চতুরঙ্গ

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

পূর্ব প্রকাশিতর পর

তাই আরেক গুণী শেষ কথা বলেছেন, ‘স্বচ্ছতা, স্বচ্ছতা, পুনরপি স্বচ্ছতা।’
ফরাসী চটুলতা হয়ত অনেকেই অপছন্দ করতে পারেন কিন্তু ফরাসী স্বচ্ছতা বাঙলা ভাষা এবং সাহিত্য যদি আসতো তবে আর কিছু না হোক, আমাদের মনন সাহিত্য যে অনেকখানি লোকপ্রিয় হত সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। শ্রীযুক্ত সুধীন্দ্রনাথ দত্ত যদি আরো একটুখানি ফরাসী আওতায় আসতেন তবেই ঠিক বোঝা যেত তাঁর দেবার মতো সত্যিই কিছু ছিল কিনা। এ বিষয়ে বরঞ্চ বলবো, শ্রীযুত অন্নদাশঙ্করের অনেকখানি ফরাসিস্।
শব্দতত্ত্ব এবং ভাষাতাত্ত্বিকরা ঠিক ঠিক বলতে পারবেন কিন্তু সাধারণ পাঠক হিসাবে আমার নিবেদন, বাঙলা ভাষার উপর ফরাসী ভাষার (language) প্রায় কোনো প্রভাবই পড়েনি। বাঙলাতে ক’টি ফরাসী শব্দ ঢুকেছে, সে কথা পাঁচ আঙুলে গুনেই বলা যায়। অবশ্য এইটেই শেষ যুক্তি নয়; আমরা বাঙলাতে প্রচুর আরবী এবং ফার্সী শব্দ নিয়েছি বটে কিন্তু ঐ দুই ভাষার প্রভাব আমাদের উপরে প্রায় নেই। কিন্তু অন্য কোনো বাবদেও ফরাসী ভাষার প্রভাব বাঙলার উপর আমি বড় একটা পাইনি।

সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর। আমার ব্যক্তিগত দৃঢ়বিশ্বাস ইনি ফরাসী সাহিত্যের যতখানি চর্চা করেছেন ততখানি চর্চা বাঙলাদেশে তো কেউ করেনইনি, অল্প ইংরেজ জর্মন ইতালিয়ই—অর্থাৎ অ-ফরাসিস্—করেছে। ছোট গল্প, উপন্যাস, নাট্য, কবিতা, ভ্রমণ কাহিনী, কত বিচিত্র বস্তুই তিনি ফরাসী থেকে অনুবাদ করে বাঙলায় প্রচার করেছেন। এই যে ইংরিজি এবং ফরাসী পাশাপাশি জাতের ভাষা—সেই ইংরিজিতেই পিয়ের লোতির লেখা ‘ভারত ভ্রমণ’ অনুবাদ করতে গিয়ে ইংরেজ অনুবাদক হিমসিম খেয়ে গিয়েছেন, অথচ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের অনুবাদে মূল ফরাসী যে ঠিক ধরা পড়েছে তাই নয়, প্রাচ্য দেশীয় আবহাওয়া সম্পূর্ণ বজায় রয়েছে।


এই জ্যোতিরিন্দ্রের বাঙলা ভাষাতেও ফরাসী ভাষার কোনো প্রভাব দেখতে পাওয়া যায় না।
বরঞ্চ ফরাসী শৈলীর (style) প্রভাব বেশ কিছুটা আছে।

বাঙলা সাহিত্যের ঐতিহাসিকরা পাকাপাকিভাবে বলতে পারবেন, বাঙলার কোন্ লেখক সর্বপ্রথম ফরাসীর সঙ্গে বাঙলার যোগসূত্র স্থাপনা করেছিলেন; আমি শুধু সার্থক সাহিত্যিকদের কয়েকজনের কথাই তুলব।
মাইকেলের সার্থক সৃষ্টিমাত্রই গম্ভীর—সংস্কৃত এবং লাতিনের ক্লাসিকাল গুণের সঙ্গে তিনি তাঁর বীণার তার বেঁধে নিয়েছিলেন। ওদিকে তিনি আবার অতি উত্তম ফরাসী জানতেন—নূতন ভাষা তিনি যে কত তাড়াতাড়ি শিখতে পারতেন, সে কথা আজকের দিনের ভাষার ‘ব্যবসায়ী’রা কিছুতেই বিশ্বাস করবেন না—কিন্তু সে ‘রঙীলা ঘরানা’ তাঁর ভাষার উপর কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। তাই কিছুতেই বুঝে উঠতে পারিনে তিনি লা ফঁতেনের ধরনে ‘ফাবল্’ (ফেবল্) রচনা করলেন কেন? লা ফঁতেন তাঁর অনেক গল্প নিয়েছেন ঈশপের গম্ভীর গ্রীক থেকে, কিন্তু লিখেছেন অতি চটুল ফরাসী কায়দায়। অথচ তাঁরই অনুকরণে যখন মাইকেল বাঙলাতে ‘ফাবল্’ রচনা করছেন তখন তিনি গুরুগম্ভীর কণ্ঠে বলছেন, ‘রসাল কহিল উচ্চে স্বর্ণলতিকারে—’

দুই সুর একেবারে ভিন্ন। অথচ মাইকেলের প্রায় সব ক’টি ‘ফাবলের’ উৎস লা ফঁতেন।
প্রহসনেও তাই। ‘বুড়োঁ’ শালিকের ঘাড়ে রোঁ’র মূলে মলিয়ের। অথচ শৈলীতে গম্ভীর।
জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের কথা পূর্বেই নিবেদন করেছি।

(ক্রমশ)