বন্দে মাতরম বিতর্কের আড়ালে

ফাইল চিত্র

সংসদে ‘বন্দে মাতরম’–এর ১৫০ বছর উপলক্ষ্যে অনুষ্ঠিত বিশেষ আলোচনার উদ্দেশ্য ছিল জাতীয় গানটির ঐতিহাসিক তাৎপর্য পুনরাবিষ্কার। কিন্তু আলোচনার কেন্দ্রে উঠে এল সম্পূর্ণ ভিন্ন এক বিতর্ক– প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর মুখে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের নাম উচ্চারণ। তিনি যখন ভাষণ শুরু করেন ‘বঙ্কিমদা’ বলে, তখনই তৃণমূল কংগ্রেস সাংসদ সৌগত রায়ের প্রতিবাদে সংসদে আলোড়ন ওঠে। ভাষার সূক্ষ্মতা, আঞ্চলিক সামাজিক-সংস্কৃতি—সব মিলিয়ে এই ‘দা’-সম্বোধনটি মুহূর্তে জাতীয় আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে।

বাঙালি সাংস্কৃতিক মানসে ‘দা’ শব্দটি প্রীতিপূর্ণ, কিন্তু ঘনিষ্ঠতার ইঙ্গিত করে। সাহিত্য-ঐতিহ্যের আইকনদের ক্ষেত্রে ‘বাবু’, ‘মহাশয়’ বা পূর্ণ নামেই উচ্চারণ করাটা সম্মানজনক রীতি। সেই প্রেক্ষিতে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়— যাঁর ‘বন্দে মাতরম’ ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম সাংস্কৃতিক ভিত্তি— তাঁকে ‘বঙ্কিমদা’ বলা অধিকাংশ বাঙালির কাছেই অসম্মান বা অন্তত সাংস্কৃতিক অসংবেদনশীলতা বলে মনে হয়েছে। সংসদে প্রতিবাদের পর প্রধানমন্ত্রী অবশ্য হাসিমুখে ভুল স্বীকার করে ‘বঙ্কিমবাবু’ বলেন এবং পাল্টা রসিকতায় যোগ করেন, ‘তাহলে আপনাকেও দাদা বলি?’ কিন্তু বিতর্ক থামেনি।

খুব স্বাভাবিকভাবেই অভিযোগ উঠেছে, এটি কেবল ভাষার ভুল নয়, বরং বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সম্পর্কে অজ্ঞতা বা অবহেলার বহিঃপ্রকাশ। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পর্যন্ত মন্তব্য করেছেন—এটি ‘বাংলা সংস্কৃতির প্রতি অবমাননা’। অন্যদিকে বিজেপি-ঘনিষ্ঠরা বলছেন, অতিরঞ্জনই চলছে; প্রধানমন্ত্রী অনিচ্ছাকৃতভাবে কথাটি বলেছেন, এতে কোনও অসম্মানের উদ্দেশ্য ছিল না।


তবে ভাষা-ভুলের চেয়েও বড় প্রশ্নটি আসলে অন্যত্র। ভারতীয় রাজনীতিতে এখন পরিচয়, আঞ্চলিক সংস্কৃতি আর ঐতিহাসিক প্রতীক— সবই রাজনৈতিক হাতিয়ার। বাংলার ভোট-রাজনীতিতে নজর রেখে যে কোনও সাংস্কৃতিক ইঙ্গিতে এখন বহুস্তরীয় প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়। বঙ্কিমচন্দ্র যেমন বাংলা নবজাগরণের এক বিশাল স্তম্ভ, তেমনই কেন্দ্রের কাছে ‘বন্দে মাতরম’ জাতীয় ঐক্যের প্রতীক। তাই তাঁর নামের সামান্য উচ্চারণ-ভুলই এখন রাজনৈতিক দোলাচলে এক নতুন স্ফুলিঙ্গ ছড়াতে পারে।

এই বিতর্কের শেষে মূল যে সত্যটি সামনে আসে তা হল, ভারতের বহুভাষিক, বহুজাতিক চরিত্রে সাংস্কৃতিক সংবেদনশীলতা কেবল সৌজন্য নয়, রাষ্ট্রনেতাদের মৌলিক দায়িত্ব। শব্দের ভিতরেও থাকে ইতিহাস; আর ইতিহাসের ভিতরেই থাকে সম্মান। যে সম্মান বঙ্কিমচন্দ্রের মতো সৃষ্টিশীল মনীষার প্রাপ্য— রাজনৈতিক কোলাহল বা ক্ষণিক রসিকতা নয়, বরং সমগ্র জাতির পক্ষ থেকে গভীর শ্রদ্ধা, সতর্কতা এবং যথাযোগ্য মর্যাদার সঙ্গে তাঁর নাম উচ্চারণ।