বাঙালির ভাষা

ফাইল চিত্র

শ্রী সুকুমার সেন

পূর্ব প্রকাশিতর পর

কদমার মতো পাক করে তার উপর তিল (সাদা) ছড়িয়ে দিয়ে পাটালির মতো করলে বলে তিলে অথবা তিলেখাজা কিংবা বীরখন্ডি। তিল দেওয়া আছে ‘তিলে’ (সংস্কৃত তিল +ক থেকে।) শক্ত, কামড়ে খেতে হয় বলে ‘খাজা’ (সংস্কৃত ‘খাদ্য+ক’ থেকে।) বীরের উপযুক্ত কঠিন খণ্ড (অর্থাৎ মিষ্টান্ন) বলে বীরখন্ডি।


গুড়ের মাৎ ও রস ঝরিয়ে হয় ভুরো। ভুরোকে পরিষ্কার করলে হয় চিনি। এ নামটি এসেছে ‘চীন’ দেশ নাম থেকে। মোগল আমলে চীনেরাই এদেশে ভালো চিনি করবার পথ দেখিয়ে দেয়, তাই এই নাম। দিশি উপায়ে প্রস্তুত চিনির নাম ছিল সিতা, অর্থাৎ সাদা। চিনি পাক করে মিছরি হয়। আগে বলত সিতাখন্ড অথবা শুধু সিতা। মিছরি নামটি এসেছে ইরান থেকে। ইজিপটে ফারসীতে বলে ‘মিশর’। অর্বাচীন সংস্কৃতে মিছরির ভালো নাম ছিল *মিশ্রখন্ডিক বা* মিশ্রখন্ড। এই কথাটির অর্ধ-তৎসম রূপ *মিচ্ছন্ডি অর্বাচীন সংস্কৃত অভিধানে ভোল বদলে হয় মৎস্যন্ডী।

তিল ভেজে নিয়ে গুঁড়ো করে ক্ষীর আর চিনির সঙ্গে পাক করে নরম ছোট ছোট পাটালির মতো করলে হয় তিলকুটো (সংস্কৃত ‘তল+কুট্ট’)। এ মিষ্টান্নটি কলকাতায়ই বেশি প্রচলিত।

নারকেল কোরা গুড়ের সঙ্গে নরম পাক করে নারকেল-নাড়ু তৈরি হয়। আর চিনির সঙ্গে হালকা পাক করলে হয় যে মিষ্টি তার কোন বিশিষ্ট নাম নেই। ছোট ছোট চেপ্টা আকারে গড়ে চাপ দেওয়া হয় তাই বলে নারকেল-ছাবা (কারে ছাঁচের ছাপ দেওয়া হয় বলে)। নারকেল কুরে তা খুব মিহি করে বেঁটে চিনি দিয়ে শক্ত পাক করে নাড়ু তৈরি করলে বলে রসকরা। নামটি এসেছে সম্ভবত সংস্কৃত ‘রস+শর্করা’ থেকে। এ মিষ্টান্ন দাঁতভাঙা এবং দীর্ঘস্থায়ী। একদা এ দেশে খুব চলন ছিল, এখন উড়িষ্যায় চলে। নারকেল পুলির উল্লেখ আগে করেছি। এ মিষ্টান্ন করতে গেলে ঝুনো নারকেল হবে না, দোমালা নারকেল (বা ডাব) চাই। (দোমালা মানে যে ডাবের ভিতরে উপর-নিচে দুদিকেই শাঁস জমেছে এবং ঝুনো হতে দেরি আছে।) দোমালা নারকেলের শাঁস বেঁটে তাতে ক্ষীর আর চিনি বেঁটে দিয়ে নরম পাক করতে হয়। আকার অর্ধচন্দ্রাকার বলে নাম চন্দ্রপুলি।

একদা বাংলার মিষ্টান্নে চালগুঁড়ি চলত কিন্তু ডালগুঁড়ি চলত না। ডাল ভিজিয়ে বাঁটা হত তখন তা চলত। ডালের গুঁড়ির অর্থাৎ ব্যাসনের ব্যবহার শিখেছিল বাঙালী বৃন্দাবন-মথুরা-আগ্রা-দিল্লি থেকে, যেখান থেকে মুসলমান আমলে উত্তর-পশ্চিমের কালচার এসেছিল।

ভাজা মুগের গুঁড়ো চিনির সঙ্গে মিশিয়ে অল্প পাক করে পাকালে হয় মুগের নাড়ু। এ বস্তু এখনও কলকাতাতেই বেশি চলে অবাঙালী সমাজে। ভাজা মুগের গুঁড়ো নিয়ে এমনই একরকম নাড়ু, বাঁকুড়া অঞ্চলে মোয়া নামে প্রসিদ্ধ। ব্যাসন হয় সাধারণত চুটের অর্থাৎ ছোলার ডালের অথবা মটর ডালের। কোন কোন মিষ্টোন্নে মাষকলাইয়ের ব্যাসনও দরকার হয়।

(ক্রমশ)