চতুরঙ্গ

প্রতীকী চিত্র

পূর্ব প্রকাশিতর পর

এ-স্থলে কিন্তু আরেকটি বিষয় লক্ষ্য করা উচিত।
স্বরাজলাভের পর মৌলনা তাঁর জতীয়তাবাদ বিশ্ব-মানবের কল্যাণে নিয়োগ করেছিলেন। দেশ-পর্যটন মৌলনা অত্যন্ত অপছন্দ করতেন, কিন্তু বিশ্বজনের সঙ্গে সক্রিয় যোগ স্থাপনার জন্য তিনি কয়েক বৎসর পূর্বে পাকিস্তান ইরান হয়ে ইয়োরোপে যান—পূর্বে বহুবার বহু দেশে নিমন্ত্রিত হয়েও যাননি। এবং সবচেয়ে বড় কথা, জাতিসম্মেলন (ইউ.এন.ও.) এবং তার ভিন্ন ভিন্ন শাখার যে সব প্রতিনিধি ভারতে এসেছেন তাঁরা তাঁদের সর্বোত্তম সখারূপে চিনতে শিখলেন মৌলনা আজাদকে। তাঁরা আশ্চর্য হয়ে দেখলেন, যে মৌলনা ইংরেজের বিরুদ্ধে তিক্ততম লড়াই লড়েছেন আজীবন, তাঁর ভিতর সে তিক্ততা আর নেই। ইংরেজ হোক, মার্কিন হোক আর রুশই হোক, যে জন বিশ্বকল্যাণের জন্য অগ্রসর হয়, তার বহু দোষ থাকলেও সে আজাদের বন্ধুজন। এবং আরো আশ্চর্য! ইংরেজ দেখে মৌলনাইংরেজি না বলেও ইংরেজের মিত্র, রাশা দেখে, তারা ভাষা না জেনেও অন্যের তুলনায় মৌলনা রাশাকে চেনেন অনেক বেশী। তিনি তাদের সঙ্গে কথা বলতেন উর্দুতে, কিন্তু সেউর্দু তো উর্দু নয়, সে-উর্দু বিশ্বপ্রেমের সর্বজনীন ভাষা, কিংবা বলবো, বিশ্বপ্রেমের ভাষা উর্দুর মাধ্যমে স্বপ্রকাশ হল। একদা তিনি আরবী বর্জনকরে উর্দু গ্রহণ করেছিলেন; তখন তিনি উর্দু বর্জন করে অন্য এক ভাষা গ্রহণ করেছেন, যার নামকরণ এখনো হয়নি, কারণ সে ভাষাতে কথা বলতে আমরা এখনো শিখিনি।

অথচ তাঁর জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তাঁরই নির্দেশ অনুযায়ী চলতো তিনখানি ত্রৈমাসিক। প্রথমখানি আরবীতে—আরবভূমির সঙ্গে ভারতের সাংস্কৃতিক যোগসূত্র স্থাপনা ও প্রাচীন যোগ দৃঢ়তর করার জন্য; দ্বিতীয়খানা ফার্সীতে— ইরান ও আফগানিস্থানের জন্য; তৃতীয়খানা ইংরিজিতে— বৌদ্ধজগতের সঙ্গে যোগস্থাপনা করার জন্য (বৌদ্ধভূমি মাত্র এক কোণে একটি ভাষায় আশ্রিত নয় বলেতিনি মাধ্যমরূপে ইংরিজি গ্রহণ করেছিলেন।) এই তিনটি পত্রিকাই ইণ্ডিয়ান্ কাউন্সিল ফর কালচারালরিলেশনস দিল্লী থেকে প্রকাশিত হয় এবং মৌলনা ছিলেন তার প্রধান। শুধু প্রধান বললেই যথেষ্ট বলা হয় না— কোন্ দেশে ক’খানি পত্রিকা যাবে সেটুকু পর্যন্ত তাঁর নির্দেশানুযায়ী হত। আজ ভাবি, এ-সব কটি পত্রিকার নীতি নির্দেশ, মানরক্ষা, তাদের সামঞ্জস্য রক্ষা করতে পারে এমন সর্বগুণ মেশানো আরেক পণ্ডিত পাওয়া যাবে কোথায়? ভারতবর্ষের ভিতরে, বাইরে?


বস্তুত আসলে এ-লোকটি হৃদয় এবং মস্তিষ্কের অন্তস্তলে ছিলেন পণ্ডিত। স্বাধীন মক্কা ত্যাগ করে পরাধীন ভারতে না এলে তিনি যে রাজনীতির চতুঃসীমানায় যেতেন না, সে কথা আমি স্থির নিশ্চয় জানি। স্বাধীনতা লাভের পরও তিনি জ্ঞানমার্গেই ফিরে যেতেন কিন্তু দেশে তখন (এবং এখনো) উপযুক্ত লোকের অভাব। মৌলনা কখনো কর্তব্য অবহেলা করতে চাইতেন না। এমন কি যখন তাঁর বিরুদ্ধপক্ষ মুখর হয়ে উঠতেন, এবং আমরা ভাবতুম তিনি পদত্যাগ করলেই পারেন, তখনো তিনি কর্তব্যবোধের দায়েই আপন কাজ করে যেতেন— লোকনিন্দার তোয়াক্কা-পরোয়া না করে। পূর্বেই বলেছি, মাত্র একবার তিনি হিন্দী-ওলাদের কর্কশ-কণ্ঠে ব্যথিত হয়ে আপন কাহিনী নিবেদন করেছিলেন। এ-অবসরে আরেকটি ঘটনা মনে পড়লো। সেটা কিন্তু কিঞ্চিৎ হাস্যরসে মেশানো।

(ক্রমশ)