চতুরঙ্গ

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

পূর্ব প্রকাশিতর পর

এই প্রশ্নটি শুধিয়েছেন এক সরলচিত্ত, দিশেহারা সাধারণ লোক—সুইডেনের কাগজে।
উত্তরে আমরা বলি, কেন হবে না? এক কোটি বাঁদরকে যদি এক কোটি পিয়ানোর পাশে বসিয়ে দেওয়া হয়, এবং তারা যদি এক কোটি বংশপরম্পরা ওগুলোর উপর পিড়িং পাড়াং করে, তবে কি একদিন একবারের তরেও একটি মনোমোহিনী রাগিণী বাজানো হয়ে যাবে না? সেও তো অ্যাকসিডেন্ট।

আমার ব্যক্তিগত কোনো টীকা বা টিপ্পনী নেই। মডার্ন কবিতা পড়ে আমি বুঝি না, আমি রস পাই না। সে নিয়ে আমার কোনো খেদ নেই। পৃথিবীতে এতশত ভালো জিনিস রয়েছে যার রসাস্বাদন আমি এখনো করে উঠতে পারিনি যে, আমার ওগুলো না হলেও চলবে।


আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন
আমরা যারা বাল্যবয়স থেকে আচার্য ক্ষিতিমোহন সেনের স্নেহচ্ছায়ায় বড় হয়েছি এবং আশ্রমবাসী সকলেই যাঁকে সেদিন পর্যন্ত এখানকার সর্বজনপূজ্য আচার্যশ্রেষ্ঠরূপে পেয়ে সঙ্কটের সর্বশ্রেষ্ঠ কাণ্ডারী ও আনন্দের সর্বশ্রেষ্ঠ অধিকারী জেনে মনে মনে গভীর পরিতৃপ্তি অনুভব করতাম, আজ আমাদের শোক সবচেয়ে বেশি।

ভারতবর্ষের সর্বত্র এবং ভারতের বাইরে তাঁকে অসংখ্য লোক কত না ভিন্ন ভিন্ন রূপে দেখেছেন, তার ইয়ত্তা নেই। হয়ত তাঁদের অনেকেই আমাদের চেয়ে তাঁকে পূর্ণতররূপে দেখেছেন, কিন্তু আমাদের প্রত্যেকের এবং সমগ্রভাবে আশ্রমের সত্তাতে যে আঘাত লেগেছে তার কঠোরতা আজ এই প্রথম আমরা বুঝতে আরম্ভ করলুম। এতদিন আমাদের এমন একজন ছিলেন যিনি বিশ্বভারতীর কর্ম থেকে বিশ্রাম গ্রহণ করেছিলেন সত্য, কিন্তু তারপরও সেদিন পর্যন্ত তিনি আশ্রমবাসীদের সর্বাগ্রণীরূপে আমাদের মধ্যে ছিলেন। আশ্রমের দৈনন্দিন সমস্যাতে তাঁকে জড়িত করা হত না, কিন্তু তিনিই ছিলেন গুরুতর সমস্যাতে আমাদের সর্বোত্তম পথপ্রদর্শক।
এখানকার শিক্ষাভবনের (অর্থাৎ ইস্কুলের) শিক্ষকরূপে তিনি কর্মজীবন আরম্ভ করেন—স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ যে স্কুলের প্রধান শিক্রক সেখানে তাঁর এই কর্মভার গ্রহণ যে উভয়ের পক্ষেই পরম শ্লাঘার বিষয়, সে-কথা দু’জনেই জানতেন। পরবর্তীকালে উত্তর বিভাগ বা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে তিনি অধ্যাপক হলেন ও সর্বশেষে বিশ্বভারতী রাষ্ট্রের সঙ্গে সংযুক্ত হওয়ার পর তিনি উপাচার্যরূপে আশ্রম পরিচালনা করেন। ‘উপাচার্য’ শব্দ এখানে প্রয়োগ করাতে কেউ যেন ভুল না বোঝেন। এটি একটি রাষ্ট্রীয় অভিধা— বস্তুতঃ তিনি আচার্যোত্তম ছিলেন। আমি বলতে পারি, পৃথিবীর যে কোনো বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে প্রধান আচার্যরূপে পেলে ধন্য হত। এবং এই তাঁর একমাত্র কিংবা সর্বশ্রেষ্ঠ পরিচয় নয়।

বস্তুত এরকম বহুমুখী প্রতিভাবান ব্যক্তি সর্বদেশেই বিরল। কেউ তাঁকে জানেন সংস্কৃত শাস্ত্রের পণ্ডিতরূপে, কেউ মধ্যযুগীয় সন্তদের প্রচারকরূপে, কেউ রবীন্দ্রপ্রতিভার সম্যক্ রসজ্ঞ ও টীকাকাররূপে, কেউ চৈনিক-ভারতীয় বৌদ্ধধর্মের লুপ্ত গৌরব উদ্ধারার্থী গবেষকরূপে, কেউ বাউল-ফকীরের গূঢ় রহস্যাবৃত তত্ত্বজ্ঞানের উন্মোচকরূপে, কেউ শব্দতত্ত্বের অপার বারিধি অতিক্রমণরত সন্তরণকারীরূপে, কেউ সুখ-দুঃখের বৈদিকার্থে পুরোহিতরূপে, কেউ এই আশ্রমের অনুষ্ঠানাদিকে প্রাচীন ভারতীয় ঐতিহ্যানুযায়ী রূপ-দিবার জন্য উপযুক্ত মন্ত্র আহরণে রত ঋষিরূপে—আমরা তাঁকে চিনেছি গুরুরূপে।

(ক্রমশ)