বাঙালির ভাষা

ফাইল চিত্র

শ্রী সুকুমার সেন

পূর্ব প্রকাশিতর পর

ছোলার ব্যাসন জলে গুলে নরম করবার অর্থাৎ ফাঁপাবার জন্যে অনেকবার ফেটিয়ে নিয়ে তেলে (বা ঘিয়ে) ভাজলে হয় ফুলুরি। শব্দটি এসেছে ‘ফুলবড়ি’ থেকে, সে শব্দ এসেছে সংস্কৃত ‘ফুল্ল+বটিকা’ থেকে। অর্থাৎ সেকালের ভাষায় তুলোবড়া। বেগুন সরু সুর চাকরি করে কেটে ব্যাসনে ডুবিয়ে নিয়ে ভাজলে হয় বেগুনি। পেঁয়াজের পাপড়ি নিয়ে ‘পেঁয়াজি’ আর পটোলের চিলতে নিয়ে পট্লি খাস কলকাতার উদ্ভাবন। অনেকদিন আগে উড়িয়ার দোকানের ‘পট্লি’ খেয়েছিলুম মনে আছে। খুব ভালো লাগেনি। গৃহস্থ বাড়িতে কুমড়োর চাকতি দিয়ে যা হয় তার নাম কানে গেছে ‘কুমড়ি’। কিন্তু আলুর চাকতি নিয়ে যা হয় তার নাম এখনো শুনিনি। তার নাম কি আলুড়ি?


ব্যাসনগুলো ভালো করে ফেটিয়ে নিয়ে ছান্তার মতো ফুটো করা হাতা দিয়ে তেলে বা ঘিয়ে ফোঁটার মতো বোঁদে তৈরী হয়। তারপর তা রসে ফেলে ভিজিয়ে নেওয়া হয়। কথাটি এসেছে সংস্কৃত ‘বিন্দু’ থেকে হিন্দি ‘বুন্দ’-এর মার্ফৎ এমনিভাবে জিলিপিও ছাঁকা হয়। তবে তাতে মাসকলাইয়ের ব্যাসন লাগে শক্ত করবার জন্য। জিলিপির হাতা একছিদ্র। শব্দটি এসেছে হয়তো হিন্দি জিলেবি থেকে। এ শব্দের মূলে সংস্কৃত ‘ঝিল্লি’ (grill) থাকা সম্ভব। কোন কোন অঞ্চলে বলে ঝিলগি।

ব্যাসন শক্ত করে মেখে ছান্তার উপর রেখে জোর দিয়ে চেপে লম্বা লম্বা দড়ির মতো যা ছেঁকে তোলা হয় তা পরে অল্প চিনির রসে পাক করে শুকনো করলে বলে সিঁড়িভাজা। চিনি না দিয়ে গুড়ে পাক করে নিয়ে নাড়ু বানালে বলে সিঁড়ির নাড়ু। কোথাও কোথাও এর নামান্তর টানানাড়ু। ব্যাসন ছান্তায় চেপে চালাতে হয় বলে ভাজা বস্তুটির গায়ে খাঁজকাটা দাগের মতো পড়ে। তার থেকে ‘সিঁড়ি’ নাম। টান অর্থাৎ জোর দেওয়া হয় বলে নামান্তর ‘টানা’।

বিচিত্র রঙের বোঁদের নাড়ুকে কলকাতায় দরবেশ বলে আর শক্ত বোঁদের নাড়ুকে মোতিচুর বা মিঠাই বলে সে কথা আগে বলেছি।

বোঁদের আকার সব একরকম হয় না। কোনোটা ছোটো কোনোটা বড়ো কোনোটা লম্বাটে কোনোটা গোল। তবে মোটামুটি সব ছোটো। বড়ো এবং একরকম আকারের বোঁদেকে বলা হয়ি নিখুঁতি অর্থাৎ যার আকারে খুঁত নেই।

বুটের ব্যাসনে সর্ষের মতো খুব ছোট ছোট দানার বোঁদের নাম মিহিদানা। বোঁদে থেকে মিহিদানার সৃষ্টি হয়েছিল বর্ধমানে রাজবাড়ির আওতায়। মিহিদানার নাড়ু করাও হত।

জ্বাল দেওয়া দুধ কেটে ছেনার সৃষ্টি বোধ হয় প্রথম আমাদের বাংলাদেশেই হয়েছিল।

(ক্রমশ)