চতুরঙ্গ

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

পূর্ব প্রকাশিতর পর

কলা জগতে ইংরেজের প্রধান সম্পদ তার থিয়েটার। শেকসপিয়রের মতো নাট্যকার নাকি পৃথিবীতে নেই। ইংরেজ বললে, ‘চালাও থিয়েটার।’ কিন্তু প্রশ্ন, কে করবে থিয়েটার?

ইতিমধ্যে বাঙালী বিলেত যেতে আরম্ভ করেছে। সেখানে একাধিক নেশার সঙ্গে সে থিয়েটারের নেশাটাও রপ্ত করে এল।
বাঙলাা গদ্য এবং পদ্য তখন দুইই বড় কাঁচা।


আর জনসাধারণের ভাষা? তারও মা-বাপ নেই। একদিকে শেষ মোগলের ফার্সী উর্দুর শেষ রেশ, অন্যদিকে সুতোনুটি-গোবিন্দপুরের ঐতিহ্যহীন স্ল্যাঙ—দুয়ে মিলে তার যা চেহারা সেটা কিছুদিন পরে পাওয়া যায় হুতোমের নকশায়। অন্যদিকে বিদ্যাসাগরের অতি ভদ্র অতি মার্জিত ভাষা।

এ-যুগের নাটকের ভাষা তাই শব্দতত্ত্বের স্বর্গভূমি। কিন্তু নাটকে যে স্বচ্ছন্দ ভাষার প্রয়োজন তার বড়ই অভাব। সব নাট্যকারই যেন ঠিক মানানসই ভাষাটির জন্য চতুর্দিকে হাতড়ে বেড়াচ্ছেন।

মাইকেলের পৌরাণিক নাট্যে বিদ্যাসাগরী ভাষা; তাঁর ‘একেই কি বলে সভ্যতা’তে কলকাতার স্ল্যাঙ; ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’তে গ্রামাঞ্চলের একাধিক ভাষা; এবং দীনবন্ধু মিত্রের ভাষাতে বিদ্যাসাগরী ও গ্রাম্য দুইই।
নীলদর্পণ সে-যুগের বাঙলার বেদনা প্রকাশ করেই যে বিখ্যাত হয়েছিল সন্দেহ নেই, কিন্তু আমার মনে হয়, বিদ্যাসাগরী ভাষা ও মুসলমান চাষার ভাষা এ-দুয়ের সম্মেলনও তার জন্য অনেকখানি দায়ী। অবশ্য শুধুমাত্র ভাষার বাহার যদি শুনতে চান তবে ‘বুড়ো শালিকের’ মতো নাটক হয় না। হিন্দু গৃহস্থ, হিন্দু চাকর, মুসলমান চাষা, চাষার বউ, হিন্দু দাসী—এদের সকলের আপন আপন ভাষার সূক্ষ্মতম পার্থক্য মাইকেল যে কী কৃতিত্বের সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন তার তুলনা বাঙলা সাহিত্যে কোথাও নেই। নাটক হিসেবে এ-বই উত্তম—সাহিত্য হিসেবে ভাষার বাজারে এ-বই কোহিনুর।

অবাঙালীর জন্য পার্শী থিয়েটার কবে প্রতিষ্ঠিত হয় আমি ঠিক জানিনে, কিন্তু বিস্তর বাঙালীও সেখানে যেত ও উর্দু-গুজরাতীতে মেশানো নাটক বুঝতে যে তাদের বিশেষ অসুবিধে হত না সে-তথ্য কিছু অজানা নয়। ‘ছি ছি এত্তা জঞ্জাল’ জাতীয় জনপ্রিয়, বাঙলা-উর্দুতে মেশানো খিচুড়ি ঠাট্টা ব্যাঙ্গের ভাষা কিছুটা হুতোম আর কিছুটা পার্শী থিয়েটারের কল্যাণে।

ইতিমধ্যে ভাষাসমস্যার অনেকখানি সমাধান হয়ে যায় বঙ্কিমের কল্যাণে। বঙ্কিমের ভাষানির্মাণে কোন্ কোন্ উপাদান আছে সেকথা আজ ইস্কুলের ছেলে পর্যন্ত জানে। ডি. এল. রায় শ্রেণী এর পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেন।
এইখানে এসে আমাদের সবাইকে—বিশেষ করে রবীন্দ্রশিষ্যদের একটু বিপদে পড়তে হয়। রবীন্দ্রনাথের চলতি ভাষা যে তাঁর ছোট গল্প উপন্যাসের মাধ্যমে আমাদের দৈনন্দিন কথা ভাষাকে প্রভাবান্বিত করেছে সে-কথা আমরা সবাই জানি, এবং তার প্রভাব যে আমাদের রঙ্গমঞ্চেও পড়েছে সেও প্রতি মুহূর্তে কানে বাজে। কিন্তু আমার মনে হয় তাঁর নাটকের ভাষা এত বেশি মার্জিত, এত বেশি সূক্ষ্ম যে নাট্যশালার আটপৌরে কাজ তা দিয়ে চালানা যায় না। তাই বোধহয় তাঁর নাটকের মূল্য সাহিত্য হিসাবে যত না সম্মান পেয়েছে এবং পাবে নাট্য হিসাবে ততখানি পায়নি, পাবে কি না সন্দেহ।

গোড়ার দিকে ফিলিমের কোনো দুশ্চিন্তা ছিল না। কারণ সে তখন ভাষণ না করে শোভা বর্ধন করতো। টকি আসার সঙ্গে সঙ্গে চিন্তাশীল চিত্রচালককেই মনস্থির করতে হল টকির ভাষা ও উচ্চারণ হবে কি? এ-মুশকিলের একটা অতি সহজ সমাধান আছে। শরৎবাবুর ‘নিষ্কৃতি’ করতে হলে তাঁর ডায়লগের ভাষা দিলেই হল। এর আর ভাবনা কি?

(ক্রমশ)