সুমনা আদক
বিলেতের দুর্গাপুজোর ভিড়ে আড্ডার পুজো এবার পদার্পণ করল সপ্তম বর্ষে। গত ২৫ থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত স্লাউয়ের ক্রিকেট ক্লাবপ্রাঙ্গণে সাবেক রীতিতে অনুষ্ঠিত হয়ে গেল এবারের শারদোৎসব। কলকাতার ম্যাডক্স স্কোয়ারের সেই বাঙালি আড্ডার আবহ এবার যেন বাস্তব রূপ পেল লন্ডনের পূজামণ্ডপে। এবারের আয়োজনের মূল থিম— ‘চায়ের দোকানের আড্ডাখানা’। বড্ড নস্টালজিক। এবারের স্লাওয়ের পুজোতে বাঙালির সংস্কৃতি, রাজনীতি, সংসার, প্রেম-ভালোবাসা, ফ্যাশন— সবই মিশে গিয়েছিল তাদের আড্ডার প্রাণবন্ত পরিবেশে, বাঙালি থাকবে আর সাংস্কৃতিক আয়োজন হবে না সেটা আবার হয় নাকি? কর্ণাটকের রঙ্গোলির আলপনা দিয়ে সাজানো হয় স্লাউয়ের পুরো পূজামণ্ডপ, সূক্ষ্ম নকশার সঙ্গে ফুলের কারুকাজে তুলে ধরা হয় ভারতের ঐতিহ্যবাহী শিল্পকলা।
এবছর বিজয়ার সন্ধ্যায় ছিল বিশেষ চমক। গায়িকা লগ্নজিতা চক্রবর্তী হাজির ছিলেন সেদিন। ‘বসন্ত এসে গেছে’ থেকে ‘ভালোবাসি বলবো না’— সব গানেই তিনি মাতিয়ে রাখলেন লন্ডনের বাঙালি শ্রোতাদের। পুজো কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, এবারের পুজোয় ধর্মীয় আচরণ ছাড়াও আড্ডা, শিল্প ও সংগীতের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছিল এক অন্যরকম উৎসব, যা বাঙালির মেলবন্ধনের অনন্য দৃষ্টান্ত।
লন্ডনের এক শহর থেকে আরেক শহর ঘুরলে পুরোনো পুজোগুলোর মধ্যে এবছর কেমব্রিজ শহরের দুর্গাপুজোতে থিমে উঠে এল অভিবাসন সংকট। কেমব্রিজের বাঙালিমহল পুজোয় আনন্দ করার সঙ্গে সঙ্গেই অভিবাসন নিয়েও যথেষ্ট সরব ছিলেন, যা বর্তমানে ব্রিটেনের অন্যতম আলোচিত সমস্যা। আর সেই প্রেক্ষাপটেই এ বছরের আইসিএস-এর দুর্গাপুজোর থিম।
২০০২ সালে ইন্ডিয়ান কালচারাল সোসাইটির উদ্যোগে শুরু হওয়া পুজোটা এবার পা দিল ২৪ বছরে। আয়োজকরা বলছেন, কবির ভাষায় ‘বিবিধের মাঝে দেখ মিলন’— সেই ভাবনাকেই বাস্তবে তাঁদের পুজোতে ফুটিয়ে তোলেন বারংবার। শুধু বাঙালি নয়, সব দেশের মানুষের জন্যই আইসিএস টিম এবং তাঁদের আয়োজন যথেষ্ট নজরকাড়ে। নেদারহল স্কুলে অনুষ্ঠিত হলো উমার আরাধনা, কলকাতা থেকে আনা প্রতিমাতেই পঞ্জিকা মতে শারদোৎসবের পূজা-অর্চনার শুরু থেকে সমাপ্তি ঘটল। ষষ্ঠী থেকে দশমী ভক্তিমূলক অনুষ্ঠান, আরতি, হোম, অঞ্জলি আর সন্ধিপুজোয় মণ্ডপ প্রাঙ্গণে তখন উমার ছায়া বিরাজমান। আয়োজক কমিটির প্রেসিডেন্ট বর্ণালীদি নিজের হাতে সাজিয়ে তোলেন মণ্ডপ। উনি বলেন, ‘প্রবাসে থেকেও আগামী প্রজন্মকে শিকড় ও সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত রাখাই আমাদের উদ্দেশ্য।’
পুজোর সঙ্গে সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় বাংলা গান, কবিতা, ধুনুচি নাচ, ছোটদের নানারকম প্রতিযোগিতার সঙ্গে ভোগ বিতরণ, দোকানের স্টল সবই ছিল। এককথায় বলা চলে কলকাতা থেকে দূরে থেকেও কলকাতাকে কাছে পাবার চেষ্টা।
কেমব্রিজ থেকে একটু দূরে ক্যাম্বর্ন শহরে ভট্টাচার্য বাড়ির পুজো বেশ পুরোনো। কোভিডের সময় শুরু হওয়া পুজোটা বাড়ির পুজোর মধ্যেও বারোয়ারির ধারাকে বজায় রেখেছে। শ্রবণা ভট্টাচার্য নিজের হাতে সাজান বাড়ির পুজো, প্রসাদ বিতরণ থেকে পুজোর আয়োজন সবেতেই কোনো ত্রুটি মেলে না। তবে এবছর নিয়মমাফিক অনুষ্ঠিত হয় এই পুজো।
আচ্ছা, মিত্তলদের পুজো নিশ্চয়ই মনে আছে। এবছর লন্ডনের মিত্তলদের ক্যামডেন পুজোর থিম ‘মা’, যা উৎসবের আবহকে ভরিয়ে দেয় উমার ঘরে ফেরার আনন্দে। ১৯৬৩ সাল থেকে আজ অবধি লন্ডনের ‘সুইস স্কোটেজ লাইব্রেরির’ অন্দরে ক্যামডেনের উমার আগমনীর সুরে মুগ্ধ হয় এখানকার বাঙালি মহল। বছর ঘুরলেও এ ছবির বদল নেই এতটুকু। তৎকালীন লন্ডনে বসবাসকারী কয়েকজন প্রবাসী বাঙালির হাত ধরে শুরু হওয়া পুজোটা ৬০ শরৎ পেরিয়ে ৬২ বর্ষেও ভালোলাগার স্মৃতিতে আজও ভরপুর। এমনকি অতিমারির অন্ধকারে স্তব্ধ ব্রিটেনে যখন কৈলাশ থেকে সপরিবারে মা উমা পা রেখেছিলেন এই টেমসের ধারে সুইস স্কোটেজ লাইব্রেরির বারান্দায় ক্যামডেনে, তখন নিঃস্তব্ধ এক সাজানো শহর। ক্যামডেনের দুর্গাপুজো মণ্ডপের আভিজাত্যের কারণেই তারা শিরোনামে থাকে বারংবার। লক্ষ্মী মিত্তলদের পুজো, তার জৌলুস অনেক বেশি, এমন আভিজাত্যের টানেই দেশ বিদেশের মিডিয়া ছুটে আসে লন্ডনে। পঞ্জিকা মতে ‘টেমসের’ তীরে খুঁটি পুজো দিয়েই প্রতিবছরের মতো এবারেও পুজোর ঢাকে কাঠি পড়েছিল। ষষ্ঠীর সকাল থেকে শুরু হয়ে, দশমীর বারবেলার সিঁদুরে রাঙা হয়ে শেষ হয় উৎসবের। পূজামণ্ডপের কোনায় কোনায় সাবেকিয়ানায় ভরপুর। মনে পড়ে বাংলার কথা, শিখিয়ে দেয় বাঙালি সংস্কৃতির পঠন পাঠন।
ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী পেরিয়ে দশমী— এবারেও পুজোর পাঁচ দিনই মায়ের বরণ, অঞ্জলি, সন্ধিপুজো, কুমারীপুজো অবশেষে মায়ের বিসর্জনের বিদায়বেলায় মনখারাপের পালা। এবছর মিত্তলদের পুজোর ভাবনায় উঠে এসেছিল ‘মা অর্থাৎ উমা’র আগমন। মহিষাসুরমর্দিনীর সুরের ঝঙ্কারে ডোনা গাঙ্গুলীর নৃত্যে আলোকিত হয় মণ্ডপের রঙিন দুয়ার। অষ্টমীর সন্ধ্যেবেলার সুরেলা ছন্দের অনুরণনের স্রোত বয়ে গিয়েছিল পুজো মণ্ডপের অলিন্দে। লক্ষ্মী মিত্তলের উদ্যোগে বিশেষ বিমানে কুমারটুলি থেকে উমা পাড়ি দিয়েছিলেন ক্যামেডেনের মাটিতে।
লালপাড় শাড়িতে বঙ্গতনয়ারা সেজেছিল অন্য রূপে, ধুতি-পাঞ্জাবীতে ছেলেরাও দিয়েছিল দেদার চমক। ঢাক, ধুনোর গন্ধ, ধুনুচি নাচ, শঙ্খ-উলুধ্বনি আর সিঁদুর খেলার গোধূলি নিয়ে ‘সুইস স্কটেজ লাইব্রেরির’ অন্দর উৎসবের আনন্দধারার মেজাজ হয়ে উঠেছিল অন্যরকম। একেবারে আমাদের সেই পুরোনো কলকাতা, সেই বাংলা— লন্ডন নয়। প্রত্যেক বারের মতো এবারেও গানে, গল্পে, খাওয়াদাওয়ার আসরে হাজির ছিল মোমো-ফুচকা, বাঙালির খাবারের সঙ্গে কষা মাংস, শেষপাতে রসগোল্লা আর মিষ্টি দই। ষষ্ঠী থেকে দশমী লন্ডনের ‘সুইস স্কটেজ লাইব্রেরি’ ভালোবাসার ভাগ বসিয়েছিল এখানকার প্রত্যেক বাঙালির মনে। লন্ডনের সর্বপ্রথম ‘ক্যামডেন’ দুর্গা পুজো বিশ্বের নজর টানে প্রতিবার। প্রেসিডেন্ট ডক্টর আনন্দ গুপ্তের কথায়, ‘এতো বছর ধরে একইভাবে আমরা রীতি এবং পঞ্জিকা মতে পুজো করে আসছি, মায়ের আশীর্বাদ নিয়ে বাংলার শ্রেষ্ঠ উৎসব এবং সংস্কৃতির যুগলবন্দি একসঙ্গে বেঁধে রেখেছে আমাদের। আমাদের বর্তমান এই প্রচেষ্টা আগামী প্রজন্মের হাত ধরেও বইতে থাকবে বছরের পর বছর।’
ভাবতেও বেশ লাগে কত ভালো, কত খারাপ পেরিয়েও কলকাতা থেকে হাজারো মাইল দূরে কোনো এক শহরের দুর্গাপুজোর এমন ধরনের ছবিগুলোই বলে দেয় বাঙালি রয়েছে আজও তেমন, তা সেকালেই হোক কিংবা একালে। এ ছবি ব্যাকুল করে সব বাঙালিকে। ‘ক্যামডেনের’ মিত্তলদের পুজো নিজেই নিজের জৌলুস ধরে রেখেছে বছরের পর বছর।
লন্ডন পেরিয়ে একটু স্কটল্যান্ডের দিকে গেলে এডিনবার্গ দুর্গোৎসব জমজমাট ছিল এবছরও।
২০১৪ সালে আইটি পেশায় যুক্ত গুটিকয়েক বাঙালির হাত ধরে শুরু হওয়া পুজোটা ব্রিটেনের শারদোৎসবের আলোকে ঝলমল করে রেখেছিল এডিনবার্গ শহর। স্কটল্যান্ডের রাজধানী এডিনবার্গের এডিনবার্গ দুর্গোৎসব, শরতের রঙিন আবহে দ্বাদশ বছরে পা দিয়েছে এই দুর্গোৎসব। ব্রিটেনের অন্যতম বড় বাঙালি সাংস্কৃতিক আয়োজনে পরিণত হওয়া এই উৎসব কেবল ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং প্রবাসে বাংলার ঐতিহ্য ও সম্প্রদায়ের মিলনের প্রতীক বলা হয় এই এডিনবার্গের পুজোকে।
উৎসবের আয়োজক সংস্থা সাবাস কমিটি তাদের উদ্যোগে (Scottish Association of Bengali Arts and Cultural Heritage) এক দশকে নববর্ষ থেকে বিজয়া সম্মিলনী— নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করেছে সানন্দে।
তবে দুর্গোৎসবই তাদের সবচেয়ে বড় আয়োজন, যেখানে হাজারো মানুষ একত্র হয় অষ্টমীর ভোগ বিতরণে যোগ দিতে। আয়োজকদের থেকে জানা গেল, এ বছর পুজোর দিনগুলোতে প্রতিদিন অনুষ্ঠিত হয়েছে ভক্তিমূলক আচার-অনুষ্ঠান, পুষ্পাঞ্জলি, ধুনুচি নাচ, সঙ্গীত ও নৃত্য। বিশেষ আকর্ষণ হিসেবে ছিল রবীন্দ্রসংগীত, ঢাকের তালে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং পুজোর শেষ দিনে বহুল জনপ্রিয় সিঁদুর খেলা, যা এডিনবার্গের পুজোর অন্যতম আকর্ষণ বলা চলে। ‘সাবাস’-এর সভাপতি বলেন, ‘এডিনবার্গ দুর্গোৎসব কেবল প্রবাসী বাঙালিদের নয়, স্থানীয় স্কটিশ ও আন্তর্জাতিক দর্শনার্থীদের জন্যও সমানভাবে আকর্ষণীয় হয়ে উঠছে। এটি আমাদের বিশ্বাস, ঐতিহ্য ও সম্প্রদায়ের এক অনন্য প্রতীক।’
এবারেও দুর্গোৎসবে কয়েক হাজার মানুষের সমাগম হয়েছিল এডিনবার্গে।