পূর্ব প্রকাশিতর পর
বিরুদ্ধ দল শিক্ষা-দফতরের বিরুদ্ধে দুনিয়ার তাবৎ অভিযোগ-ফরিদায় জটল্লা করে শেষটায় বললে, ‘শিক্ষা-দফতরের দ্বারা কিছুই হবে না— তাদের মগজের বাক্সটি (ব্রেন-বক্সটি) একদম ফাঁপা।’
মৌলনা স্পর্শকাতর লোক—পণ্ডিতগণ সচরাচর তাই হন। উষ্মা প্রকাশ না করে তিনি কিন্তু দাঁড়ালেন হাস্যমুখে। বার কয়েক ডান হাত দিয়ে মাথার ডান দিকে চাপড়ে বললেন, ‘না জী, এখানে তো আছে, তারপর হাত নামিয়ে নিয়ে দীর্ঘ আগুল্ফলম্বিত আচকনের ডান পকেটে থাবড়া মারতে মারতে বললেন, ‘এখানে নেই ওখানে কিছুই নেই।’ অর্থাৎ মগজে মাল যথেষ্ট আছে, কিন্তু পকেটে কিছুই নেই। তারা আরো সরল অর্থ, কেবিনেট শিক্ষা-বিভাগকে যথেষ্ট পয়সা দেয় না।
পূর্বেই বলেছি, মৌলনা আসলে পণ্ডিত। কর্তবেরে তাড়নায় তিনি প্রবেশ করেছিলেন রাজনৈতিক মল্লভূমিতে অতি অনিচ্ছায়। তাঁর সে পাণ্ডিত্যের সঙ্গে পাঠকের পরিচয় করিয়ে দিতে আমার কুণ্ঠা বোধ হচ্ছে, কারণ তাঁর সে পাণ্ডিত্যসায়রে সন্তরণ করার মত শক্তি আমার নেই।
আরবী এবং সংস্কৃত জ্ঞানচর্চায় বহু সাদৃশ্য রয়েছে। তার প্রধান মিল, উভয় সাহিত্যের পণ্ডিতগণই অত্যন্ত বিনয়ী। কারো কোনো নূতন কিছু বলার হলে কোনো প্রাচীন ধর্মগ্রন্থের সাহায্যে তাঁরা সেটি প্রকাশ করেন। লোকমান্য টিলক গীতার ভাষ্য লিখে সপ্রমাণ করলেন, কর্মযোগই সর্বশ্রেষ্ঠ যোগ এবং এদেশ থেকে ইংরেজকে বিতাড়নই সর্বশ্রেষ্ঠ; মহাত্মা গান্ধী তাঁর গীতাভাষ্য দিয়েই প্রমাণ করতে চাইলেন যে অহিংসাই সর্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম, এবং শ্রীঅরবিন্দ গীতাপাঠ লিখে প্রমাণ করতে চাইলেন যে জ্ঞানযোগের দ্বারা চিত্তসংযম আত্মজয় করতে পারলেই স্বাধীনতালাভ অনিবার্য। মৌলনা আজাদ তাঁর কুরান ভাষ্য দিয়ে বিশ্ব মুসলিমকে মুক্ত করতে চাইলেন তার যুগ-যুগ সঞ্চিত অন্ধসংস্কার এবং ক্রিয়াকাণ্ডের সঙ্কীর্ণ গণ্ডা থেকে। এবং তারই সঙ্গে সঙ্গে অতি কৌশলে তিনি তাকে তার কর্তব্য কোন দিকে সেইটে সহজ সরল ভাষায় বুঝিয়ে দিলেন।
এ ভাষ্য তিনি অনায়াসেই আরবীতে লিখতে পারতেন, এবং আরবী ভাষার মাধ্যমে তিনি পাঠকসংখ্যা পেতেন উর্দুর তুলনায় অনেক, অনেক বেশী। দ্বিতীয়তঃ, কুরান আরবী ভাষায় লেখা, এবং তাবৎ বিশ্ব-মুসলিম আরবীতেই তার ভাষ্য লিখে আসছে (গীতার ভাষ্য যে রকম এক শতাব্দী পূর্বেও সংস্কৃতেই রচিত হয়েছে)। তৃতীয়তঃ, মুসলিম জাহানের কেন্দ্রভূমি মক্কার ভাষা আরবী। চতুর্থতঃ, সে ভূমি আজাদের জন্মস্থলে—আপন জন্মস্থলে যশ প্রতিষ্ঠা করতে চায় না কোন্ পণ্ডিত?
এ সমস্ত প্রলোভন উপেক্ষা করে মেলৈনা তাঁর তফ্সীর (ভাষ্য লিকলেন উর্দুতে। মক্কাতে জন্ম নিয়েছিল তাঁর দেহ, কিন্তু তাঁর চৈতন্য এবং হৃদয় গ্রহণ করেছিল তাঁর পিতৃ-পিতামহের ভূমি ভারতকে স্বদেশরূপে। তাই তিনি স্বদেশবাসীর জন্য তাঁর ভাষ্য লিখলেন উর্দুতে। (টিলকও ইচ্ছা করলে তাঁর ভাষ্য সংস্কৃতে লিখতে পারতেন, কিন্তু লিখেছিলেন মারাঠীতে)। পরবর্তী যুগে আজাদভাষ্য আরবীতে অনূদিত হয়, এবং তখন আরবভূমিতে সে ভাষ্যের যে জয়ধ্বনি উঠেছিল তা শুনে ভারতীয় মাত্রই না কী গর্ব, কী শ্লাঘা অনুভব করেছিল। পাকিস্তানীরাও এই পুস্তক নিয়ে গর্ব অনুভব করেন। তাঁরা পাকিস্তান যাবার সময় তাজমহল ফেলে যাওয়ার মত কিন্তু এ ভাষ্য পেলে ভারতে যাননি। ১৯০৭-এর পরও আজাদ ভাষ্য লাহোর শহরে লক্ষাধিক সংখ্যক ছাপা এবং বিক্রি হয়েছে।
পাণ্ডিত্য ও সাহিত্য সচরাচর একসঙ্গে দেখা যায় না। কিন্তু আমি ব্যক্তিগতভাবে মুগ্ধ হয়েছি মৌলনার সাহিত্য রসবোধে, সাহিত্যসৃষ্টি দেখে। মৌলনার সঙ্গে লোকমান্য টিলকের বহু সাদৃশ্য বর্তমান, কিন্তু টিলকের চরিত্রে ছিল দাঢ্য, মৌলনার চরিত্রে ছিল মাধুর্য। টিলককে যদি বলা হয় কট্টর কঠিন শৈব, তবে মৌলনাকে বলতে হয় মরমিয়া মধুর বৈষ্ণব। কারণ মেলৈনা ছিলেন সুফী অর্থাৎ ভক্ত, রহস্যবাদী (মিসটিক্)। তাঁর সাহিত্যের উৎস ছিল মাধুর্যে, এবং কে না জানে মধুর সর্বশ্রেষ্ঠ রস।
তাই তাঁর চেহারায় ছিল লাবণ্য, কুরাণ-ভাষ্যের মত পাণ্ডিত্যপূর্ণ পুস্তকে মাধুর্য, এবং তাঁর সে সরল সৌন্দর্যবোধ তার পরম প্রকাশ পেয়েছে তাঁর রম্য রচনাতে। উর্দুতে এরকম রচনা তো নেইই, বিশ্বসাহিত্যে এরকম সহৃদয় রসে ভরপুর লেখা খুঁজে পাইনে। তার সঙ্গে বাঙালী পাঠকের পরিচয় করিয়ে দেওয়া বর্তমান অক্ষম লেখকের সাধ্যাতীত।
(ক্রমশ)