কোটিপতি আর আসামীতে ভরা বিহার বিধানসভা

প্রতীকী চিত্র

কুমারেশ চক্রবর্তী

সদ্য ঘোষিত বিহার বিধানসভার ফলাফল পর্যালোচনা করলে বহুবিধ অত্যাশ্চর্য বৈচিত্র্য চোখে পড়বে! সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য এবারের বিধানসভায় ৯০% কোটিপতি এবং অর্ধেকের বেশি হচ্ছে বাহুবলী, যার মধ্যে আবার ১০২ জন বিধায়কের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগে মামলা চলছে। ‘সুবিখ্যাত’ অনন্ত সিংহ তো জেলে বসেই জিতে গেলেন, আর এইসবের মধ্যেই গোবরে পদ্মফুলের মত ফুটে উঠলেন তরুণী লোকসঙ্গীতশিল্পী মৈথিলী ঠাকুর, যিনি এক প্রবীণ খ্যাতনামা রাজনীতিবিদকে হারিয়ে অবাক করে দিলেন শুধু নয়, তিনিই হলেন দেশের একমাত্র একবিংশ শতকে জন্ম হওয়া বিধায়ক, বয়স মাত্র ২৫।

বুথ ফেরত সমীক্ষার আগে পর্যন্ত সকলেই ধরে নিয়েছিলেন এবার অথর্ব অসুস্থ নীতীশকুমারের বিদায় আসন্ন এবং বিরোধী জোটের কাছে বিজেপির ভরাডুবি হবে। কিন্তু সবরকমের আশঙ্কা এবং সমীক্ষাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে নিতীশকুমার এবং তাঁর বিজেপি জোট প্রায় ২০০-র অধিক বিধায়ককে ঝুলিতে তুলে নিলেন। বিহার বিধানসভার মোট সদস্য সংখ্যা ২৪৩। ভোটের আগে থেকেই বিরোধীপক্ষ এমন কী বন্ধু বিজেপিও লাগাতার প্রচার শুরু করেছিল, নীতীশকুমার অসুস্থ, তিনি অথর্ব হয়ে পড়েছেন। এটা তাঁকে সরিয়ে মুখ্যমন্ত্রীর গদি নিষ্কণ্টক করার একটা রাজনৈতিক কৌশল। অথচ কেউ খেয়াল করলেন না মুখ্যমন্ত্রী নীতীশকুমার নির্বাচনে ৭১টি জনসভা করে ফেললেন। নেতারা খেয়াল না করলেও ভোটাররা বিষয়টাকে গুরুত্ব সহকারে মাথায় রেখেছিলেন।


বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ বিধানসভায় বাহুবলীর আধিক্য স্বাভাবিক। সেই ট্র্যাডিশন এবারও বজায় রেখেছে বিহার। এবার মোট নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে বাহুবলীর সংখ্যাই সর্বাধিক। সব দলের বাহুবলীরা জিতে গেছেন। অধিকাংশ বাহুবলীর মধ্যে ১০২ জন সদস্যের বিরুদ্ধে গুরুতর এবং মারাত্মক অভিযোগের মামলা চলছে। এর মধ্যে পাঁচজনের বিরুদ্ধে আছে খুনের অভিযোগ, ১৯ জনের বিরুদ্ধে আছে মহিলাদের ওপর অত্যাচারের অভিযোগ। যেমন, ধর্ষণ, যৌন অত্যাচার, শ্লীলতাহানি। দলগত বিচারে বিজেপির মোট সদস্যদের ৪৩ জনের বিরুদ্ধে খুন, অপহরণ প্রভৃতি ফৌজদারি মামলা রয়েছে। তারপরেই স্থান জেডিইউ দলের, এই দলের বিজয়ী সদস্যদের ২৩ জনের বিরুদ্ধে গুরুতর ফৌজদারি মামলা ঝুলছে। আরজেডি’র ১৪ জনের বিরুদ্ধে মারাত্মক অভিযোগের মামলা আছে। অ্যাসোসিয়েশন অফ ডেমোক্রেটিক রিফরমস অ্যান্ড ইলেকশন ওয়াচ-এর সূত্রে এই তথ্যগুলি পাওয়া গিয়েছে।

এবার নির্বাচন কমিশন মারফত বিহার বিধানসভার নির্বাচিত সদস্যদের আর্থিক সম্পদে একটু নজর দেওয়া যাক। ভারতের নির্বাচন আইন অনুসারে নির্বাচনে প্রার্থীদের স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তির পরিমাণ জানাতে হয়। হলফনামা মারফত নির্বাচন প্রার্থীদের আবেদন পত্রে তা লেখা হয়ে থাকে। সেই অনুসারে নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের কথাই এখানে বলছি। তবে এই তথ্যে প্রার্থীরা কতটা জল মিশিয়েছেন সেই প্রশ্নে যাচ্ছি না। কমিশনের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য অনুসারে এক কথায় বলা যায় যে, এবারে বিহার বিধানসভার নব্বই শতাংশ বিধায়ক হলেন কোটিপতি যা গত নির্বাচনের (২০২০) থেকে দশ শতাংশ বেশি। বিধানসভার ২৪৩ জনের মধ্যে ২১৮ জন বিধায়কের সম্পত্তি এক কোটি টাকার বেশি। গতবারে এই কোটিপতির সংখ্যা ছিল ১৯৪। সব বিধায়কদেরই গত পাঁচ বছরে সম্পত্তির পরিমাণ বেড়েছে কমপক্ষে দ্বিগুণ। গত ২০২০ বিধানসভার নির্বাচনে জয়ী প্রার্থীদের সম্পদের গড় পরিমাণ ছিল ৪.৩২ কোটি টাকা এবারে সেটা বেড়ে হয়েছে ৯.২ কোটি টাকা। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে বিহারে একবার বিধায়ক হতে পারলেই তার সম্পত্তির পরিমাণ গড়ে দ্বিগুণ হবেই। অনেক ওস্তাদ বিধায়কের সম্পত্তির পরিমাণ ১০/২০ গুণ বেড়ে গেছে। কারো কারো আবার জমি, বাড়ি, সোনা মিলিয়ে নামে বেনামে সম্পত্তির পরিমাণ ১০০ গুণ বেড়েছে।

এবার দেখা যাক, কোন দলে কত কোটিপতি জিতেছে? সেই অনুসারে দেখা যাচ্ছে নীতিশ কুমারের জেডিইউ, যাদের ৮৫ সদস্যের মধ্যে ৭৮ জন কোটিপতি। এরপরেই বিজেপি, এই দলের ৮৯ জন বিজয়ী সদস্যের মধ্যে ৭৭ জন কোটিপতি। তেজস্বী যাদবের আরজেডি দলের ২৫ জনের মধ্যে ২৪ জন, চিরাগ পাসোয়ানের এলএসপি দলের ১৯ জনের মধ্যে ১৬ জন, চেতনরামের হ্যাম পার্টির পাঁচজনের মধ্যে চারজন কোটিপতি। কংগ্রেসের বিজয়ী ছয় জনের মধ্যে ৬ জনই কোটিপতি, মিমের পাঁচের মধ্যে পাঁচ। রাষ্ট্রীয় লোক মোর্চার চারের মধ্যে চার, বামেদের তিন বিজয়ী সদস্যের মধ্যে দু’জন কোটিপতি। আর সবচেয়ে ধনী বিধায়ক মুঙ্গের থেকে নির্বাচিত মুঙ্গেশ কুমার। তাঁর মোট সম্পত্তির পরিমাণ ১০৭ কোটির বেশি, এরপরেই আছেন ডন অনন্ত সিংহ, তাঁর সম্পত্তির পরিমাণ ১০০ কোটির বেশি।

এবার বিহারের ‘স্বনামধন্য’ দুই বাহুবলীর গপ্পো একটু বলা যাক। তাঁরা হলেন নামকরা ডন মোহম্মদ শাহাবুদ্দিনের ছেলে ওসামা শাহাব, আর একজন হলেন বিহারের অনন্য বাহুবলী অনন্ত সিংহ, যাঁরা বিপুল ভোটে জিতেছেন। অনন্ত সিংহকে অনন্য ডন বলছি এই কারণে, অন্য কোনও বাহুবলীর সঙ্গে তাঁর তুলনা হয় না। অনন্ত সিংহ সাধারণত শাসক দলের সঙ্গেই থাকতে পছন্দ করেন এবং নিজের স্বার্থেই দল পরিবর্তন করেছেন বহুবার। যেমন, নীতিশকুমার ক্ষমতায় থাকার জন্য বারবার জোট পরিবর্তন করেন। তবে মজার ব্যাপার হচ্ছে যে, অনন্ত কোনও দলের দরজায় গিয়ে আবেদন নিবেদন করেন না, সব দলই তাঁর কাছে আসে। বিহারে সবাই মনে করে অনন্ত যেখানে, জয় সেখানে।

এইভাবেই তিনি বিহারের মোকামা থেকে বারবার জিতে আসছেন। মোকামায় সবাই বলে, এখানে অনন্তের সরকার চলছে। স্থানীয় মানুষের ভাষায় অনন্ত সিংহ হচ্ছেন ছোটে সরকার। মোকামায় ছোটে সরকার যা বলবেন, সেটাই আইন। তিনি যে সিদ্ধান্ত নেবেন, সেটাই বিচার। বিভিন্ন দলের হয়ে তিনি যতবার দাঁড়িয়েছেন ততবারই জিতেছেন। ২০২২ সালে যদিও একবার তিনি বেকায়দায় পড়েছিলেন, অস্ত্র আইনে ফেঁসে তাঁকে বিধানসভা থেকে পদত্যাগ করতে হয়েছিল। তাতে অবশ্য ক্ষতি হয়নি। কারণ তাঁর আসনে তার স্ত্রী নীলমদেবীকে দাঁড় করান এবং যথারীতি তিনি জিতেও যান। এই এবার যেমন নির্বাচনের মাত্র ৫ দিন আগে তিনি এক বৃদ্ধ ৭৫ বছরের রাজনৈতিক নেতা দুলারচাঁদকে খুন করে জেলে যান। কিন্তু তাতে ফলাফল উল্টো হয়নি। জেলে বসেই তিনি বিরাট ব্যবধানে জয়লাভ করেন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী সুরোজভান সিংহ, তিনিও এক বিশাল ডন, দোর্দণ্ডপ্রতাপ তাঁর। কিন্তু তিনি স্ত্রী বীনা সিংহকে অনন্তের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে জেতাতে পারেননি।

মোহম্মদ শাহাবুদ্দিন। বিহারে তাঁকে সবাই এক নামে চেনে। এককালে ছিলেন গ্যাংস্টার পরে হলেন রাজনৈতিক নেতা। দক্ষিণে যেমন অধিকাংশ রাজনৈতিক নেতাই অভিনয় জগৎ থেকে উঠে এসেছেন তেমনি বিহারে বহু নেতাই বাহুবলী রূপেই রাজনৈতিক নেতৃত্ব গ্রহণ করেছেন। এখানে বাহুবলীর জয়জয়কার। এবারের নির্বাচনে শাহাবুদ্দিনের ছেলে ওসামা শাহাব জয়লাভ করেছেন। শাহাবুদ্দিন অবশ্য ২০২১ সালের করোনা মহামারীতে মারা যান। পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তিনিও এখন নামজাদা বাহুবলী। তিনি জিতেছেন রঘুনাথপুর কেন্দ্র থেকে, তাঁর জয়ের ব্যবধান হলো ৯২৪৮ কিন্তু অনন্ত সিংহের ভোটের ব্যবধান হলো ২৮ হাজার ২০৬। বিহারে কোনও বাহুবলী হেরেছেন বলে খবর নেই। যিনি হেরেছেন সেখানে আর এক বাহুবলী জিতেছেন অর্থাৎ বাহুবলীদেরই জয়জয়কার।
সদ্যসমাপ্ত বিহার নির্বাচনে আরেকটি চমকপ্রদক খবর হচ্ছে যে এখানে এক নম্বরে থাকা শাসক দল মোট ভোট পেয়েছে মাত্র কুড়ি শতাংশ আর তৃতীয় স্থানে থাকা মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী তেজস্বীপ্রতাপের দল পেয়েছে মোট ২৩ শতাংশ ভোট। তিন শতাংশ বেশি ভোট পেয়ে আসন পেয়েছেন মাত্র ২৫টি।

বিশেষজ্ঞদের মতে এই অদ্ভুত ব্যবধানের প্রধান কারণ চিরাগ পাশওয়ানের নবগঠিত রাষ্ট্রীয় লোক জনশক্তি পার্টি। ভোট কাটাকাটির অঙ্কেই তেজস্বীর পতন ঘটেছে। তবে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আরও দু’টি কারণ। প্রথমত, মুসলিম ভোটাররা এবার আরজেডি থেকে অনেকাংশে সরে গিয়েছে। দ্বিতীয়ত, যাদব বিরোধী ঐক্য, যার ফলে তেজস্বী যাদবের ভাগ্য দুর্ভাগ্যে পরিণত হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে বিজেপির একটি রণকৌশল অত্যন্ত কাজ দিয়েছে। তারা এমন একটা সময় নির্বাচনের দিন নির্ধারণ করেছে যার থেকে ছট পুজোর ব্যবধান খুব অল্প। অন্য সময় বিহারের লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিক এবং অন্যান্যরা সারা ভারতেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকেন, কিন্তু ছট পুজোর সময় প্রায় সকলেই বাড়ি ফেরেন এবং দেশের বাড়িতেই দীর্ঘ সময় কাটান। এর ফলে ভোটদানের সংখ্যা বেড়েছে, যার অধিকাংশই গিয়েছে শাসক দলের জোটে।

তবে এটা অনস্বীকার্য যে, নীতিশকুমার বিহারে জঙ্গলের রাজত্বের অবসান ঘটিয়ে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। শুধু তাই নয়, বিহারে আইনশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা, সামাজিক নিরাপত্তা প্রদান এবং দুর্নীতি অনেকাংশেই দমন করেছিলেন। তাই উচ্চশিক্ষিত, মার্জিত, রুচিশীল, ভদ্র নীতীশকুমারের ওপর বিহারের মানুষ আজও ভরসা রাখে, তা তিনি যতবারই জোট পাল্টান না কেন, সে কথা মানুষ গুরুত্ব দেয় না, এই নির্বাচন সেটাই আবার প্রমাণ করল।

বর্তমানে ভোটারদের আচরণের ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। এটা রাজনৈতিক নেতারা ভুলে যান। যে কারণে বাংলায় দুর্নীতির অভিযোগ ভোটাররা কানে তোলে না, সেরকমই বিহারে এসআইআর প্রচার বিরোধীদের মাথায় ঢোকেনি। তাই নির্বাচন ঘোষণার আগের দিন মাস্টারস্ট্রোক দিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমার। তিনি বুঝেছেন এখনকার ভোটাররা সবসময় কিছু পেতে চায়, নগদ প্রাপ্তি হলে তো কথাই নেই! তাই বিহারে ভোটের আগে সব দলই বিনামূল্যে ঝুড়ি ঝুড়ি প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেছেন, যেমন বিনামূল্যে শিক্ষা-স্বাস্থ্য, বিনা পয়সায় বিদ্যুৎ, চাষ না করেও ফসল, কাজ না করেও বেতন, এমন অনেক অনেক প্রতিশ্রুতি তারা দিয়েছেন, শেষ চালটা দিয়েছেন নীতীশ কুমার। মহিলাদের জন্য নানাধরনের প্রকল্প ঘোষণা করে জানালেন, রাজ্যের প্রত্যেকটি মহিলার একাউন্টে ১০,০০০ টাকা করে জমা পড়ে যাবে। ব্যাস এরপর নীতীশ কুমারকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি।

এই কৌশলের পথপ্রদর্শক কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি। তাঁর সবুজ সাথী, কৃষকসাথী এবং সর্বোপরি লক্ষ্মীর ভাণ্ডার সারা ভারতে আদর্শ মডেল হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেখা যাচ্ছে সারা ভারতে প্রায় সব রাজ্যই এমনকি বিজেপিশাসিত রাজ্যগুলিও এই দান খয়রাতির পথ অবলম্বন করছে। তার মানে সেই আপ্তবাক্যই কি সত্য হয়ে দাঁড়ালো? ‘আজ বাংলা যা করে, আগামীকাল ভারত তাই ভাবে!’
সত্য সেলুকাস কি বিচিত্র এই দেশ!