মুখ্যমন্ত্রীর অভয়বাণী

নিজস্ব চিত্র

স্বাগত ১৪৩২। দৈনিক স্টেটসম্যান সকলের সুখ ও সমৃদ্ধি কামনা করে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় বিদায় নেওয়া ১৪৩১ খুব ভাল গেল না। চৈত্রের শেষ দিনগুলিতে রাজ্যের দু-একটি জেলায় চরম অশান্তি দেখা গেল। কেন্দ্রের ওয়াকফ আইনের যে সংশোধন করে, তা অবিলম্বে বাতিল করার জন্য মুর্শিদাবাদ, মালদা এবং উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলায় পুলিশের সঙ্গে একদল বিক্ষোভকারীদের ব্যাপক সংঘর্ষে প্রচুর মানুষের খুব ক্ষতি হল, তাঁদের সম্পত্তি ধ্বংস হল এবং শেষ পর্যন্ত তাঁদের ঘরছাড়া হয়ে আশ্রয় শিবিরে এসে থাকতে হল।

সংঘর্ষের ব্যাপক রূপ নিল মুর্শিদাবাদ জেলার বিভিন্ন স্থানে— সামশেরগঞ্জ, সুতি, ধুলিয়ানে বিক্ষোভকারীরা পুলিশের ওপর আক্রমণ করতে পুলিশ নির্বিচারে লাঠি চালায় এবং পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে পুলিশ কয়েক রাউন্ড গুলিও চালায়। ফলে বেশ কয়েকজন আহত হন। পরিস্থিতি সামাল দিতে একমাত্র মুর্শিদাবাদ জেলাতেই ১৭ কোম্পানি আধা সামরিক বাহিনী নামাতে হয়। উল্লেখ্য, মুর্শিদাবাদেই ওয়াকফ সম্পত্তির পরিমাণ বেশি— তার বেশির ভাগ বেহাত হয়ে গেছে। সবচাইতে সংঘর্ষের ব্যাপক চেহারা নেয় ভাঙড়ে। সেখানে পুলিশের অনুমতি না নিয়েই বিধায়ক নৌশাদ সিদ্দিকির নেতৃত্বে বিরাট সংখ্যক মানুষ মিছিল বের করে।

বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ লাঠি চালায়। পুলিশের পাঁচটি বাইকে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়— পুলিশের প্রিজন ভ্যান উল্টে ফেলে তাতেও অগ্নিসংযোগ করে ধ্বংস করা হয়। প্রচুর সরকারি সম্পত্তি ধ্বংস হয়। তাই নতুন বছরের শুরুটা সুখের হল না। হল না আনন্দের।


বিক্ষোভকারীদের দাবি, অবিলম্বে সংশোধিত ওয়াকফ আইন বাতিল করতে হবে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যাঁরা ওয়াকফ আইনের বিরোধিতা করে পথে নেমে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন এবং পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ছেন, তাঁদের শান্ত থাকার অনুরোধ জানিয়ে অভয় দিয়েছেন কেন্দ্রীয় সরকারের সংশোধিত ওয়াকফ আইন পশ্চিমবঙ্গে লাগু হবে না। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর এই অভয়বাণী দেওয়া সত্ত্বেও, রাজ্যের নানা স্থানে বিশেষ করে মুর্শিদাবাদে একদল লোক হিংসার আশ্রয় নিয়ে পুলিশের সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। তিনি বলেন, ওয়াকফ আইনের সংশোধন কেন্দ্রীয় সরকার করেছ— এ ব্যাপারে রাজ্য সরকারের কোনও হাত নেই। এরপর মুখ্যমন্ত্রী বিক্ষোভকারীদের বলেন, আইন নিজের হাতে নিয়ে রাজ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবেন না। তিনি তাঁদের শান্ত থাকার উপদেশ দেন। তা সত্ত্বেও হিংসার ও অশান্তির খবর আসছে কোনও কোনও জেলা থেকে।

মুখ্যমন্ত্রী বলেন, পশ্চিমবঙ্গ শান্তির রাজ্য, সম্প্রীতির রাজ্য। এখানে সব ধর্মাবলম্বী লোক বাস করেন এবং তাঁরা বিনা বাধায় তাঁদের ধর্ম পালন করেন। সুতরং শান্তির রাজ্যে অশান্তি সৃষ্টি করলে নিজেদেরই অসুবিধে হবে। রাজ্য সরকার সংশোধিত ওয়াকফ আইনের বিরোধিতা করেছে। বিল পাশ হয়েছে— আইনে রূপান্তরিত হয়েছে। কিন্তু এই আইন রাজ্য সরকার চালু করবে না। তাই এই বিষয়টি নিয়ে অশান্তি সৃষ্টি না করার জন্য আবেদন জানানো হয়েছে। সরকারের তরফে বলা হয়েছে, মুর্শিাবাদ জেলায় প্রচুর সংখ্যায় মানুষের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে— তাঁদের ঘরবাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে। তাঁরা এখন পুলিশ প্রহরায় আশ্রয় শিবিরে দিন কাটাচ্ছেন। সরকার তাঁদের পাশেআছে এবং সবরকম সাহায্য দেবে। যাঁদের বাড়িঘর ধ্বংসকরা হয়েছে, তাঁদের বাড়ি নির্মাণে আর্থিক সহায়তা করা হবে।

এটা অবশ্য আশ্চর্যের, মুখ্যমন্ত্রীর সংশোধিত ওয়াকফআইন রাজ্যে লাগু না করার আশ্বাস দেওয়া সত্ত্বেও একদলমানুষ এই আইন বাতিলের দাবিতে বিক্ষোভ দেখাচ্ছে। যার ফলে নানা জায়গায় শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্নিত হচ্ছে। এর মধ্যে যে রাজনীতি ঢোকেনি, তা বলা যাবে না। রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল ভারতীয় জনতা পার্টির (বিজেপি) নেতারা অভিযোগ তুলেছেন, সরকার রাজ্যে এই ওয়াকফ আইন নিয়ে যে অশান্তি ও হিংসা ছড়াচ্ছে, তা দমন করতে ব্যর্থ হয়েছে।

আইনশৃঙ্খলার এই অবনতির জন্য বিজেপির নেতারা মুখ্যমন্ত্রীকে দায়ী করেছেন এবং বলেছেন, তিনি পুলিশমন্ত্রীও— তবে কেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। তৃণমূলের এক মুখপাত্র অভিযোগ করেছেন, বিএসএফের জওয়ানদের একাংশ বাংলাদেশি দুষ্কৃতীদের সীমান্ত দিয়ে ঢুকিয়ে দিয়ে আরও বড় রকমের অশান্তির সৃষ্টি করছে। বিএসএফের এক শীর্ষকর্তা এই অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, বিএসএফের জওয়ানরা পুলিশেরসঙ্গে সহযোগিতা করে অবস্থা নিয়ন্ত্রণে এনেছে। এখন উপদ্রুত এলাকাগুলি শান্ত, কিন্তু থমথমে। মুর্শিদাবাদে সাধারণ মানুষ এখনও ঘর থেকে বের হওয়ার সাহস পাচ্ছেন না। দোকানপাটও খুলছে না। সর্বত্র একটা ভয়ভীতির সঞ্চার হয়েছে। উপদ্রুত এলাকায় বিরোধী নেতারা যাওয়ার চেষ্টা করলেও পুলিশ তাদের যেতে দিচ্ছে না।

নতুন বছর— ১৪৩২ রাজ্যের মানুষের কল্যাণ হোক, তাঁদের জীবন সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের হোক এটাই আমাদের কামনা। পশ্চিমবঙ্গ শান্তির রাজ্য মুখ্যমন্ত্রী বললেও, মাঝেমাঝে বিরোধী দলগুলির নেতাদের বিশেষ করে বিজেপির উস্কানিমূলক কথাবার্তা মন্তব্য ও বিবৃতি অশান্তির ও হিংসার সহায়ক হয়। আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৬ সালে রাজ্যে সাধারণ নির্বাচন। তাই নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষকরে শাসক দলতৃণমূলের কাছে। শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতি, ছাব্বিশ হাজারের ওপর শিক্ষকদের চাকরি বাতিল হওয়া, এই সরকারকে চরম উদ্বেগের মধ্যে রেখেছে।