পূর্ব প্রকাশিতের পর
চল্লিশ বছরের কথা। অঠন্নী সামান্য পয়সা, এ-কথা কেউ বলেনি। কিন্তু ভাণ্ডারেকে এটা কিছুতেই বোঝানো গেল না যে তার দানের পাত্র দরবেশ নয়, স্বয়ং গুরুদেব।
ভাণ্ডারের ভুল ভাঙতে কতদিন লেগেছিল আশ্রম পুরাণ এ-বিষয়ে নীরব। কিন্তু সেটা এ স্থলে অবান্তর।
ইতিমধ্যে ভাণ্ডারে তার স্বরূপ প্রকাশ করছে। ছেলেরা অস্থির, মাস্টাররা জ্বালাতন, চতুর্দিকে পরত্রাহি আর্তরব।
হেড মাস্টার জগদানন্দবাবু এককালে রবীন্দ্রনাথের জমিদারী-সেরেস্তায় কাজ করেছিলেন। লেঠেল ঠ্যাঙানো ছিল তাঁর প্রধান কর্ম। তিনি পর্যন্ত এই দুঁদে ছেলের সামনে হার মেনে গুরুদেবকে জানালেন।
আশ্রম-স্মৃতি বলেন, গুরুদেব ভাণ্ডারেকে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, ‘হ্যাঁরে ভাণ্ডারে, এ কি কথা শুনি?’
ভাণ্ডারে চুপ।
গুরুদেব নাকি কাতর নয়নে বললেন, ‘হ্যাঁরে ভাণ্ডারে, শেষ পর্যন্ত তুই এসব আরম্ভ করলি? তোর মতো ভালো ছেলে আমি আজ পর্যন্ত দেখিনি। আর তুই এখন আরম্ভ করলি এমন সব জিনিস যার জন্য সক্কলের সামনে আমাকে মাথা নিচু করতে হচ্ছে। মনে আছে, তুই যখন প্রথম এলি তখন কি রকম ভালো ছেলে ছিলি? মনে নেই, তুই দান-খয়রাত পর্যন্ত করতিস? আমাকে পর্যন্ত তুই একটা পুরো আধুলি দিয়েছিলি। আজ পর্যন্ত কত ছাত্র এল গেল কেউ আমাকে একটি পয়সা দেয়নি। সেই আধুলিটি আমি কত যত্নে তুলে রেখেছি। দেখবি?’
……………
তার দু’এক বৎসরের পর আমি শান্তিনিকেতন আসি। মারাঠি সঙ্গীতজ্ঞ স্বর্গীয় ভীমরাও শাস্ত্রী তখন সকালবেলার বৈতালিক লীড করতেন। তার কিছুদিন পর শ্রীযুত অনাদি দস্তিদার। তারপর ভাণ্ডারে।
চল্লিশ বছর হয়ে গিয়েছে। এখনও যেন দেখতে পাই ছোকরা ভাণ্ডারে বৈতালিকে গাইছে, ‘এ দিন আজি কোন্ ঘরে গো / খুলে দিল দ্বার। / আজি প্রাতে সূর্য ওঠা / সফল হল কার।।’
শ্রীশ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব
ধর্মের ইতিহাসে দেখা যায়, কোনো সভ্য জাতির বিত্তশালী সম্ভ্রান্ত সম্প্রদায়ের মাতৃভাষা কিংবা অন্য কোনো বোধ্য ভাষাতে যদি ধর্মচর্চা না থাকে তবে সে সম্প্রদায় ক্রিয়া-কর্ম-পার্বণ নিয়েই মত্ত হয়। এই তত্ত্বটি ভারতবাসীর ক্ষেত্রে অধিকতর প্রযোজ্য। কারণ, তারা স্বভাবতঃ এবং ঐতিহ্যবশতঃ ধর্মানুরাগী। বোধ্য ভাষাতে সত্যধর্মের মূলস্বরূপ সম্বন্ধে কোনো নির্দেশ না থাকলে সে তখন সবকিছু হারাবার ভয়ে ধর্মের বহিরাচরণ অর্থাৎ তার খোলস ক্রিয়াকর্মকেই আঁকড়ে ধরে থাকে।
কলকাতা অর্বাচীন শহর। যে সব হিন্দু এ শহরের গোড়াপত্তন-কালে ইংরেজের সাহায্য করে বিত্তশালী হন, তাঁদের ভিতর সংস্কৃত ভাষার কোন চর্চা ছিল না। বাঙলা গদ্য তখনো জন্মলাভ করেনি। কাজেই মাতৃভাষার মাধ্যমে যে তাঁরা সত্যধর্মের সন্ধান পাবেন তারও কোন উপায় ছিল না। ওদিকে আবার বাঙালী ধর্মপ্রাণ। তাই সে তখন কলকাতা শহরে পাল-পার্বণে যা সমারোহ করলো তা দেখে অধিকতর বিত্তশালী শাসক ইংরেজ-সম্প্রদায় পর্যন্ত স্তম্ভিত হল। এর শেষ-রেশ ‘হুতোমে’ পাওয়া যায়।
জাতির উত্থান-পতনেও এ অবস্থা বার বার ঘটে থাকে। এবং সমগ্রভাবে বিচার করতে গেলে তাতে করে জাতির বিশেষ কোনো ক্ষতি হয় না। গরীব-দুঃখীর তথা সমগ্র সমাজের জন্য এর একটা অর্থনৈতিক মূল্য তো আছে বটেই তদুপরি এক যুগের অত্যধিক পাল-পার্বণের মোহকে পরবর্তী যুগের ঐকান্তিক ধ্যান-ধারণা অনেকখানি ক্ষতিপূরণ করে দেয়।
(ক্রমশ)