চতুরঙ্গ

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

পূর্ব প্রকাশিতর পর

তাই তিনি তাঁর নাটকে ব্রাহ্মণ আর রাজা ছাড়া আর সবাইকে দিয়ে কথা কওয়াতেন তখনকার দিনের চালু ভাষা প্রাকৃতে। আর শুধু কি তাই? রাজার সংস্কৃতে শোধানো প্রশ্নের উত্তর দাসী যখন প্রাকৃতে দিত তখন কালিদাস তার উত্তরের ভিতর রাজার প্রশ্নটি এমনভাবে জড়িয়ে দিতেন যে সংস্কৃত না-জানলেওলা শ্রোতাও দুই পক্ষের কথাই পরিষ্কার বুঝে যে,। দাসীর তুলনা দিয়েই যদি জিনিসটে বোঝাতে হয় তবে বলতে হবে, এ-যেন ‘বাঁদীকে ঠেঙিয়ে বিবিকে সোজা রাখার’ মতো রাজা এবং প্রজা উভয় দর্শককে সোজা রাখা।
তাই আমার দৃঢ় বিশ্বাস, কালিদাসের নাটক সর্বজনপ্রিয় ছিল।

তারপর প্রশ্ন উঠতে পারে, ঠিক মুসলমান আগমনের প্রাক্কালে জনসাধারণ কি কালিদাসের আমলের প্রাকৃত বুঝতো? এ প্রশ্নের উত্তর দেবার মতো এলেম আমার পেটে নেই। তবে তার একশ’ বছর পেরবার পূর্বেই আমীর খসরৌ যে-হিন্দী ব্যবহার করেছেন সে-হিন্দী অনেকটা ঐ প্রাকৃতের মতোই। এবং এখানে আরো একটি কথা আছে। জনসাধারণ ততদিনে কালিদাসের নাটক দেখে দেখে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে, এবং নিরক্ষর দর্শক একটা ফিলিম তিন বার দেখবার পর যে কতখানি মনে রাখতে পারে সে-কথা শিক্ষিত জন জানেন না। আমার এক চাকর (বস্তুত এই গণতন্ত্রের ইনকিলাবী যুগে ‘মনিব’ বলাই ভালো) পাড়াতে নয়া ছবি এলেই একটানা সাত দিন ধরে সেই ছবি দেখতে যেত। আমি অবাক হয়ে ভাবতুম, নাগাড়ে সাতদিন ধরে একই ছবি দেখে কি করে? পরে তার গুনগুনোনি থেকে বুঝলুম, ছবির চোদ্দখানা গানই সে রপ্ত করতে চায় এবং করে ফেলেছেও! অনেক হিন্দী গানের বিস্তর কথা না বুঝতে পেরেও! অবশ্য আমার এ-মন্তব্যে ভুল থাকতেও পারে। কারণ আমি এ-জীবনে তিনখানা হিন্দী ছবিও দেখিনি এবং অন্য কোনো পুণ্য করিনি বলে এই পুণ্যের জোরেই স্বর্গে যাবো বলে আশা রাখি। তবে বলা যায় না, সেখানে হয়ত হিন্দী ছবি দেখতে হবে! কারণ এক ইরানী কবি মহাপ্রলয়ের পরে যে শেষ বিচার হবে তার স্মরণে অনেকটা এই ভয়ই করেন,—


‘‘শেষ-বিচারেতে খুদার সমুখে দাঁড়াবো তো নিশ্চয়, / মানুষের মুখ আবার দেখিব! এইটুকু মোর ভয়।’’ ‘‘মরা ব্ রুজ-ই কিয়ামৎ গমী কি হস্ত ঈন্ অস্ত / কি রূ-ই মরদুমে আলম্ দু বারা বায়ত দীদ’’।

যদি প্রশ্ন শোধান সে কি করে হয়? —তুমি হিন্দী ফিলিম্ বর্জন করার পুণ্যে স্বর্গে গেলে; সেখানে আবার তোমাকে ঐ ‘মালই’ দেখতে হবে কেন? তবে উত্তরে নিবেদন, কামিনীকাঞ্চনসুরা বর্জন করার ফলে আপনি যখন স্বর্গে যাবেন তখন কি ইন্দ্রসভায় ঐ গুলোরই ছড়াছড়ি দেখতে পাবেন না?

তখন যদি আপনি এককোণে মুখ গুমড়ো করে বসে থাকেন তবে কি সেটা খুব ভালো দেখাবে?
থাক্। কোথা থেকে কোথা এসে পড়লুম! মূর্খকে চটালে এই তো বিপদ। আবোল-তাবোল বকে।

মোদ্দা কথা এই, পাঠান-মোগল যুগে নাট্যাভিনয় রাজানুকম্পা পেল না বলে আমরা এখনো তার খেসারতি ঢালছি। এবং দ্বিতীয় কথা— নাট্যে, ফিলিমে ভাষা জিনিসটাকে অবহেলা করলে ক্ষতি হয়। এমন কি যদিও বহু গুণী বলে থাকেন ‘সাইলেনস্ ভাঙলে তখন থেকে আজ পর্যন্ত যে-ভাষা সে বললে তারই দিকে এ-প্রবন্ধের নল চালনা।

সাতশ’ বছর পরে ইংরেজ আমলে হল ঠিক তার উল্টো।

(ক্রমশ)