বাঙালি আজও দেশভাগের বিষাদ কাটিয়ে উঠতে পারেনি

১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাদের ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছে ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণ চুক্তির মুহূর্তে। ফাইল চিত্র

স্বপনকুমার মণ্ডল

দেশজুড়ে স্বাধীনতা দিবসের পঁচাত্তর বছর পালনে অমৃত মহোৎসবের ঘটা বছর তিনেক আগেই শুরু হয়েছিল। সেখানে প্রেমের সেরা দেশপ্রেমের জয়গানে মুখর সরকারি বদান্যতায় তার সযত্ন আয়োজনে আড়ম্বর অত্যন্ত স্বাভাবিক মনে হয়েছিল। দেশকে ঐক্যবদ্ধ রাখতেই শুধু নয়, সেই ঐক্যকে সুনিয়ন্ত্রিত ভাবে প্রদর্শনের ক্ষেত্রেও সাময়িক সুযোগের সদ্ব্যবহার জরুরি হয়ে ওঠে। যেখানে ভালো থাকার বিজ্ঞাপনে মুখের হাসি অমলিন মনে হয়, সেখানে দেশের দুরবস্থাকে আড়াল করায় দেশপ্রেমের ঐক্যের নিশান ওড়ানোই দস্তুর। অথচ সেই ঐক্যের মধ্যে তার জোড়াতালিই বারবার বেরিয়ে পড়ে। সেখানে দেশের স্বাধীনতা পঁচাত্তর বছরের কায়ার মধ্যেই তার দেশভাগের পঁচাত্তর বছরের ছায়াও এসে পড়ে। বৈচিত্রের মধ্যেই ঐক্যর সুমহান বিশেষত্বই দেশভাগের ট্র্যাজিক পরিণতিতে নিঃস্ব হয়ে যায়। ধর্মীয় জিগির তুলে দেশটির ডানা ছেঁটে যেভাবে দুটি দেশ তৈরি করা হয়েছিল, তাতে সময়ান্তরে তিনটি দেশে পরিণত হয়। তাতে বোঝা যায় ধর্মভেদে দেশভাগ সমাধান নয়,বরং সবচেয়ে বড় সমস্যা।

এজন্য যা ছিল সমাধানের পথ,তাই হয়েছে সমস্যার বিস্তার। জ্যাক দেরিদার ভাষায় binary opposition বা যুগল বৈপরীত্য। সংঘাত ও রক্তপাত এড়াতে দেশভাগের ব্যবস্থা যে হিতে বিপরীত হয়েছে, তা তার পঁচাত্তর বছর পেরিয়েও বারবার প্রমাণিত হয়ে চলেছে। যা ভাবা হয়েছিল সংঘাত ও রক্তপাত এড়ানোর উপায়, তাই তার কারণ হয়ে উঠেছে। সেখানে স্বাধীনতার সুফলের চেয়ে দেশভাগে সাম্প্রদায়িক সংঘাত আরও প্রকট রূপ লাভ করেছে। আসলে দেশভাগের মধ্যেই তার বীজ ছিল, সময়ান্তরে তাই মহীরূহ হয়ে উঠেছে মাত্র। সেখানে ২০২৫-এসে যেভাবে নির্বাচন কমিশনের ভোটার তালিকার নিবিড় সংশোধনী বা SIR করার আয়োজন চলেছে, তার মধ্যেই দেশজুড়ে বাঙালিবিরোধী থেকে বাঙালিবিদ্বেষ প্রকট আকার ধারণ করেছে,তাতে এ দেশে আপামর বাঙালির দেশভাগের স্বদেশে পরবাসীর ছিন্নমূল জীবনই প্রকট হয়ে উঠছে। দেশের স্বাধীনতার আনন্দের চেয়ে দেশভাগের বিষাদই এখনও ভয়ঙ্কর রূপে বেঁচে আছে। সেদিক থেকে খণ্ডিত পাঞ্জাবে পাঞ্জাবিরা দেশভাগের বিষাদ স্বাধীনতা-স্বাদে কাটিয়ে উঠতে পারলেও বাঙালি আজও পারেনি।


আসলে দেশকে সেদিন ধর্মীয় ভাগ বাঁটোয়ারার শিকারে পাখির ডানা কাটার মতো ভাগ করে স্বাধীনতার স্বপ্ন জেগে উঠেছিল, অচিরেই তা বাস্তবের মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়ে। দেশপ্রেমের চেয়ে বড় হয়ে উঠল সাম্প্রদায়িক পরিচয়। সেখানে মানুষের দেশের চেয়ে ধর্মের আপন দেশ জেগে ওঠায় সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়ে যায়। তাতে স্বাধীনতার আনন্দের চেয়ে সাম্প্রদায়িক আগুন জ্বলে ওঠে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। সেই আগুন সময়ান্তরে নিস্তেজ হলেও একেবারে নিভে যায়নি। সে আগুন যে মনের, মননের। দেশভাগ মেনে নিলেও মনে নেয়নি,নিতে পারে না। এজন্য ধর্মীয় বিদ্বেষে সেই দেশভাগ জেগে ওঠে। আর তা তীব্র আকার ধারণ করলেই দাঙ্গার আতঙ্ক মনকে গ্রাস করে, পরাধীনতার কথা মনে পড়ে,দেশান্তর হওয়ার ভয়ও হাতছানি দেয়। সেই আতঙ্ক ও ভয়ই স্বাধীন দেশে রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের পুঁজিতে পরিণত হয়েছে। স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছরে সেই দেশভাগের সাম্প্রদায়িক ভাগ বাঁটোয়ারার কথা যেমন ফিরে ফিরে আসে, তেমনই তা রাজনীতিতে চলমান ইতিহাস হয়ে ওঠে। সেখানে দেশের অস্তিত্বে দেশবাসীর চেয়ে ধর্মীয় পরিচয় বড় মনে হয়।

আসলে দেশভাগে তো সবাই স্বাধীন দেশ পেল না, উল্টে অসংখ্য মানুষ নতুন করে পরাধীন হয়ে গেল, স্বদেশেই পরবাসী হল। শুরু হল শরণার্থীর মিছিল, নিজের দেশ খোঁজা। উদ্বাস্তু হয়ে কেউ অনুপ্রবেশকারী, কেউ মহাজির, কেউ বিদেশি। দেশ মানে তো শুধু সীমানাবেষ্টিত এলাকা বা স্থান নয়, দেশ আসলে মানুষের অস্তিত্ব। তাকে ভাগ করা মানে মানুষ ভাগ, মানুষের সত্তাকে খণ্ডিত করা। দেশভাগে তাই অধিকাংশ দেশ পেল, অনেকেই দেশ হারাল। শুধু হারাল না, নিজের ভিটেমাটি ছেড়ে ছিন্নমূল হয়ে নতুন দেশের ঠিকানা খুঁজতে গিয়ে আত্মীয়-স্বজন বিষয়সম্পত্তি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেল। নিজের জন্মভূমির নাম বুকে নিয়ে চললেও মুখে আনাই বিপদ মনে হল। সে বিপদ আজও কাটেনি। নতুন দেশে এসেও শরণার্থী-মনে স্বদেশের হাতছানি বেশি কষ্ট দেয়। সেখানে বেড়ে ওঠা, গড়ে তোলা জীবনের আকাশ-বাতাসের পরম পরশ নিত্য মনে জেগে ওঠে। এজন্য যারা দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে, তারা যেমন অস্তিত্ব সংকটে পর্যুদস্ত হয়েছে, যারা তার মধ্যেও ভিটেমাটি আঁকড়ে ভবিষ্যতের উপর ভর করে স্বদেশেই থেকে গিয়েছিলেন, তারাও দুর্গতি থেকে রেহাই পাননি। তাদেরও নিরন্তর নির্যাতনের শিকারের কথা নানাভাবে উঠে আসে। শুধু তাই নয়, সেক্ষেত্রে নতুন করে দেশভাগে দেশত্যাগের প্রবাহ আজও থেমে যায়নি। দেশভাগের অস্থিরতা আজও মানুষকে তাড়া দেয়। সেখানে দেশভেদে সংখ্যালঘুর প্রতি সংখ্যাগুরুর দমন-পীড়নে অস্থির প্রতিযোগিতাই জুড়ে থাকেনি, নতুন করে দেশের হৃত গৌরব ও ইতিহাস রচনার সক্রিয় উদ্যোগও তাতে প্রকট হয়ে ওঠে। উন্নয়নের অভিমুখ যদি ধর্মীয় পরিসরে আবর্তিত হয়,তাতে উগ্র ধর্মান্ধই প্রকট হয়ে ওঠে, মানুষের ধর্ম সেখানে ব্যাহত হতে বাধ্য। সেক্ষেত্রে আমাদের দেশের গৌরববোধ নিঃস্ব হয়ে পড়ে, সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মের দেশ নিবিড়তা লাভ করে।

আশ্চর্যের বিষয়, ২০২২-এ সারা দেশ জুড়ে স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর তথা ‘আজাদী কা অমৃত মহোৎসব’ পালনের পাশাপাশি সরকারিভাবেই দেশভাগের ইতিহাসকেও প্রদর্শনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তা নিয়ে বিতর্কও দেখা দিয়েছে। সেক্ষেত্রে বিতর্ককে সরিয়ে রেখেও বলা যায় দেশভাগের অভিশাপকে দেশ এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি। উল্টে তা যে রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতায়নের পুঁজিতে সমান সক্রিয়, তাও স্পষ্ট। ইতিহাস স্মরণীয় হবে অবশ্যই, কিন্তু তা কখনও স্বার্থ সিদ্ধির পুঁজিতে পরিণত হতে পারে না। তা থেকে উত্তরণের লক্ষ্যই আমাদের জরুরি মনে হয়। সেখানে স্বাধীনতা ও দেশভাগের সংযোগই বলে দেয় পঁচাত্তর বছর পেরিয়ে এলেও ভাগ বাঁটোয়ারাতে আমাদের মন সেই পিছনেই পড়ে আছে। অন্যদিকে দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে এখনও অসংখ্য মানুষের মনে অজানা অনিশ্চয়তা। দেশে থেকেও উদ্বাস্তু ও অনুপ্রবেশকারী মনে হলে ঘরে ঘরে তেরঙ্গা ওড়ানো সম্ভব নয়। মনে যে ঘরটাই তার নেই। সেখানে NRC, CAA-র মধ্যে যে রাজনৈতিক জুজু বর্তমান, তার মধ্যে তো দেশভাগেরই ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অভিসন্ধির অত্যাধুনিক সংস্করণ ভেসে ওঠে। সেখানে ঘরে ঘরে তিরঙ্গা তোলার সদিচ্ছা থাকলেও ভাগের মা গঙ্গা পায় না’র মতো অবস্থা।