চতুরঙ্গ

প্রতীকী চিত্র

পূর্ব প্রকাশিতর পর

পরমহংসদেব গণধর্ম স্বীকার করে তার চরম মূল্য দিলেন। সাকার উপাসনা গণধর্মের প্রধান লক্ষণ। বাঙালী সেই সাকারে পূজা করে প্রধানতঃ কালীরূপে। কালীমূর্তি দেখলে অ-হিন্দু রীতিমত ভয় পায়। পরমহংসদেব সেই কালীকে স্বীকার করলেন।

অথচ ‘দূরের কথা’ বিচার করলে আমার ক্ষুদ্র বুদ্ধি বলে, পরমহংসদেব আসলে বেদান্তবাদী। কর্ম, জ্ঞান, ভক্তি এ-তিন মার্গ তিনি অবস্থাভেদে একে ওকে বরণ করতে বলেছেন। কিন্তু সবকিছু বলার পর তিনি সর্বদাই বলেছেন, ‘কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত ব্রহ্ম ব্যতীত সব কিছু মিথ্যা বলে অনুভব করতে পারো নি, ততক্ষণ পর্যন্ত সাধনার সর্বোচ্চ স্তরে উঠতে পারবে না।’ ‘ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা’ বড় কঠিন পথ। জগৎ মিথ্যা হলে তুমিও মিথ্যা, যিনি বলেছেন তিনিও মিথ্যা, তাঁর কথাও স্বপ্নবৎ। বড় দূরের কথা।


‘কি রকম জানো, যেমন কর্পূর পোড়ালে কিছুই বাকী থাকে না। কাঠ পোড়ালে তবু ছাই বাকী থাকে। শেষ বিচারের পর সমাধি হয়। তখন ‘আমি‘, ‘তুমি’, ‘জগৎ’, এ সবের খবর থাকে না।’

অথচ গণধর্মে নেমে এসে এসে বলেছেন, ‘যিনি ব্রহ্ম, তিনিই কালী।’ যখন নিষ্ক্রিয়, তাঁকে ব্রহ্ম বলে কই। যখন সৃষ্টি, স্থিতি, প্রলয় এইসব কাজ করেন, তাঁকে শক্তি বলে কই। স্থির জল ব্রহ্মের উপমা। জল হেলছে দুলছে শক্তি বা কালীর উপমা। কালী ‘সাকার আকার নিরাকারা’। তোমাদের যদি নিরাকার বলে বিশ্বাস, কালীসে সেইরূপ চিন্তা করবে। আর একটি কথা—তোমার নিরাকার বলে যদি বিশ্বাস, দৃঢ় করে তাই বিশ্বাস করো, কিন্তু মতুয়ার বুদ্ধি (dogmatism) করো না। তাঁর সম্বন্ধে এমন কথা জোর করে বলো না যে, তিনি এই হতে পারেন, আর এই হতে পারেন না। বলো আমার বিশ্বাস তিনি নিরাকার, আর কত কি হতে পরেন তিনি জানেন। আমি জানি না, বুঝতে পারি না।’’

জনগণপূজ্য শক্তির সাকার সাধনা (‘পৌত্তলিকতা’ শব্দটা সর্বথা বর্জনীয়—এটাতে তাচ্ছিল্য এবং ব্যঙ্গের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত আছে। স্বীকার করে পরমহংসদেব তৎকালীন ধর্মজগতের ভারসাম্য আনয়ন করলেন বটে কিন্তু প্রশ্ন, জড়সাধনার অন্ধকার দিকটা কি তিনি লক্ষ্য করলেন না?

এইখানেই তাঁর বিশেষত্ব এবং মহত্ত্ব। এই সাকার-সাধনার পশ্চাতে যে জ্ঞেয়-অজ্ঞেয় ব্রহ্মের বিরাট মূর্তি অহরহ বিরাজমান, পরমহংসদেব বার বার সেদিকে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এই ভারসাম্যই ব্রহ্মজ্ঞানী কেশব সেন, বিজয়কৃষ্ণ এবং তাঁদের শিষ্যদের আকর্ষণ করতে পেরেছিল। তিনি যদি ‘মতুয়া’ কালীপূজক হতেন তবে তিনি পরমহংস হতেন না।

বস্তুতঃ একটি চরম সত্য আমাদের বার বার স্বীকার করা উচিত: যেখানেই যে কোনো মানুষ যে কোনো পন্থায় ভগবানের সন্ধান করেছে তাকেই সম্মান জানাতে হয়। এমন কি ক্ষুদ্র শিশু যখন সরস্বতীর দিকে তাকিয়ে তাঁর সাহায্য কামনা করে (হায়, কলকাতার সরস্বতীপূজার বাহ্যাড়ম্বর দেখে অনেকসময় মনে হয়, এরাই বুঝি এ যুগে দেবীর একমাত্র সাধক) সেই শ্রদ্ধাটিকেও মানতে হয়,— গাছের পাতা, জলের ফোঁটা যখন মানুষ মাথায় ঠেকায় তখন সে ঠেকানোরও বিলক্ষণ মূল্য আছে। গীতাতে এ সত্যটি অতি সরল ভাষায় বলা হয়েছে।

কিন্তু সাকার-নিরাকার নিয়ে আজ আর তর্ক করে লাভ কী? বাঙলাদেশে আজ আর ক’জন লোক নিরাকার পূজা করেন তার খবর বলা শক্ত— কারণ সে পূজা হয় গৃহকোণে, নির্জনে। আর কলকাতার বারোয়ারী সাকার পূজার যা আড়ম্বর, তা দেখে বাঙলার কত গুণীজ্ঞানী যে বিক্ষুব্ধ হন তার প্রকাশ খবরের কাগজে প্রতি বৎসর দেখি। এই মাত্র নিবেদন করেছি, এরও মূল্য আছে—তাই আমার এক জ্ঞানী বন্ধু বড় দুঃখে বলেছিলেন, ‘কিন্তু কি ভয়ঙ্কর স্ট্রেন করে এ স্থলে সে সত্যটি স্বীকার করি।’

সাকার নিরাকারের আধ্যাত্মিক মূল্য যা আছে তা আছে, কিন্তু এই দ্বন্দ্ব সমাধানের সামাজিক মূল্য কি?
হিন্দু, মুসলমান, খৃষ্টান, ব্রাহ্ম সকলেই বাঙালী সমাজে সমান অংশীদার। এঁদের ধর্মাচরণ যা-ই হোক না কেন, সমাজে তাঁরা মেলামেশা করেছেন অবাধে।

(ক্রমশ)