এক নিঃসঙ্গ নাগরিকের শতবর্ষ

ফাইল চিত্র

প্রবীর মজুমদার

ঋত্বিক ঘটক। নিজেকে যিনি বলতেন ভাঙা বুদ্ধিজীবী— ব্রোকেন ইনটেলেকচুয়াল। তিনি আসলে পরিচালক হতে সিনেমা বানাতেন না। সিনেমা বানাতেন মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য। নিজের বক্তব্য মানুষের কাছে পৌঁছতে। উল্কার মতোই জ্বলে উঠে ধুপ করে নিভে যাওয়া এক খ্যাপা শিল্পস্রষ্টা ঋত্বিক ঘটক। তাঁর সৃজনশীলতার সূচনা করেন কবি এবং গল্প লেখক হিসেবেই। এরপর তিনি মঞ্চের সাথে যুক্ত হোন আর ধীরে ধীরে গণনাট্য সংঘের সাথে জড়িয়ে পড়েন। সেখানই সেলুলয়েডের হাতছানি তাঁকে পেয়ে বসে। মাত্র ৫১ বছরের জীবদ্দশায় ঋত্বিক কুমার ঘটক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পেরেছিলেন ৮টি। স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র, তথ্যচিত্র এবং প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছিলেন সব মিলিয়ে ১০টি। আরও অনেকগুলো কাহিনীচিত্র, তথ্যচিত্রের কাজে হাত দিয়েও শেষ করতে পারেননি। এই হাতে গোনা কয়েকটি চলচ্চিত্র দিয়েই বিশ্বের শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রকারদের কাতারে নিজের স্থান করে নিয়েছিলেন তিনি।

নিতান্তই স্বল্পসংখ্যক ছবি করে নিজের সামগ্রিক নির্মাণকে তিনি এমন স্তরে তুলে নিয়ে গিয়েছিলেন, যা আজও বিস্ময়ের দিগন্ত বিস্তৃত দরজা খুলে দেয় চকিতে। যেন নতজানু করে রাখে এক মহাজগতের কথকতার সামনে। তাঁর ছবি নিয়ে যত কথা হয়, তত কথা কি হয় তাঁর লেখা নাটক কিংবা ছোটগল্প নিয়ে? অথচ তিনি বলেছিলেন, ‘আমার কাছে মাধ্যমের কোনও মূল্য নেই। আমার কাছে বক্তব্যের মূ‌ল্য আছে।’


নিঃসঙ্গ নাগরিক ঋত্বিক কুমার ঘটক ২১ বছর বয়সে দেশ ভাগের কারণে পরিবারের সাথে পূর্ব বাংলা ছাড়তে বাধ্য হন। দাঙ্গা, মন্বন্তর, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, দেশভাগ তাঁকে বিপর্যস্ত করেছে। তাঁর কাজে দলিত মানুষের উপস্থিতি প্রবল। নিজ দেশত্যাগী, বাস্তুচ্যুত, ছিন্নমূল, দলছুট, নির্বাসিত জীবনের কথা বলে গেছেন গল্পে, মঞ্চের সংলাপে, সেলুলয়েডের ফিতায়।

তৎকালীন শিল্প-সংস্কৃতির সূতিকাগার কলকাতায় গমন যেমন ছিল অবধারিত তেমনি দেশভাগ, দাঙ্গা ও মাতা পিতা বিয়োগসহ বিভিন্ন কারণে পূর্বপুরুষের ভিটে পূর্ববাংলা ছেড়ে আসাটা একরকম বাধ্য হয়েই। কিন্তু আমৃত্যু তাঁর অধিকাংশ সৃষ্টিকর্মে এই মাটির প্রতি নিরন্তর ভালোবাসা ও পক্ষপাতের নিদর্শন রেখে গেছেন। তিনি বলেন, ‘আমার সমস্ত বাংলাকে ভালোবাসার মূল হচ্ছে পূর্ব বাংলা। নিজেদের ষোলআনা সুবিধের জন্য জোচ্চুরি দ্বারা যে দেশ ভাগ করা হলো, তার ফলে আমার মতো প্রচুর বাঙালি শেকড় হারিয়েছে। এ দুঃখ ভোলার নয়। আমার শিল্প তারই ভিত্তিতে।’

খ্যাপাটে এই মানুষটিকে দেখে বোঝার উপায় নেই তাঁর পারিবারিক কৌলীন্য। সৃষ্টিশীল এই মানুষটির জন্ম এক ধ্রুপদী পরিবারে। জন্ম ও বেড়ে ওঠা পূর্ববঙ্গেই। পাবনার ভারেঙ্গা গ্রামে ঋত্বিক ঘটকের মূল বাড়ি। পিতার কর্মসূত্রে ১৯২৫ সালের ৪ঠা নভেম্বর ঢাকার ঋষিকেশ দাস লেনের ঝুলন বাড়িতে জন্ম হয়েছিল দুটি যমজ ছেলেমেয়ের। এদের একজন পরবর্তী জীবনে স্বনামধন্য ঋত্বিক কুমার ঘটক। বাবা সুরেশ চন্দ্র ঘটক, মা ইন্দুবালা দেবী। ৯ ভাই বোনের মধ্যে ঋত্বিক ও প্রতীতি সবার কনিষ্ঠ। বাবা ঋত্বিককে আদর করে ডাকতেন ‘টেক বাহাদুর’ এবং ‘ভবা’। তাঁর স্কুলজীবন শুরু হয় ময়মনসিংহে, এরপর রাজশাহীতে শিক্ষা জীবনের অধিকাংশ সময় কাটান। মূলত এখানেই ঋত্বিকের ঋত্বিক হয়ে ওঠা।

ঋত্বিকের বড়দা মণীশ ঘটক ছিলেন কল্লোল যুগের নাম করা কবি। সেই সুবাদে বাড়িতে একটা সাহিত্যের পরিবেশ ছিল। শম্ভু মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য, গোপাল হালদার, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়রা বাড়িতে আসতেন। এখান থেকেই ‘নবান্ন’ নাটকের দিকে ঝুঁকলেন ও আইপিটিএ-র সদস্য হলেন। আজীবন শ্রমজীবী ও প্রান্তিক মানুষের জন্য লড়ে গেছেন কলম, মঞ্চ ও সেলুলয়েডকে হাতিয়ার করে। ছোটবেলা থেকেই বাঁশি বাজানো, ছবি আঁকা, গল্প লেখা ও অভিনয় নিয়ে মেতে থাকতেন। ১৯৪৩ সালে রাজশাহী গণগ্রন্থাগারে নাটক ‘অচলায়তন’ মঞ্চস্থ করেন। সেখানে থাকাকালীন রাজনীতিতে সরাসরি না জড়ালেও স্বদেশী আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন। সমাজে পরিবর্তন আনার জন্য লেখালেখি শুরু করেন, তখন প্রচুর গল্প লেখেন। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য— জ্বালা, চোখ, কমরেড, গাছ, আয়নান্ত, আকাশ গঙ্গা, দলিল, বিসর্জন ইত্যাদি। সেসময় তাঁর গল্প প্রকাশ হয় দেশ, অগ্রণী ও শনিবারের চিঠিতে। বেশিরভাগ গল্পেই এসেছে দেশভাগ, কাঁটাতার, দুই বাংলার বাস্তুচ্যুত মানুষের কথা। আছে প্রেম। কোনো কোনো গল্প নিছক কবিতাও। দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে না যাবার কারণে ঋত্বিক হয়ে গেলেন ভারতীয়। আজ বিশ্বময় ঋত্বিক ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে পরিচিত। কিন্তু তাঁর সৃষ্টি দেখলে বা পড়লেই বোঝা যায় ঋত্বিক কী?

সেই সময়ে নাটক ‘নবান্ন’ মঞ্চস্থ হল। ‘নবান্ন’ তাঁর সমস্ত জীবনধারা পাল্টে দিল। তিনি তখন নাটকের দিকে ঝুঁকে পড়েন। কিন্তু কোথাও যেন স্বস্তি মিলছে না। লক্ষ লক্ষ মানুষের কাছে যেতে হবে। যোগ দেন কলকাতার আইপিটিএ তে। শুরু করেন গণনাট্য আন্দোলন। যে কয়েকটি নাটকের জন্য ঋত্বিকের নাম নাট্য আন্দোলনে চিরদিনের জন্য জায়গা করে নিয়েছে তার একটি দেশভাগ ও উদ্বাস্তু জীবন নিয়ে নাটক ‘দলিল’। পাশাপাশি সেলুলয়েডকে হাতিয়ার করে শ্রেণীবৈষম্য ও বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন।

১৯৫২ সালে ‘নাগরিক’ সিনেমার কাজ শেষ হলেও তা তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের সরকারের হস্তক্ষেপে আলোর মুখ দেখেনি। বেকার যুবক রামুর ঘর বাঁধার স্বপ্নের ছবি ছিল ‘নাগরিক’। ঋত্বিকের যমজ বোন প্রতীতি দেবীকে সত্যজিৎ রায় এক অনুষ্ঠানে বারবার বলেছিলেন ‘তখন যদি ওই ছবি নাগরিক দেখানো হতো, তাহলে ঋত্বিকের আগে ভারতবর্ষে আর কারো নাম উচ্চারিত হতো না।’ বুক ভরা যন্ত্রণা নিয়ে ক্ষণজন্মা ঋত্বিক ঘটক ১৯৫২ সালে নিজের লেখা নাটক নিয়ে মুম্বাই পাড়ি দিলেন গণনাট্যের কনফারেন্সে। সেই সময় মুম্বাইতে বিমল রায়ের ‘মধুমতী’ ও হৃষিকেশ মুখোপাধ্যায়ের ‘মুসাফির’ এর চিত্রনাট্য লিখে তুমুল জনপ্রিয়তা লাভ করেন। কিন্তু শুধু পয়সা আর জনপ্রিয়তার জন্য দাঁতে দাঁত চেপে কাজ করা মোটে ও পছন্দ করতেন না। তাই সেসব ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন। ‘নাগরিক’ যন্ত্রণা তখনো তাঁকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে। হাত দিলেন পরের ছবি সুবোধ ঘোষের কাহিনি অবলম্বনে ‘অযান্ত্রিক’ সিনেমায়। চরিত্র বলতে ১৯২০ মডেলের সার্ভোলেট জালোপি ট্যাক্সি ‘জগদ্দল’ আর ট্যাক্সি ড্রাইভার ‘বিমল’। ছিন্নমূল মানুষের কলোনিতে ফের তাঁর ক্যামেরা ধরল ক্ষয়িষ্ণু জীবন। ‘অযান্ত্রিক’ মুক্তি পেল। উচ্ছ্বসিত দর্শক। জনপ্রিয় হলো। পরের সিনেমা শিবরাম চক্রবর্তীর ছোট গল্প অবলম্বনে ‘বাড়ি থেকে পালিয়ে’। এরপর একে একে তৈরি করলেন ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘কমলগান্ধার’, ‘সুবর্ণরেখা’। নাট্য আন্দোলন ও কমিউনিস্ট পার্টির অনেকের সাথে তাঁর মতবিরোধ দেখা দিল। অনেকে তাঁকে বয়কট করল। কিন্তু জীবনের কোনো স্তরে তিনি বিন্দুমাত্র আপোষ করেননি। ফলে হারিয়েছেন বন্ধু, সহকর্মী, কখনো বা পারিবারিক আশ্রয়। অর্থ, যশ, খ্যাতি তাঁকে কখনো প্রলুব্ধ করেনি। বরং তাচ্ছিল্যের সাথে এসব জাগতিক মোহ উড়িয়ে দিয়েছেন এক ফুঁৎকারে। স্বাধীন বাংলাদেশ গিয়ে করেন ‘তিতাস একটি নদীর নাম’। এই সিনেমাটি নিয়ে তাঁর আগ্রহ আর উচ্ছ্বাসের কমতি ছিল না। সবটুকু দরদ ঢেলে তিনি ছবিটি নির্মাণ করেছিলেন। বস্তুত স্বকীয় বৈশিষ্ট্যের অধিকারী যে কজন জীবনবাদী চলচ্চিত্রকারের সাধনায় বাংলা ছবি আজ গৌরবের আসনে অধিষ্ঠিত, তাঁদের প্রথম সারিতে রয়েছে তাঁর স্থান।

একান্ত নিজস্ব এক সিনেমা ভাষা ছিল ঋত্বিকের। ঋত্বিকের ছবি দেখলে মনে হয়, হলিউড বলে যেন কখনও কিছু ছিল না! নাটকীয় সংলাপ, চরিত্রদের মঞ্চ-নাটকীয় শরীরী ভাষা, উচ্চকিত অভিনয়, আপতিক ঘটনার অতিব্যবহার, এসব বৈশিষ্ট্য ওঁর ওপর গণনাট্যের দিনগুলোর প্রভাব ছাড়াও যা তুলে ধরে, তা হচ্ছে, পশ্চিমী সিনেমার প্রভাব বলয় থেকে নিজেকে সম্পূর্ণ মুক্ত রেখেছিলেন ঋত্বিক। আবার একই সঙ্গে ইউরো-মার্কিন সিনেমার সর্বশেষ চালচলন সম্পর্কে ঋত্বিকের মতো ওয়াকিবহাল পরিচালকই বা ভারতে ক’জন ছিলেন! ঋত্বিক ঘটক যখন পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের শিক্ষক তখন এ ব্যাপারে কুমার সাহনি, মণি কল বা আদুর গোপালকৃষ্ণনের কাছ থেকে শোনা নানা কথা সেই সাক্ষ্য দেয়। পশ্চিমী চলচ্চিত্রভাষাকে পরিহার করা তাই অজ্ঞতাপ্রসূত কিছু ছিল না। ঋত্বিকের দিক থেকে তা ছিল এক সচেতন প্রয়াসই। যাঁরা শিল্প-সংস্কৃতিতে উত্তর-উপনিবেশ বিষয়টি নিয়ে চর্চা করেন, ঋত্বিকের সিনেমা-শৈলীতে চিন্তার অনেক খোরাকই তাঁরা পাবেন। একটা প্রতিতুলনা টানা যায়। যেমন, আকিরা কুরোসাওয়া। তিনি যেমন জাপানি, আবার আন্তর্জাতিকও। কিন্তু য়াসুজিরো ওজু একান্তই জাপানি। ওজুকে সঠিক ভাবে বুঝতে জাপানি শিল্প-সংস্কৃতির ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা থাকতে হয়। ঋত্বিক ঘটকও যেন তেমনই আমাদের একান্তই বাঙালি এক শিল্পী যাঁর বিষয়বস্তু, গল্প বলার ধরন, বাংলা ভাষার নাটকীয় প্রকাশভঙ্গি অনুযায়ী নাটকীয় সংলাপ, বাংলা মঞ্চ-নাটকের ধারায় উচ্চকিত অভিনয়রীতি, এমন কী ওজুর লো ক্যামেরা অ্যাঙ্গেলের মতো নিজের আলাদা ক্যামেরা অ্যাঙ্গেল— ঋত্বিকের ছবির ওয়াইড অ্যাঙ্গেল লেন্সের শটগুলো স্মরণ করুন, এ সবই এক বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালকের একান্ত নিজস্ব চলচ্চিত্রভাষার প্রকাশ। তাই ঋত্বিকের শিল্প উৎসকে খুঁজতে হবে পশ্চিমী চলচ্চিত্রভাষায় নয়, সেটা খুঁজতে হবে বাংলার লোকজ ঐতিহ্য ও শিল্পমাধ্যমগুলোর মাঝে।

দেশভাগের বেদনার ভাষা কি আজও তৈরি হয়েছে? তবে ঋত্বিকের ছবি নিঃসন্দেহে বিষাদের সেই অতলান্ত গভীরতাকে ছুঁতে পেরেছে অনেক বারই। নিজে যন্ত্রণায় আকীর্ণ নীলকণ্ঠ এক একক শিল্পী হয়েও সমষ্টির প্রতিবাদী চেতনার প্রতি আস্থাটা ঋত্বিক অবিচল রেখেছিলেন আজীবন। ‘সুবর্ণরেখা’-তে জন্মভূমি থেকে উৎপাটিত হয়ে উদ্বাস্তু শিবিরে গড়ে তোলা হয়েছিল ‘নবজীবন কলোনী’। সে যৌথতার আদর্শ থেকে নিজের একক সুখের অন্বেষায় চলে যাওয়া ‘ঈশ্বর’ চরিত্রটার করুণ পরিণতি এবং পরবর্তী প্রজন্মের জন্যে তার নতুন বাড়ির সন্ধান, মানব জীবনের গোটা চক্রটাকেই যেন ধারণ করলেন ঋত্বিক। পালানোর পথ নেই। লড়াই করেই বাঁচতে হবে। অভিজ্ঞতার উপলব্ধি অপাপবিদ্ধ মননের কাছে কখনওই ধরা দেয় না। দেশভাগের আদিপাপের উপলব্ধি যখন সকল বাঙালির চেতনাকে স্পর্শ করবে, ঋত্বিক ঘটক নামের এই অসামান্য সিনেমা-শিল্পীর আজন্ম এষণা সেদিন সার্থক হবে। খণ্ডিত বাংলার প্রতীক এক বাংলা মাকে কল্পনা করে নিয়েছিলেন ঋত্বিক, যে মাতৃরূপটি ওঁর ছবিতে আদিমাতার এক রূপকল্প হয়ে ফিরে আসে বার বার। মার্কসবাদের পাশাপাশি ইয়ুং-এর যৌথ নিশ্চেতনার ধারণাও ততদিনে ঋত্বিকের বিশ্ববীক্ষায় গভীর ভাবে প্রোথিত হয়ে গিয়েছে। সেই আদিমাতার আবার দুই রূপ। কখনও দেখি তার কল্যাণী জগদ্ধাত্রী রূপ – ‘তিতাস একটি নদীর নাম’, কখনও বা ধ্বংসের কালী— ‘সুবর্ণরেখা’।

বাঙলার অজস্র নদীর ভিড়ে ঋত্বিক অবিভক্ত গঙ্গা-পদ্মা-মেঘনার সম্মিলিত রূপ। বিশ্বের আর কোন চলচ্চিত্র নির্মাতাকে এতো কাটখড় পোড়াতে হয়নি; আর্থিক টানাপোড়ানে সেলুলয়েড ফিতার সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয়নি। যতটা কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছেন আমাদের ঋত্বিক কুমার ঘটক। ছোটবেলা থেকেই ঋত্বিক অন্য ধাঁচের মানুষ ছিলেন। আর দশজন লোকের মতো তো ছিলেনই না, আর দশজন বিখ্যাত লোকের মতোও তিনি ছিলেন না। ছেলেবেলা থেকে আমৃত্যু জীবনকে তিনি নিজের মতো করে গড়েছেন, ভেঙেছেন, তারপর আবার নতুন করে গড়েছেন। ঋত্বিক রাজনীতি করেছেন। কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য ছিলেন। গণনাট্যের কর্মী ছিলেন। নাটক লিখেছেন, অভিনয় করেছেন। ঋত্বিক সাহিত্যিক ছিলেন – গল্প লিখেছেন, ছাত্রাবস্থায় ‘অভিধারা’ নামে একটি পত্রিকাও প্রকাশ করতেন। ভারতীয় চলচ্চিত্র এবং টেলিভিশন ইনস্টিটিউটে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে যোগ দেন এবং পরবর্তীতে ভাইস-প্রিন্সিপালও হন। কিন্তু সবকিছু ছাড়িয়ে তাঁর সবচেয়ে বড় পরিচয় তিনি সিনেমাওয়ালা, বাংলা এবং বাঙালির সিনেমাওয়ালা।

দেশভাগটা তিনি কখনোই মেনে নিতে পারেননি। কখনো যদি কেউ বলতো, আপনি তো ওপার বাংলার লোক তাই না? তখন ঋত্বিক ঘটক ক্ষেপে গিয়ে বলতেন, ‘বাংলার আবার এপার-ওপার হয় নাকি মশাই?’ তাঁর প্রথম নাটক ‘দলিল’। দেশভাগের সময় তিনি যে প্রচণ্ড আঘাত পেয়েছিলেন, এ নাটকে তা ভলো ভাবেই ফুটে ওঠে। নাটকটিতে একটি বিখ্যাত সংলাপ আছে, যা তিনি বাস্তব জীবনেও বলতেন, ‘বাংলারে কাটিবার পারিছ কিন্তু দিলটারে কাটিবার পারো নাই।’ ব্যক্তি জীবনে কখনো কখনো দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে অন্যমনস্ক হয়ে বলতেন, ‘আমিও কেমন রিফিউজি হয়ে গেলাম! দেশ ছাড়া এক রিফিউজি।’ ঋত্বিক ঘটকের স্ত্রী সুরমা ঘটক তাঁর লেখা ‘ঋত্বিক’ নামের বইতে স্মৃতিচারণ করেন এভাবে, ‘গেরুয়া পাঞ্জাবি পরা মানুষটির সাথে হাঁটতে হাঁটতে বহুদিন ওই রূপকথার দেশের বর্ণনা শুনেছি, শ্বশুরবাড়ির দেশে যাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি কিন্তু পদ্মা, হাওরবিল, কাশবন যেন দেখতে পেয়েছি।’

বাংলা ভাগের যন্ত্রণায় হতাশায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন ঋত্বিক, মদে আসক্ত হয়ে পড়েন ভীষণ ভাবে। যে মানুষটি জীবনের ৩৫ বছর পর্যন্ত মদের বোতলে হাত পর্যন্ত লাগাননি, এমনকি তাঁর চলচ্চিত্রের শ্যুটিংয়ে এবং এডিট স্পটে কেউ তাঁর ভয়ে মদের কথা উচ্চারণ পর্যন্ত করতে পারত না! অথচ মানুষটির এই অকালমৃত্যুর জন্য দায়ী এই মদ। আত্মধ্বংসী কিছু প্রবণতা ছিল ঋত্বিক ঘটকের মধ্যে। এই সব নিয়ে গালগল্পও কম হয়নি! কিন্তু ঋত্বিক ঘটকের ছবিগুলো নিয়ে গভীর মননশীল আলোচনা সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, আশিস রাজাধ্যক্ষ এরকম দু’একজন ব্যতিক্রমী গবেষকের কলমে ছাড়া খুব বেশি তেমন চোখে পড়ে না।

সাংসারিক জীবনে প্রচণ্ড উদাসীন ছিলেন। দায়বদ্ধতা ব্যাপারটি ঋত্বিক এড়িয়ে চলেছেন সব সময়। তাঁর স্ত্রী সুরমা ঘটক অনেক চেষ্টা করেছেন এ উদাসীনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে কিন্তু পারেননি। একটা সময় তিনি অনেকটা অভিমান আর ক্ষোভ নিয়ে চলে যান প্রত্যন্ত গ্রামে, স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি নিয়ে। মৃত্যুর সময় পাশে থাকতে পারেননি সুরমা ঘটক। পাশে ছিলেন বন্ধু বিখ্যাত চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেন। ঋত্বিক ঘটকের মৃত্যুর পর মৃণাল সেন সুরমা ঘটককে টেলিগ্রাম করেন, ‘Ritwik Ghatak expired’।

এক সময়ের খুব কাছের বন্ধুরা দূরে সরে গেলেন। ঋত্বিক ঘটক নামের একটি আগুন হয়তো তাঁরা সহ্য করতে পারেননি। অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির একনিষ্ঠ কর্মী ছিলেন। ‘এনারকিস্ট’ আখ্যা দিয়ে পার্টিও দূরত্ব বাড়ায় তাঁর সাথে। একে একে বাঁচার অবলম্বনগুলো হারাতে থাকা ঋত্বিক ঘটক এক সময় প্রচণ্ড মানসিক অবসাদে ভুগতে থাকেন। ১৯৬৯ সালে তাঁকে ভর্তি হতে হয় মানসিক রোগ নিরাময় কেন্দ্রে। সুস্থ হয়ে নতুন করে লড়াই শুরু করেন কিন্তু বিধাতা আর বেশি সময় দেননি। ১৯৭৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন এ কিংবদন্তি।
মাঝেমাঝেই বলতেন ‘মশাই আমার শত্রু অনেক। মাঝে মাঝে মনে হয় বাঁচব কী নিয়ে! চারিদিকে শুধু হতাশা, বিদ্বেষ, প্রতারণা, বঞ্চনা, যে প্রিয় বন্ধুদের নিয়ে মহা সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলাম একদিন, তাঁরা যে শুধু আমাকে নিরাশই করছেন তা নয়, তাঁরা আজ শত্রুতাই করছেন। আমি জানি আমার অপরাধের কথা। তবু ও একটা কথা জানিয়ে রাখি, আমি আজো মরে যাইনি। মরার আগে আমি প্রমাণ করে দিয়ে যাব আমার চারপাশের জনতার চাইতে আমি অন্য রকম।’

মৃত্যুর আগে একটুখানি ছায়ার আশায় ভবঘুরের মতো ছুটে বেরিয়েছেন মানুষের দ্বারে-দ্বারে। কি বন্ধু-বান্ধব, কি শুভাকাঙ্ক্ষী কারো ছায়াই পাননি তিনি। নিদারুণ অর্থকষ্টে জর্জরিত হয়েছেন। পাশে দাঁড়াননি কেউ, এড়িয়ে চলেছে সবাই। স্থিরতায় বিশ্বাস তাঁর কখনোই ছিল না; বদ্ধ জলার মতো এক জায়গায় আবদ্ধ না থেকে পাহাড়ি নদীর মতো লাফিয়ে চলার নীতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। অনেক ফিল্ম স্ক্রিপ্ট এবং নাটক লিখেছেন, যার একটা অংশ অপ্রকাশিতই থেকে গেছে বাণিজ্যিক ধারার চলচ্চিত্রের বিপরীতে পথচলায়।

সে সময় চলচ্চিত্র পাড়ার অনেকেই একবাক্যে স্বীকার করতো ঋত্বিক অনবদ্য-অপ্রতিরোধ্য এক আগুনের গোলা! কিন্তু কেউ তো এগিয়ে এলেন না ঝড়ো হাওয়া থেকে ঋত্বিককে বাঁচাতে! কালের গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া রুখতে! একটি প্রশ্ন তো থেকেই যায়, কারো একটু ছায়া পেলে আর কয়েক বছর কি বাঁচতেন ঋত্বিক ঘটক?
ঋত্বিক যে মানের নির্মাতা ছিলেন, তাঁর যোগ্য সন্মান সে সময় তিনি পাননি,তাই তো তাঁর সময়ের অনেক বাজে নির্মাতাও তাঁর থেকে বেশি পদক পেয়েছেন। কিন্তু ঋত্বিকরা যুগে যুগে একবারই জন্মান এবং তাঁরা পদক পাবার জন্য কাজ করেন না,তাঁরা নিজের মনের তাগিদে,সমাজের তাগিদে কাজ করে যান। কাজের মাধ্যমেই তাঁরা নিজেদের প্রমান করেন এবং মৃত্যুর পরেও কাজের মধ্যেই
বেঁচে থাকেন।