’ এক সময়কার খুবই দরিদ্র ও পশ্চাৎপদ দেশ চিন ৭০ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ এক অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে। জাতীয়তাবাদী শক্তির সঙ্গে গৃহযুদ্ধের পর ১৯৪৯ সালের ১ অক্টোবর কমিউনিস্ট নেতা চেয়ারম্যান মাও জে দং গণপ্রজাতন্ত্রী চিন প্রতিষ্ঠার ঘোষণা করেছিলেন। তার পর থেকে গত সাত দশকে দেশটিতে বড় ধরনের রূপান্তর ঘটেছে। নজিরবিহীন সম্পদ অর্জন করেছে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে। চিন আজ শুধু এশিয়া মহাদেশেই নয়, সারা বিশ্বেও পরাক্রমশালী এক রাষ্ট্র।

হাজার হাজার মাইল দূরে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন ডিসির হোয়াইট হাউসে বসে তা নজরে রাখছিলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তিয়েনআনমেন স্কয়ারে অনুষ্ঠিত বিশাল এই কুচকাওয়াজ নিয়ে বিশেষ কিছু বলেননি ট্রাম্প। শুধু এটুকুই বলেছেন, ‘এটি ছিল খুবই, খুবই মনোমুগ্ধকর’। তবে চিনের বার্তা ট্রাম্প ও বিশ্বের কাছে স্পষ্টভাবেই পৌঁছেছে। বিশ্বে একটি নতুন ও ক্রমবর্ধমান ক্ষমতার কেন্দ্র এবং গত শতাব্দীর আমেরিকা সমর্থিত ব্যবস্থার একটি নতুন বিকল্প তৈরি হচ্ছে। ঘটনাটা হয়তো অন্য সময় হলে তেমন গুরুত্ব পেত না। কিন্তু কয়েক মাস ধরেই বাণিজ্য শুল্ক প্রশ্নে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের সঙ্গে চিন ও ভারতের দর-কষাকষি চলছে। ইউক্রেন প্রশ্নে রাশিয়ার সঙ্গে চলছে শান্তিআলোচনা।


ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিকট মিত্র, ‘কোয়াড’ নামে পরিচিত একটি আধা সামরিক জোটের সদস্য হিসেবে তারা কৌশলগত সম্পর্কে জড়িত। অন্যদিকে চিন ওয়াশিংটনের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যসঙ্গী। বাণিজ্যঘাটতি পূরণের দাবি তুলে চিন ও ভারতকে অতিরিক্ত আমদানি শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন। ট্রাম্পের ভয়ে কেঁপে ওঠার বদলে দুই দেশই জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের ধমকে তারা ভীত নয়। মার্কিন বুদ্ধিজীবীরাই বলছেন, ট্রাম্পের কারণেই একসময়ের বৈরী সম্পর্ক ভুলে সি ও মোদী হাতে হাত মিলিয়েছেন। তাঁদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন পুতিন। এই তিন বৃহৎ শক্তি মিলে গড়ে উঠেছে এক নতুন আঁতাত, যার লক্ষ্য বিশ্বজুড়ে আমেরিকার একাধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করা।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যে বিশ্বব্যবস্থা গড়ে ওঠে, তার কেন্দ্রে একসময় ছিল যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন। নব্বইয়ের দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর বিশ্বের একক অধিপতি হয়ে বসে যুক্তরাষ্ট্র। গত দুই দশকে একের পর এক যুদ্ধে জড়িয়ে আমেরিকা আন্তর্জাতিক স্তরে তার আধিপত্য হারিয়েছে। একই সময়ে অর্থনৈতিক ও সামরিক দিক দিয়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে চিন। একুশ শতকের গোড়া থেকেই বৈশ্বিক দক্ষিণকে সঙ্গে নিয়ে চিন একটি সমান্তরাল বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার পথে পায়ে পায়ে এগিয়েছে। ২০০৯ সালে গঠিত বহুজাতিক ব্রিকস (ব্রাজিল, ভারত, রাশিয়া, চিন ও দক্ষিণ আফ্রিকা) ছিল সেই পথে একটি বড় পদক্ষেপ। কিন্তু নতুন বিশ্বব্যবস্থার প্রথম ইটটি পাতা হয়েছিল আরও আগে। ২০০১ সালে গঠিত সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশন (এসসিও) ছিল সেই লক্ষ্যে প্রথম সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ।

মজার ব্যাপার হলো, চিন নয়, এমন একটি বিকল্প বিশ্বনেতৃত্বের কথা প্রথম প্রস্তাব করে রাশিয়া, নব্বই দশকের মাঝামাঝি। চিন, রাশিয়া ও ভারত নিয়ে গঠিত এমন একটি সম্ভাব্য জোট, যার নাম হবে ‘ত্রইকা’— সোজা বাংলায় তিনজন— সে প্রস্তাব করেছিলেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়েভগেনি প্রিমাকভ। তত দিনে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়েছে, তার জায়গা নেওয়ার চেষ্টা করছে রাশিয়া। প্রিমাকভ প্রস্তাব রেখেছিলেন , তিন দেশ একজোট হলে মার্কিন-নিয়ন্ত্রিত এক মেরুর বিশ্বের বদলে একটি বহুকৌণিক বা মাল্টিপোলার বিশ্ব
গঠন সম্ভব।

কৌশলগত ত্রিকোণ বা স্ট্র্যাটেজিক ট্রায়াঙ্গেল হিসেবে এই ত্রইকার লক্ষ্য হবে নিরাপত্তা, অর্থনীতি ও উন্নয়ন প্রশ্নে দেশ তিনটির কার্যক্রমের সমন্বয় প্রতিষ্ঠা। তবে কোনো আনুষ্ঠানিক সংগঠন হিসেবে তা কখনোই আত্মপ্রকাশ করেনি। আর আট বছর পরে গঠিত হলো ব্রিকস, যা এখন খোলামেলাভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের একক আধিপত্যের প্রতি একটি স্পষ্ট চ্যালেঞ্জ।

আমেরিকানরা বিশ্বকে শুধু তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতেই দেখে। তারা মনে করে ভবিষ্যতের ঘটনাপ্রবাহ যুক্তরাষ্ট্রের সিদ্ধান্ত বা পরিকল্পনা মতোই হবে। অথবা অন্যরা আমাদের মতোই চিন্তা করবে এমন ধারণা তাদের। এটা কৌশলগত আত্মমুগ্ধতা ছাড়া কিছুই না। সময় গড়িয়ে গেছে। আজকের চিন অনেক শক্তিশালী। ওয়াশিংটনের চোখে একক শক্তি হিসেবে তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চিন। সে লক্ষ্যেই তারা গড়ে তুলেছে একাধিক সামরিক আঁতাত, দেশটির চারধারে নির্মাণ করেছে দুই ডজনের বেশি সামরিক ঘাঁটি। অথচ সেই শুধু যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে পাল্লা দিতে সক্ষম নতুন আঁতাত ব্রিকস নয়, একটি নতুন বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলতে চায়। হালের তিয়ানজিন সম্মেলনে চিন তেমন বিশ্বব্যবস্থার একটি খসড়া নীলনকশা হাজির করল।

চিনা প্রেসিডেন্ট বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের বদলে একটি নতুন উন্নয়ন ব্যাংক প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবও করেছেন। প্রাথমিকভাবে এই ব্যাংকের জন্য মূলধন হিসেবে তিনি দুই বিলিয়ন চীনা মুদ্রা ইউয়ান দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এ ছাড়া আরও ১০ বিলিয়ন ইউয়ান দেওয়া হবে সদস্যরাষ্ট্রগুলোকে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ। ডলার, যা বর্তমানে বৈশ্বিক মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে থাকে, তার নিয়ন্ত্রণ এড়িয়ে একটি বিকল্প মুদ্রাব্যবস্থা চালুর কথা ব্রিকসের সদস্যরা অনেক আগে থেকেই বলে আসছে। তিয়ানজিন বৈঠকে চীনের প্রস্তাবিত নতুন উন্নয়ন ব্যাংকটিকে সেই লক্ষ্যে একটি প্রথম সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ।

সোজা কথায়, তিয়ানজিন বৈঠকে উপস্থিত নেতারা বলছেন, ডলারের মাতব্বরি আর নয়। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ঠিক এই ভয়টাই করছিলেন। দ্বিতীয় দফা ক্ষমতা গ্রহণের পর গত ২৫ জানুয়ারি ট্রুথ সোশ্যালে এক বার্তায় তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, ব্রিকসভুক্ত দেশগুলো যাতে ডলারের বিপরীতে কোনো বিকল্প মুদ্রা চালু না করে, তার স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দিতে হবে।

অন্যথায় তাদের প্রত্যেকের ওপর ১০০ শতাংশ হারে নতুন বাণিজ্য শুল্ক আরোপ করা হবে। তিয়ানজিন সম্মেলনে সি, পুতিন ও মোদির হাতে হাত মেলানো দেখে উদ্বিগ্ন ট্রাম্প ট্রুথ সোশ্যালে লিখেছেন, তাঁরা সবাই যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করছেন। চক্রান্ত অথবা অন্য যে নামেই ডাকি না কেন, চিনের নেতৃত্বে যে একটি বিকল্প বিশ্বব্যবস্থার সম্ভাবনা ক্রমে উজ্জ্বল হচ্ছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। একদিকে বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব হ্রাস পাচ্ছে, অন্যদিকে চিনের নেতৃত্ব বিস্তৃত হচ্ছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ নীতি নিয়ে পড়ে থাকায় একদিকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর বহুপক্ষীয় বিশ্বব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে ট্রাম্পের ঢালাও বাণিজ্যযুদ্ধ ও যুক্তরাষ্ট্রের খামখেয়ালি ব্যবহারে তিক্ত দেশগুলো চিনের ছাতার নিচে এক হওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে। চিনের নেতৃত্বে রাশিয়া, ভারত ও ব্রাজিলকে সঙ্গে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একতরফা আধিপত্যের বিরুদ্ধে একটি প্রতিরোধদেয়াল গড়ে উঠছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তিয়ানজিন ও বেইজিং থেকে আমরা সে বার্তাই পেয়েছি।